ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

‘শেষ আশ্রয়টুকুও কেড়ে নিচ্ছে নাইন্দা নদী’

মনোয়ার চৌধুরী, সুনামগঞ্জ  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:০৮, ৩১ মে ২০২৩  
‘শেষ আশ্রয়টুকুও কেড়ে নিচ্ছে নাইন্দা নদী’

নাইন্দা নদীর ভাঙনে নিঃস্ব হয়েছেন সদরপুর গ্রামের অনেক বাসিন্দা

সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা আব্দুল আওয়াল। বর্তমানে তার বয়স ৮৫ বছর।  স্ত্রী, এক ছেলে ও তিন মেয়ে এবং ছেলের বউ নাতি-নাতনি নিয়ে ৯ সদস্যের পরিবার এই প্রবীণের। এক সময়ের তার সেই সুখের সংসার এখন নদী ভাঙনের কবলে। বৃদ্ধ বয়েসে এখন তাকে নাইন্দা নদীর তীরে বসে অনিশ্চয়তার দিন গুণতে হচ্ছে। উপজেলার সদরপুর গ্রামের বাসিন্দারা জানান, নদী ভাঙন রোধে এখনই ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। আর তা না হলে এবারের বর্ষা এবং বন্যা দেখা দিলে প্রকট আকার ধারণ করবে এই নদীর ভাঙন।  

মঙ্গলবার (৩০ মে) আব্দুল আওয়াল রাইজিংবিডিকে জানান, তার জায়গা জমি যা ছিল সব নাইন্দা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এখন শেষ আশ্রয় ভিটেবাড়িও নদী গর্ভে চলে যেতে শুরু করেছে। অন্য কোথাও জমি না থাকায় বাধ্য হয়েই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এখানে থাকতে হচ্ছে তাকে। 

তিনি বলেন, ‘২০০৪ সালের বন্যা থাইক্কা (থেকে) নদী কিছু কিছু ভাঙছে। আর গতবারের বন্যায় (২০২২ সাল) একবারে বাড়ি ঘর সবটা ভাইঙ্গা (ভেঙে) লুইয়া গেছেগি। এখন আর থাকার মত না। আমরা এখন নদী ভাঙনের পাড়ে আছি। নদী ভাঙনে ঘরের অর্ধকে ভাইঙা লুইয়া গেছেগি। বাকি অর্ধেককানে আছি। বাচ্চা নিয়ে খুবই বিপদজনক অবস্থায় আছি। তারারে (বাচ্চাদের) সব সময় দেখে দেখে রাখা লাগে। আমার এই জায়াগা ছাড়া আর অন্য জায়গা জমি নেই। জায়গা জমি থাকলে আমরা বিপদের হাত থেকে জাইতাম গি। আমরা নদীর ভাঙনের অবস্থায়ই ঘরের মাঝে আছি, কোন সময় জানি নদী ভাঙনে আমরার ঘুমের অবস্থায় ঘর নিয়া যায় আমরা সেই আতঙ্কে।শেষ আশ্রয়টুকুও কেড়ে নিচ্ছে এই নদী’

সরেজমিনে সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার সদরপুর গ্রামে গেলে স্থানীয় মুরুব্বিরা জানান, পূর্বে এই নাইন্দা নদীটি ছিলো মাত্র ৫০ ফুট প্রস্থ। তবে ২০০৪ সালের বন্যা থেকে ভাঙন শুরু হয়েছে। দুই পাড় ভাঙনে ধিরে ধিরে বেড়ে যায় নদীর প্রস্থ। তখন ভাঙন রোধে প্রশাসন, জনপ্রতিনিধিদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও কোনো প্রতিকার পাননি নদী পাড়ের লোকজন। পরে গেলো বন্যা থেকে আরো বড় আকারে নদী ভাঙন চলছে। ভাঙনের ফলে বর্তমানে এই নদীর প্রস্থ প্রায় ৪০০ ফুটে দাঁড়িয়েছে বলে দাবি স্থানীয়দের।

নদীর ভাঙনের শিকার হয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন গ্রামের অনেকেই। নদী পাড়ের বাসিন্দা সোমতি রাণী দেব রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘বন্যায় আমরার বাড়ি ঘর সব নিয়ে গেছেগি। আমরা মেইল (প্রধান) রোডে ছিলাম ২২দিন। তখন সারা ঘর নিয়ে গেছে। একটা রুম ছিলো, ওই রুমে আইছিলাম পরে ঘুমের মাঝে (নদী ভাঙনে) সেই রুমটা লুইয়া গেছেগি। দুইটা বাইচ্চা লুইয়া (এখন) অন্যজনের বাড়িতে থাকি। আমারে এখনও সরকারে মেম্বারে সায় সাহায্য করলো না।’

