ঢাকা     সোমবার   ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ৩০ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

অস্তিত্ব সংকটে ডাকাতিয়া, হারিয়ে যাচ্ছে দেশীয় মাছ

জাহাঙ্গীর লিটন, লক্ষ্মীপুর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৫৯, ১৬ জুলাই ২০২৪   আপডেট: ১৪:৪০, ১৬ জুলাই ২০২৪
অস্তিত্ব সংকটে ডাকাতিয়া, হারিয়ে যাচ্ছে দেশীয় মাছ

ছবি: রাইজিংবিডি

লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বয়ে গেছে ডাকাতিয়া নদী। এটি মেঘনার উপনদী। নদীটি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে কুমিল্লা জেলার বাগসারা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। পরবর্তীতে চাঁদপুর ও লক্ষ্মীপুর জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। নদীটি লক্ষ্মীপুরের হাজিমারা পর্যন্ত বিস্তৃত।

এক সময়ের দূরন্ত এই তটিনী অবহেলা, দূষণ ও অবৈধ দখলের কারণে গতি হারিয়ে স্থবির হয়ে পড়েছে। লক্ষ্মীপুরের রায়পুর অংশে পুরো নদী এখন কচুরিপানায় আটকে পড়েছে। দুপাড়ের মানুষের ঘরগৃহস্থালীর সমস্ত ময়লা এখন এই নদীর বুকে জমে উঠে রীতিমতো ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। নদীর বেশ কিছু অংশের পানি খুবই দূষিত এবং দুর্গন্ধযুক্ত। নদী দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে পরিবেশের ওপরও। হারিয়ে যাচ্ছে দেশীয় নানা প্রজাতির মাছ।

আরো পড়ুন:

অন্যদিকে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন ও অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের অমীমাংসিত মালিকানার কারণে কুমিল্লা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত এই নদীর দুই তীর দখলের উৎসব চলছে। যত দিন যাচ্ছে, ডাকাতিয়া নদীর দুই তীরে অবৈধ স্থাপনা ততই বাড়ছে। এতে ক্রমেই থেমে যাচ্ছে ডাকাতিয়ার তর্জন-গর্জন আর জোয়ার-ভাটার প্রাবল্য।

এতে মারাত্মক পরিবেশ ও কৃষি বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরের লক্ষাধিক মানুষ। ডাকাতিয়া নদী রক্ষায় এখনই জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে জোর দাবি তুলছেন নদীপাড়ের সাধারণ মানুষ। সম্প্রতি ডাকাতিয়া নদীর রায়পুর পৌরসভার কিছু অংশের কচুরিপানা অপসারণ শুরু হয়েছে। স্থানীয় এমপি নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়নের উদ্যোগে এ কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।

১৯৬৮ সালে ৭০ কিলোমিটার দৈর্ঘের ডাকাতিয়া নদীর মধ্যে বাঁধ দিয়ে নির্মাণ করা হয় দেশের সর্ববৃহৎ সেচ প্রকল্প সিআইপি বেড়িবাঁধ। তখন থেকেই প্রাণ হারাতে শুরু করে খরস্রোতা ডাকাতিয়া। নদীর স্বাভাবিক জোয়ার-ভাটা বন্ধ হয়ে যায়। এ কারণে নদীতে বিভিন্ন প্রজাতির দেশি মাছ আজ অস্তিত্ব সংকটে। এছাড়া ধ্বংস হচ্ছে নদীর পরিবেশ। অভ্যন্তরীণ দখলের ফলে দিন দিন ছোট হয়ে আসছে নদীর প্রশস্ততা। ফলে এক সময়ের সৌভাগ্যের প্রতীক এ নদীটি এখন মৃত প্রায়।

স্থানীয়রা জানান, রায়পুরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া ডাকাতিয়া নদীটির দুই তীরে বর্তমানে দখলদারের সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। পরিবেশ দূষণের কারণে গত ৩০ বছরে নদীর বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় ৮০ ভাগ মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এক সময় এ নদীর মাছ বিক্রি করে দুই পাড়ের জেলে পরিবারগুলো তাদের সংসার চালাতেন। কিন্তু প্রভাবশালী দখলদারদের বাঁধের কারণে এখন তারা মাছ বিক্রি তো দূরের কথা, নদীতে নামতেও ভয় পান।

ডাকাতিয়া নদী দখলে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব খাটিয়ে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা একাট্টা হয়ে রায়পুর পৌরসভাসহ উপকূলীয় পাঁচটি ইউনিয়নের প্রায় ৫০ একর এলাকাজুড়ে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে বাঁধ নির্মাণের পাশাপাশি নদীর দুই পাড়ে সমানতালে স্থাপনা তৈরি করছে।

স্থানীয় কয়েকজন জেলে জানান, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা, ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বারসহ ১৫-২০ জন প্রভাবশালী ডাকাতিয়ায় বাঁধ ও দখল করছেন। এছাড়া নদীতে বাঁশের বেড়াসহ শক্ত বাঁধের কারণে বিশাল এলাকাজুড়ে কচুরিপানা জমে থাকায় নৌচলাচলও বন্ধ হয়ে গেছে।
স্থানীয় জেলে মাইনুদ্দিন বলেন, ‘ক্ষমতার দাপটে নেতারা ও চেয়ারম্যান নদীতে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করছেন। নদীর উপর নির্ভর করেই বাপ-দাদার আমল থেকে চলে আসছি, এখন নদীতে নামতেও পারি না। জীবনযাপনের জন্য বাধ্য হয়ে বিকল্প ব্যবসা খোঁজার কথা ভাবছি।’

