ঢাকা     শুক্রবার   ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ২০ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

রাজশাহীর সেই পাহাড়িয়াদের কথা শুনলেন মানবাধিকারকর্মীরা

রাজশাহী প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:২২, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫   আপডেট: ১৪:৩৩, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫
রাজশাহীর সেই পাহাড়িয়াদের কথা শুনলেন মানবাধিকারকর্মীরা

রাজশাহীর মোল্লাপাড়ার পাহাড়িয়া মহল্লায় গিয়ে সেখান থেকে উচ্ছেদের চেষ্টা করা বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলেছেন মানবাধিকারকর্মীরা। তারা পাহাড়িয়াদের আশ্বস্ত করে বলেছেন, সারা দেশ তাদের সঙ্গে আছে। তারা যেন ভয় না পান। অর্ধশতাব্দি ধরে বসবাস করে তারা এখানে থাকার অধিকার অর্জন করেছেন। 

সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে মানবাধিকারকর্মীরা সমতলের আদিবাসীদের জন্য স্বাধীন ভূমি কমিশন গঠনের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে তাগিদ দিয়েছেন।

আরো পড়ুন:

আরো পড়ুন: খাইয়ে-দাইয়ে ১৬ ‘পাহাড়িয়া’ পরিবারকে হাসি মুখে উচ্ছেদ

রবিবার (৭ সেপ্টেম্বর) সকালে ঢাকা থেকে রাজশাহীর এই মহল্লায় আসেন চর্চা ডটকমের সম্পাদক সোহরাব হাসান, নাগরিক উদ্যোগের নির্বাহী পরিচালক জাকির হোসেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য দীপায়ন খীসা, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) প্রধান কার্যালয়ের প্রতিনিধি মিনহাজুল কাদির ও গ্রিন ভয়েসের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আহসান হাবিব।

তাদের সঙ্গে ছিলেন ব্লাস্টের রাজশাহীর সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট সামিনা বেগম, সেন্টার ফর ক্যাপাসিটি বিল্ডিং অব ভলান্টারি অর্গানাইজেশনের (সিসিবিভিও) সমন্বয়কারী আরিফ ইথার, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের নেতা সূভাষ চন্দ্র হেমব্রম ও আদিবাসী ছাত্র পরিষদের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দপ্তর সম্পাদক পলাশ কুমার মাহাতো। 

তারা পাহাড়িয়াদের সর্দার বাবুল বিশ্বাসের কাছ থেকে সবকিছু শোনেন। বাবুল জানান, ভয়ে তিনিই প্রথম ঘর ভাঙেন। পরে তারা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে যান। তবে জেলা প্রশাসক না থাকায় তাদের দেখা হয়নি।

এর আগে, মহল্লায় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে নাগরিক উদ্যোগের নির্বাহী পরিচালক জাকির হোসেন বলেন, “এই পাহাড়িয়া সম্প্রদায়ের মানুষগুলো এখানেই জন্ম নিয়েছেন। তাদের বাপ-দাদার এখানেই মৃত্যু হয়েছে। একটা আইন আছে, যারা দীর্ঘ সময় ধরে একস্থানে বাস করেন, সেখানে তাদের অধিকার জন্মায়। হঠাৎ করে কেউ একজন এসে বলছে, এ জামির মালিক তিনি। এটা দেখে আমরা বিভিন্ন জায়গায় কথা বলেছি। এখানে এসেছি সংহতি প্রকাশ করতে যে- পাহাড়িয়া সম্প্রদায়ের মানুষগুলো একা নয়, আমরা তাদের সঙ্গে আছি।”

তিনি বলেন, ‘সাজ্জাদ আলী নাকি ১৯৯৪ সালে এই জমি কিনেছেন, আগে তো তিনি দাবি করেননি। হঠাৎ করে কেন? আমাদের কথা হচ্ছে, মানবিক দৃষ্টিতে দেখতে হবে। কেউ একজন এসে মালিকানা দাবি করবেন, এটা হয় না। আমাদের মনে হচ্ছে, যিনি দাবি করছেন তিনি আসল মালিক নন। যিনি আসল মালিক ছিলেন, তার কাউকেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সাজ্জাদ কি করে এতদিন পর এসে দাবি করেন? আসল মালিক যদি জমি ছেড়ে চলে যান, তাহলে এটা সরকারি হবে। এটার পাশে বড় সরকারি রাস্তা আছে। এখন প্রভাবশালীর চোখ পড়েছে। আমরা চাই, এদের নামে জমিটা রেকর্ড করে দেওয়া হোক।”

সমতলের আদিবাসীদের জন্য ভূমি কমিশন গঠনের দাবি জানিয়ে তিনি আরো বলেন, “সমতলের আদিবাসীদের জন্য একটা ভূমি কমিশন দরকার। এটার পক্ষে সবার জোরালো সমর্থন আছে, কিন্তু হচ্ছে না। সরকার বিভিন্ন কমিশন করেছে, কিন্তু আমরা উত্তরবঙ্গের আদিবাসীর কোনো প্রতিনিধিত্ব বা কোনো কমিশনেই দেখলাম না। সরকারের কাছে দাবি জানাই, দ্রুত কমিশন এবং আদিবাসীদের একটা তালিকা হোক।”

