চাঁপাইনবাবগঞ্জে অবাধে প্লাস্টিকের বস্তায় চাল বাজারজাত
মেহেদী হাসান শিয়াম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ || রাইজিংবিডি.কম
চাঁপাইনবাবগঞ্জে অবাধে নিষিদ্ধ প্লাস্টিকের বস্তায় চাল বাজারজাত করা হচ্ছে।
পাটজাত বস্তায় চাল বিক্রির নিয়ম থাকলেও তা মানছেন না চাঁপাইনবাবগঞ্জের চালকল মালিকরা। আইন অমান্য করে নিষিদ্ধ প্লাস্টিকের বস্তায় চাল বাজারজাত করছেন তারা। এতে পরিবেশ দূষণ ও স্বাস্থ্যঝুঁকির শঙ্কা বেড়ে চলেছে। এমন পরিস্থিতিতে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে দায় সারছে পাট উন্নয়ন অধিদপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, পাটের বস্তায় চাল বাজারজাত করলে একদিকে যেমন পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকবে, তেমন কৃষকরা কাঙ্ক্ষিত দাম পেয়ে পাট চাষাবাদে উদ্বুদ্ধ হবে।
২০১০ সালে ৭ অক্টোবর ‘পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক আইন’- করে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। এতে ধান ও চাল বিপণনে পাটের বস্তা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়। এই আইন প্রণয়নের পর দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও চাঁপাইনবাবগঞ্জে তেমন প্রয়োগ নেই। অথচ এ জেলার দুই শতাধিক চালকলে দৈনিক হাজার-হাজার মেট্রিক টন চাল বস্তায় ভরে বাজারজাত করা হচ্ছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর, গোমস্তাপুর ও নাচোল উপজেলায় প্রায় দুই শতাধিক চালকল রয়েছে। এর মধ্যে ৮৬টি স্বয়ংক্রীয় চালকল (অটো রাইসমিল), ২০টি বয়েল আর বাকিগুলো আতব চালের কল। এ সব চালকলে দৈনিক গড়ে ১৭ হাজার মেট্রিকটন চাল উৎপাদন করে বস্তায় মোড়কীকরণ করা হয়। পরে এই চাল বিক্রি হয় দেশের বিভিন্ন বাজারে।
সরেজমিনে দেখা যায়, বেশিরভাগ রাইস মিলে চালের মোড়কীকরণে প্লাস্টিকের বস্তার ব্যবহার হচ্ছে। কয়েকটি চালকলে কিছু পাটের বস্তায় চাল বাজারজাত করতে দেখা গেছে। জেলা পাট উন্নয়ন অফিসের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত ১৫ মাসে প্লাস্টিক বস্তার বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাত্র ৯টি অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। এতে ১০টি মামলায় ৭৯ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, পাট উন্নয়ন কর্মকর্তা বড় বড় চালকল মালিকদের ছেড়ে ছোট চালকল মালিকদের প্রতিষ্ঠানে অভিযান পরিচালনা করে।
অভিযানের পাশাপাশি পণ্যে পাটজাত মোড়ক বিষয়ে প্রচারণা চালিয়েছে বলে দাবি করছে সরকারি এ প্রতিষ্ঠানটি। যদিও পাট উন্নয়ন কর্মকর্তার এমন দাবি দৃশ্যমান নয়।
চালকল মালিকরা সরাসরি এ সব বিষয়ে কথা বলতে আগ্রহী নয়। তবে তাদের দাবি প্যাকেজিং খরচ কমাতে প্লাস্টিকের বস্তায় চাল বাজারজাত করা হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক চালকল মালিক জানান, ৫০ কেজির একটি পাটের বস্তার দাম রকমভেদে ৫০ থেকে ৫৭ টাকা। সেখানে সর্বোচ্চ ২৫-৩০ টাকায় একটি প্লাস্টিকের বস্তা পাওয়া যায়। সেই কারণে ব্যবসায়ীরা প্লাস্টিকের বস্তায় চাল বিক্রি করছেন।
প্লাস্টিকে পরিবেশ বিপন্ন হওয়ার বিষয়ে জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আবু সাঈদ বলেন, ‘‘প্লাস্টিক পরিবেশ এবং জীবজগতের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। প্লাস্টিক হাজার বছর ধরে পরিবেশে থেকে মাটি ও পানি দূষিত করে। এটি সামুদ্রিক প্রাণীদের জীবন কেড়ে নেয়।’’
প্লাস্টিকে মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে উল্লেখ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. এ কে এম শাহাব উদ্দিন বলেন, ‘‘প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা ও বিষাক্ত রাসায়নিক খাদ্য ও পানির মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে। যা হরমোনজনিত সমস্যা ও ক্যান্সারের মতো গুরুতর রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। এটি মাইক্রোপ্লাস্টিক হিসেবে আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষে পৌঁছাতে পারে।’’
অভিযোগের বিষয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেলা অতিরিক্ত পাট উন্নয়ন কর্মকর্তা অজিত কুমার রায় বলেন, ‘‘প্লাস্টিকের বস্তায় চাল বাজারজাত আইনের লঙ্ঘন। এসবের বিরুদ্ধে প্রতি মাসেই বিভিন্ন চালকলে অভিযান পরিচালনা করা হয়। আগের তুলনায় আমাদের অভিযান বেড়েছে।’’
নিজেদের সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করে তিনি আরো বলেন, ‘‘অভিযান না করার জন্য মাঝে-মধ্যে বিভিন্ন কারণে আমাদের নির্দেশনাও আসে। অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে আমরা যে স্বাধীন; তাও না। আমাদের কিছু প্রতিবদ্ধকতাও আছে। এর মধ্যেও আমরা চালকলে প্লাস্টিকের বস্তাবিরোধী অভিযান পরিচালনা করে থাকি। আমাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ রয়েছে এ সব ভিত্তিহীন।’’
প্লাস্টিকের বস্তা ব্যবহারে চালকল মালিকদের বেশি খরচের অজুহাতের বিষয়ে জেলা অতিরিক্ত পাট উন্নয়ন কর্মকর্তা বলেন, ‘‘চালকল মালিকরা খরচের যে অজুহাত তুলছেন, এটা খুবই অযৌক্তিক। কারণ পাটের বস্তার ওজন ৩৬০ গ্রামসহ ৫০ কেজির বস্তা প্যাকিং করে বাজারজাত করা হয়। এতে চালকল মালিকদের তেমন আর্থিক ক্ষতি হয় না।’’
সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আনিসুর রহমান বলেন, ‘‘প্লাস্টিকের বস্তায় চাল বিক্রির বিরুদ্ধে আমরা অভিযানে যাব। এর আগেও চালকল মালিকদের অনেক বোঝানো হয়েছে, এবারও তাই করা হবে। এতেও তারা আইন মানতে নারাজ হলে আমরা অভিযান চালাব। এমন অভিযান দু-এক দিনের মধ্যে শুরু হতে পারে।’’
ঢাকা/বকুল