নদী তীরবর্তী এলাকার বাসিন্দা এইচএম রনি বলেন, ‘আগে এই নদীতে আমরা গোসল করতাম, সাঁতার কাটতাম ও গৃহস্থালির নানা কাজে ব্যবহার করতাম। কিন্তু এখন গোসল করা তো দূরের কথা, এই পানি স্পর্শই করা যায় না। দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে আমাদের পরিবেশ ও জীবন-যাপনেও। নদীটিকে আগের রূপে ফিরিয়ে আনতে প্রশাসনকে এগিয়ে আসতে হবে।’

এদিকে দখলের কথা স্বীকার করে কয়েকজন স্থানীয় নেতৃবৃন্দ জানান, ডাকাতিয়া নদীতে এখন আর আগের মতো স্রোত না থাকায় পৌর এলাকাসহ কয়েকটি ইউপিতে স্থানীয়রা বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করছেন। সড়কপথ থাকায় নদীতে এখন আর নৌকার দরকার নেই বলেও তারা জানান।

স্থানীয় স্কুল প্রধান শিক্ষক তাজল ইসলাম জানান, গত কয়েক বছর ধরে সুপারির মৌসুমে ব্যবসায়ীরা হাজার হাজার কাহন পাকা সুপারি চার-পাঁচ মাস নদীতে ভিজিয়ে রাখেন। এতে সুপারির বাকল পচে দূষিত হচ্ছে নদীর পানি। ভরাট হয়ে যাওয়ায় শুষ্ক মৌসুম এবং বোরো মৌসুমে ডাকাতিয়া নদী পানিশূন্য হয়ে পড়ে। এক সময় এ নদীতে ইলিশ, চিংড়ি, বোয়াল, গজাল, শোলসহ অনেক ধরনের দেশি প্রজাতির মাছ পাওয়া যেতো। কিন্তু নদী ভরাট ও পানিদূষণের কারণে নদীতে আগের মতো আর মাছ পাওয়া যায় না। ময়লা-আবর্জনা নদীতে ফেলায় নদীতে জলজ জীব বসবাসের উপযোগিতা হারিয়ে ফেলছে।

অপর শিক্ষক  জাকির জানান, নদীর আশেপাশের কৃষিজমিতে প্রচুর পরিমাণ কীটনাশক ব্যবহারের কারণে নদীর পানির অণুজীবগুলো মরে যাচ্ছে। অপরিকল্পিতভাবে নদী থেকে বালু উত্তোলন, বাঁধ নির্মাণ, বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষ, নদী দখল ও ভরাট হয়ে যাওয়া, অধিক মাত্রায় মৎস্য আহরণসহ মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণে ডাকাতিয়া নদীর জীববৈচিত্র্য আজ হুমকির মুখে।

স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সবুজ বাংলাদেশের সহ-সভাপতি প্রফেসর মাহবুবুর রশিদ বলেন, ‘দখল, দূষণের কারণে হুমকির মুখে আছে ডাকাতিয়া নদী। এক শ্রেণির প্রভাবশালী লোকজন দখল করে ব্যক্তিগতভাবে মাছ চাষ করছে। বিষয়টি দ্রুত দখলমুক্ত করলে একদিকে স্থানীয়দের আমিষের চাহিদা মিটবে আবার অন্যদিকে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা পাবে। ডাকাতিয়া নদী বাঁচানোর জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হোক- এটা আমাদের জোর দাবি। পরিবেশ রক্ষা করতে হলেও নদীকে বাঁচাতেই হবে।’

রায়পুর পৌরসভার সাবেক মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল খোকন  বলেন, ‘একসময় মোস্তফা ব্যাপারী নামে এক ব্যক্তি মাছ চাষ করেছে। একটি চক্র ওই সময় আমার নামে অপপ্রচার চালিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আমি মেয়র থাকায় আর প্রতিবাদ করিনি। নদীটি মৎস্য চাষের জন্য মৎস্য মন্ত্রণালয় ও ভূমি মন্ত্রণালয় যৌথভাবে ইজারা দিয়েছে। এখনও কিছু কিছু জায়গায় মাছ চাষ করছে কেউ কেউ।’

রায়পুর পৌরসভার মেয়র গিয়াস উদ্দিন রুবেল ভাট বলেন, ‘দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে কচুরিপানায় পরিবেশ দূষণের কারণে নদীর বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় ৮০ ভাগ মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কুকুর ও বিভিন্ন প্রাণি মেরে নদীতে ফেলে দেয়া ও কচুরিপানার দুর্গন্ধে পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেছে। সেই দিক বিবেচনা করে পৌরসভার উদ্যোগে প্রকল্পের মাধ্যমে কচুরীপানা পরিস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে করে নদীর মাছ বিক্রি করে দুই পাড়ের জেলে পরিবারগুলো তাদের সংসার চালাতে পারবে।’

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘নদীতে থাকা কচুরিপানা দেশীয় মাছের জন্য কোনো সমস্যা না। যদি তা পচে যায় তাহলে মাছের ক্ষতি হয়।’

রায়পুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইমরান খাঁন জানান, ডাকাতিয়া নদী রক্ষার্থে শিগগিরই বাঁধ উচ্ছেদ অভিযান চলবে।

লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক সুরাইয়া জাহান বলেন, ‘বিষয়টি আমরা অবগত রয়েছি। যারা ব্যারিকেড দিয়ে মাছ চাষ করছে, সেই বাঁধগুলো ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এখন স্থানীয় সংসদ সদস্য, জনপ্রতিনিধিসহ সবাই যেহেতু এগিয়ে এসেছেন, তাই নদী রক্ষা করতে আমাদের সুবিধা হবে। এ নিয়ে প্রশাসন খুবই গুরুত্বসহকারে কাজ করবে।’

/সনি/

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়