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য দীপায়ন খীসা বলেন, “এই পরিবারগুলো স্বাধীনতার পর থেকেই এখানে আছেন। কেউ তাদেরকে উচ্ছেদ করেনি। কয়েকদিন আগে দেখলাম, এক ব্যক্তি খাসি খাইয়ে তাদের বিদায় জানাচ্ছেন। এটা নিয়ে আন্দোলন গড়ে উঠেছে। আমরা তাদের সংহতি জানাতে এসেছি। যেখানে স্বাধীনতার পর থেকে কেউ তাদের উচ্ছেদ করেনি, এখন এসে কেন তাদের উচ্ছেদ করতে হবে? সরকার বারবার বলছে, সবাইকে অন্তর্ভুক্তি করেই চলবে, তাহলে এই কয়েকটা পরিবারকে অন্তর্ভুক্তি করতে সমস্যা কি? আমাদের কথা হচ্ছে, যারা স্বাধীনতার পর থেকে বাস করছে, এই সময়ে এসে কেন তাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে? কাজেই দ্রুত ভূমিদস্যুকে গ্রেপ্তার করতে হবে। এখানে ছোট একটা পুলিশ ফাঁড়ি হতে পারে, যাতে এখানকার বাসিন্দাদের নিরাপত্তা থাকে।”

ব্লাস্টের সমন্বয়কারী সামিনা বেগম বলেন, “ভূমি কমিশন যতক্ষণ না করতে পারছি, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা আদিবাসীদের ভূমির নিশ্চয়তা দিতে পারছি না। ভূমি কমিশন হলে আমরা কাজ করতে পারি। এটা যত দ্রুত সম্ভব করতে হবে। এখন প্রশাসন যেন এদের নিরাপত্তাসহ বসবাসের সুযোগের দিকে খেয়াল রাখে। আমরা এটা আইনিভাবেই মোকাবিল করব।”

সিসিবিভিও’র সমন্বয়কারী আরিফ ইথারও সমতলের আদিবাসীদের জন্য ভূমি কমিশন গঠনের দাবি জানান। তিনি বলেন, “এটা দ্রুতই করতে হবে। তা না হলে আদিবাসীদের ভূমির নিরাপত্তা কঠিন হয়ে যাবে। দীর্ঘ সময় ধরে এই সমস্যা নিয়েই তাদের জীবন পার করতে হচ্ছে।”

রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ২ নম্বর ওয়ার্ডের মোল্লাপাড়ায় মুক্তিযুদ্ধের পর ছয়টি পাহাড়িয়া পরিবার বাড়ি করার সুযোগ পায়। তিন প্রজন্মে এখন বাড়ি হয়েছে ১৬টি। এতদিন পর সাজ্জাদ আলী নামের এক ব্যক্তি এই ১৬ কাঠা জমির মালিকানা দাবি করছেন।

তিনি ১৬ পরিবারকে ৩০ লাখ টাকা দিয়ে উচ্ছেদের আয়োজন করেছিলেন। তিনটি পরিবার কয়েকদিন আগেই বাড়ি ছাড়ে। গত শুক্রবার সেখানে খাসি কেটে খাইয়ে-দাইয়ে তাদের ‘বিদায়ের’ আয়োজন ছিল। রবিবার (৭ সেপ্টেম্বর) ঘর ছাড়তে হতো বাকিদের। এ নিয়ে গত বুধবার গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়। এরপর তোলপাড় শুরু হয়। ভেস্তে যায় খাসি ভোজের আয়োজন।

পরদিন বৃহস্পতিবারই পুলিশ-প্রশাসন তৎপর হয়ে ওঠে। গত শুক্রবার সকালে ওই মহল্লায় যান আদিবাসী সংগঠনের নেতাকর্মী, মানবাধিকারকর্মী, শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও উন্নয়নকর্মীরা। সেখানে তারা মানববন্ধন করেন। খোঁজ নেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও। লন্ডন থেকে তিনি দলীয় নেতাকর্মীদের ফোন করে বিকেলে ওই মহল্লায় পাঠান।

এই পাহাড়িয়াদের বসতবাড়ি রক্ষার দাবিতে শনিবার বিকেলে সেখানে গিয়ে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন করেন ছাত্রদল ও যুবদলের নেতাকর্মীরা। তারা মানববন্ধনও করেন। একই সময় সাহেববাজার জিরোপয়েন্টে মানববন্ধন করে বাম গণতান্ত্রিক জোট, রাজশাহী। এর আগে সকালে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে জাতীয় আদিবাসী পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠন।

ঢাকা/কেয়া/মাসুদ

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়