তীব্র ভাঙনের কবলে পড়েছে গ্রামের মোহাম্মদ কবির হোসেনের বাড়িঘর। তিনি বলেন, ‘বড় বন্যার পর থেকে এখন পর্যন্ত নদী ভাঙন চলতে আছে। এখানে অনেক ফ্যামেলি ছিলাম, অনেকেই বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নিছে। আমরার আত্মীয় নাই বলে এখনো ভাঙনের পাড়ে আছি। ভয়ঙ্কর ভয় লাগে রাতে, মাঠি ভাঙ্গার পরে (ঘরের মাঠি নদীতে ভেঙে পড়লে) ভিটামাঠিসহ কাপতে শুরু হয়। বাচ্চাদের নিয়ে বড় চিন্তায় আছি, কোথায় যাবো কি করবো? বাড়ির জায়গা নাই, নিজের জমি জায়গাও নেই, দিনমুজর হিসেবে কাজ করি। প্রধানমন্ত্রী কাছে আমাদের ভিটামাঠি দেওয়ার জন্য দাবি জানাই।’

মোহাম্মদ শাহিন আলম নামের অপর একজন শুনালেন তার অসহায়ত্বের কথা। বর্তমান নাইন্দা নদের ঠিক মধ্যে খানেই ছিলো তাদের মূল বসতঘর। সব কিছু নদে বিলীন হওয়ায় মানবেতর জীবন কাটছে তার। তিনি বলেন, ‘আমরার ঘরটা নদীর ঠিক মাঝ বরাবর আছিলো। ভাঙনের কারণে এখন পিছাইতে পিছাইতে সামান্য একটুক জায়গায় কুড়ে ঘরের মত করে আছি।’

সদরপুরের নদী ভাঙন প্রতিরোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড কখনো কোনো কার্যক্রর্ম হাতে নিতে দেখছেন কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, তারা (পানি উন্নয়ন বোর্ড) এখন পর্যন্ত আইছেই না। তাদের মাথা ব্যথা নাই। প্রথম থেকে এখন পর্যন্ত কোনো কর্মকর্তা আমাদের ভালা মন্দ কিছু জিগাইছেই না।  এখন আর কিতা করমু আমরা। আমরার তো আর্থিক সম্বল নাই, আমি একটু জায়গা কিনে থাকতাম। এখন আমি থাকতে হইলে, ইকানো কুড়ে ঘরে থাকতে হইবো। এরপরেও যদি এখান ও ভাইঙ্গা নিয়া যায় কিতা আর করমু। আমরার তো কোন তা (কিছু) করার নাই। যদি আমরা দেশের নাগরিক হইতাম তাইলে অন্তত পক্ষে গ্রামের মেম্বার আছে চেয়ারম্যান আছে এরারে যে ভোট দিয়া পাস করাইছি এরা তো আমরারে মুখের শান্তনা দিতে পারতো।’ 

নদী ভাঙনে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে জানিয়ে শান্তিগঞ্জ উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান প্রভাষক নূর হোসেন বলেন, ‘ভাঙন কবলিত এরাকার মানুষরা অন্যের বড়িঘরে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের নিজস্ব কোনো জায়গা নেই। আমরা এই নদী ভাঙন এলাকা কয়েকবার পরিদর্শন করেছি, কিন্তু আমরা পরিদর্শন করলে কি হবে? আমরা এই বিষয়ে দায়ীত্বশীল ব্যক্তি না। আমরা জনপ্রতিনিধি, এই এলাকার জনগণ আমাদের কাছে এসে কাদে, দুঃখ করে। আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের দায়িত্বশীল ব্যক্তিকে বিষয়টি জানিয়েছি। বারবার বলেছি এখনও আমরা আবেদন করি। ভাঙন রোধে দ্রুত সময়ের মধ্যে ব্যবস্থা না করা হলে আরও অনেক মানুষ সম্বল হারাবেন।’

পানি উন্নয়ন বোর্ডের শান্তিগঞ্জ উপজেলা উপ-প্রকৌশলী মাহবুব আলম বলেন, ‘পানি উন্নয়ন বোর্ড গত কয়েক বছর ধরে নাইন্দা নদীর ভাঙন প্রতিরোধে বরাদ্দ চেয়ে আসছে। বরাদ্দ না আসায় নদী ভাঙন রোধে কাজ করতে পারছি না। বরাদ্দ পেলেই কাজ শুরু করবো।’ 

মাসুদ

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়