মানিকগঞ্জে ঐতিহ্যবাহী হাজল মেলা
মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম
গ্রামীণ জীবনের সঙ্গী ছিল দেশি মুরগি পালন। উঠোনে হাঁস-মুরগি দৌড়ে বেড়াত, ডিম ফুটিয়ে নতুন বাচ্চা তোলার দৃশ্য ছিল প্রতিটি গ্রামের সাধারণ চিত্র। আর এ প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মাধ্যম ছিল হাজল বা এঁটেল মাটির তৈরি বিশেষ পাত্র। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যেতে বসা এই ঐতিহ্যকে নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে মানিকগঞ্জের কৃষাণীরা আয়োজন করলেন হাজল মেলা।
সোমবার (৮ সেপ্টেম্বর) দুপুরে সদর উপজেলার পুটাইল ইউনিয়নের মান্তা মধ্যেপাড়া গ্রামে বারসিকের উদ্যোগে দিনব্যাপী এই মেলা বসে। দুই শতাধিক কৃষক-কৃষাণীর অংশগ্রহণে হাজল ও পরিবেশবান্ধব চুলা প্রদর্শনী পরিণত হয় গ্রামের এক ব্যতিক্রমী উৎসবে।
মেলায় হাজল তৈরির হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেন আদর্শ কৃষাণী রেনু বেগম। তিনি বলেন, “হাজল ব্যবহারে শতভাগ ডিম ফুটানো সম্ভব হয়। মুরগিকে বাইরে খাবার খুঁজতে যেতে হয় না। ফলে ডিমও নষ্ট হয় না, বাচ্চাও ভালোভাবে বেড়ে ওঠে।”
উপস্থিত নারীরা জানান, তারা আবারো বাড়িতে হাজল তৈরির উদ্যোগ নেবেন। এতে শুধু পরিবারে দেশি মুরগি সংরক্ষণই নয়, বাড়তি আয়েরও সুযোগ তৈরি হবে।
মেলায় অংশ নেওয়া কৃষাণীরা বলেন, হাজল শুধু একটি পাত্র নয়, বরং গ্রামীণ সংস্কৃতির টুকরো ইতিহাস। তাদের দাদী-নানীরা হাজল ব্যবহার করতেন। আজ আবার সেই পুরোনো দিন ফিরে আসছে। এতে শুধু ঐতিহ্য রক্ষা নয়, তাদের সংসারেও সুবিধা হবে।
হাজলের পাশাপাশি প্রদর্শিত হয় নানা ধরনের পরিবেশবান্ধব চুলা। কৃষাণীরা ছাবনা চুলা, পদ্ম চুলা, তিন তালা চুলা, তিন ঝিক চুলা, বন্ধু চুলা, ঝিকছাড়া চুলা ও খেলনা চুলা নিয়ে এসেছিলেন। এসব চুলা শুধু ধোঁয়া কমায় না, জ্বালানি সাশ্রয় করে এবং চোখের ক্ষতি কমায়।
মেলার আলোচনায় বক্তব্য দেন মান্তা নারী সংগঠনের সভাপতি রেনু বেগম, সহ-সভাপতি বিউটি আক্তার, বারসিকের কর্মকর্তা সুবীর কুমার সরকার, শ্যাময়েল হাসদা ও আলপনা রানী সরকার।
আলপনা রানী বলেন, “হাজল ও পরিবেশবান্ধব চুলা শুধু ঐতিহ্যের পুনর্জাগরণ নয়, এটি গ্রামীণ জীবনের টেকসই উন্নয়নের হাতিয়ার। আজ আধুনিক ইনকিউবেটর হাজলকে অনেকটা আড়ালে সরিয়ে দিলেও, এই ঐতিহ্য আবারো ফিরে আসছে নারীদের হাত ধরে। হাজল মেলা যেন গ্রামীণ জীবনের হারানো ইতিহাসকে আবারো জীবন্ত করে তুলল।”
বিউটি আক্তার বলেন, “গ্রামীণ সমাজে হাজল শুধু ডিম ফোটানোর পাত্রই নয়, বরং এটি ছিল নারীর সৃজনশীলতার পরিচয়। অনেক গ্রামে প্রবাদ ছিল- ‘হাজল আছে ঘরে, অভাব যাবে দূরে।’ কারণ হাজল থাকলে দেশি মুরগির বংশবিস্তার হত সহজে, যা পরিবারে বাড়তি খাদ্য ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দিত।”
ঢাকা/জাহিদুল/মেহেদী