ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

ইট ভাটায় পুড়ছে শিশুদের ‘রঙিন ভবিষ্যৎ’

রুবেল মজুমদার, কুমিল্লা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৫২, ২৭ জানুয়ারি ২০২৩   আপডেট: ১৬:০৬, ২৭ জানুয়ারি ২০২৩
ইট ভাটায় পুড়ছে শিশুদের ‘রঙিন ভবিষ্যৎ’

রহিম উদ্দিনের বয়স দশ বছর। পরিবারের তিন ভাইয়ের মধ্যে সে সবার বড়। ছয় বছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে মাকে নিয়ে তার সংসার। জীবনের শুরুতে দারিদ্রতার যাতাকলে নিষ্পেষিত জীবন তার। দুই বেলা দু’মুঠো খাবারের সন্ধানে নিয়তি তাকে নিয়ে যায় হাড়ভাঙা ইট ভাটায়। 

নোয়াখালী জেলার মাইজদী উপজেলার রামচন্দ্রপুর গ্রাম থেকে মাত্র ২০ হাজার টাকায় ছয় মাসের চুক্তিতে রহিম কাজ করতে এসেছেন কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার নানকরা অর্পিতা ব্রিকসে।  

রহিমের মতো সাকিব, তুহিন, সজিবদের দিয়ে পরিবারের আর্থিক সংকটের সুযোগ কাজে লাগিয়ে ইট বানানো থেকে শুরু করে পোড়ানোর মতো ঝুঁকিপূর্ণ নানা কাজ করাচ্ছেন কুমিল্লার দুই শাতাধিক ইট ভাটা মালিকরা। এসব শিশুদের দিয়ে বড় শ্রমিকদের পাশাপাশি কাঁচা ইট রোদে শুকানো, ইট তৈরি, ট্রলিতে করে ইট টেনে ভাটাস্থলে পৌঁছানো, মাটি বহনসহ নানা কাজ করানো হচ্ছে । প্রত্যেক কাজই বড়দের মতো করে করতে হয় তাদেরকেও।

এসব শিশুদের ‘স্বপ্নিল ভবিষ্যত’  দারিদ্রের বেড়াজালে বন্দি হয়ে ইটভাটাগুলোতে চাপা পড়ে আছে। যে বয়সে তাদের থাকার কথা বাবা মায়ের আদরে,পড়ার টেবিলে, খেলার মাঠে, সেখানে তারা হাড়ভাঙা পরিশ্রমে ব্যস্ত সময় পার করছে ইটের ভাটায়। এতে শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি ভাটার বিষাক্ত ধোঁয়ায় মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে শিশুরা।

বিশ্ব শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষরকারী ১৯১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। কিন্তু এখনো বাংলাদেশে এই সনদের বাস্তবায়ন হয়নি। 
জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদে শিশুদের স্বার্থ রক্ষায় ৫৪টি ধারার মধ্যে সরাসরি শিশুর সুরক্ষা ও অধিকার রক্ষা করার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া  শিশুর শিক্ষায় ব্যাঘাত সৃষ্টিকারী কিংবা তার স্বাস্থ্য অথবা শারীরিক, মানসিক, আত্মিক, নৈতিক বা সামাজিক বিকাশের জন্য ক্ষতিকর কাজ করানো  যাতে না হয়, সে ব্যবস্থা নেবে রাষ্ট্র বলেও উল্লেখ আছে সনদে ।

কুমিল্লার প্রান্তিক জনপদ ঘুরে দেখা যায়, ইটভাটাগুলোতে বছরের বড় একটা সময় জুড়ে চলে শিশু শ্রমের মহাযজ্ঞ। এ যজ্ঞের আগুনে প্রতিনিয়ত পুড়ছে হাজার হাজার শিশুর ভবিষ্যৎ। ইটভাটার মালিকরা কম মজুরিতে বেশি কাজ করিয়ে নেওয়ার লোভে শিশুদেরই ঝুঁকিপূর্ণ এসব কাজে জড়াচ্ছেন।

তবে ভাটার মালিকরা বলেছেন, অর্থের অভাবে শিশুদের ইটভাটায় নিয়ে আসে পবিবার। 

আবার অনেক ইট ভাটার মালিক বলেছেন ভিন্ন কথা। তাদের দাবি, ভাটার শ্রমিকরা তাদের শিশু সন্তানদের নিয়ে কাজ করেন। এ সময় শিশুরাও কাজে যুক্ত হয়ে যায় টাকার লোভে।

কুমিল্লা জেলার বরুড়া, চৌদ্দগ্রাম  ও সদর দক্ষিণ উপজেলার বেশ কয়েকটি ইট ভাটায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, দুপুরে কড়া রোদের মধ্যে কাজ করছে শিশুরা। এদের সবারই বয়স ৮ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে। জীবন-জীবিকার তাগিদে কেউ এসেছেন মা-বাবার সঙ্গে, কেউ শ্রমিক সর্রদারের সঙ্গে। এসব শিশুদের দিয়ে ইট ভাটার উত্তপ্ত চুলার কয়লার লোড-আনলোডের কাজ করাচ্ছেন মালিকরা। 

কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার মের্সাস আশ্রাফ এন্ড ব্রিকসে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে  কাজ করা ১১ বছর বয়সের শিশু নাহিদ। নাহিদ বলেন, ‘ছয় মাসের কাজের চুক্তিতে এসেছি। চুক্তি ফুরালেই আবার বাড়িতে চলে যামুগা। পড়ালেখা করে কি লাভ ভাই? ভাত দিবো কেডা। বাবাডা মইরা গেছে। অ্যাইন আমার দুনিয়া মা ডা। ভাত খাইয়া এ ছয় মাসে সর্রদার থেকে ২০ হাজার টাকা পাইছি। আগামী  মাসে বাড়ি যামুগা।’

 

কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালের শিশু রোগ  বিশেষজ্ঞ ডা. নিলুফা আক্তার বলেন, ‘প্রতিটি ইট ভাটায় কর্মরত শিশুরা মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকে। ভাটায় দীর্ঘ সময় কাজ করার কারণে বিষাক্ত ধোঁয়া ও ধুলাবালিতে শিশুদের ত্বক ও নখ নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি রক্ত স্বল্পতা, এ্যাজমা, হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিস (শ্বাসনালীর ভিতরে আবৃত ঝিল্লিতে ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণ) রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। শিশুদের স্বাস্থ্য রক্ষায় সরকার ও ইট ভাটার মালিকদের এগিয়ে আসতে হবে।’

কুমিল্লা পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যালয়ের তথ্যমতে, জেলায় বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে ইটভাটার সংখ্যা ২৯১টি। অবৈধ রয়েছে ১২৫টি। পরিবেশের ছাড়পত্র নেই ৩৯ টির। তবে স্থানীয় হিসাবে জেলায় বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে প্রায় ১০০টি ইটভাটা ও পাঁজা আছে। প্রতিটি ইটভাটাতেই শিশুরা শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। এছাড়া জেলার সবগুলো ইটভাটার জিগজ্যাগ পদ্ধতি রয়েছে।

ঝুঁকিপূর্ণ এসব কাজে শিশুদের নিযুক্ত করার বিষয়ে কুমিল্লার ইটভাটা সমিতির সভাপতি এমরান হোসেন বলেন, ‘অধিকাংশ ইট ভাটাতেই শিশু শ্রমিক নেই, তবে কিছু শিশু আছে যারা তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে এখানে আসে। তাদের শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় না।

কুমিল্লা কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের উপ মহাপরিদর্শক প্রকৌশলী এম.এম. মামুন-অর-রশিদ বলেন, ‘আমরা কুমিল্লার যে সব ইটভাটায় শিশু শ্রমিক রয়েছে, সেই সব ভাটার মালিকদের নোটিশ করছি নিয়মিত। আমরা যখন ভাটা পরিদর্শনে যাই তখন কোনো শিশু শ্রমিক দেখি না।’

কুমিল্লা পরিবেশ অধিদপ্তরে উপ-পরিচালক মোসাব্বের হোসেন মুহাম্মদ রাজীব বলেন, ‘কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর এবং কুমিল্লা জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব বিষয়টি দেখা। তারপরও আমরা ইট ভাটা সমিতির নেতাদের বলছি ,যেন  শিশু শ্রমিক না রাখে ভাটাগুলোতে ‘

কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘আমরা কুমিল্লা কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের কাছে কুমিল্লা জেলার শিশু শ্রমিকদের তালিকা চেয়েছি। তারা আমাদের এখনো  তালিকা দেয়নি। মূলত এটি পরিবেশ অধিদপ্তর ও কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের দায়িত্ব। তবে যেসব ভাটা শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিযুক্ত করছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

মাসুদ

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়