লালমনিরহাট স্টেশনের পরিচ্ছন্ন সামগ্রী নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ
লালমনিরহাট সংবাদদাতা || রাইজিংবিডি.কম
অফিস সহকারী নুরুজ্জামান সরকার সোহেল
রেলওয়ের স্টেশনগুলো পরিচ্ছন্ন রাখতে ঝাড়ুসহ পরিষ্কার সামগ্রী কেনার চার মাসের অর্থ আত্নসাতের অভিযোগ উঠেছে লালমনিরহাট রেলওয়ের বিভাগীয় বাণিজ্যিক পরিবহন কর্মকর্তার কার্যালয়ের অফিস সহকারী (বড় বাবু) নুরুজ্জামান সরকার সোহেলের বিরুদ্ধে।
জানা গেছে, বাংলাদেশ রেলওয়ের একটি বিভাগ লালমনিরহাট। এ বিভাগীয় রেলওয়ের স্টেশনগুলো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে সরকারি ও বেসরকারি দুইভাবে পরিচ্ছন্নকর্মীসহ পরিষ্কারক সামগ্রী সরবরাহ করা হয়। বেসরকারিভাবে পরিচ্ছন্নকর্মী ও পরিষ্কারক সামগ্রী সরবরাহ করতে প্রতি দুই বছর পর দরপত্রের মাধ্যমে ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়। গত দুই অর্থ বছরে লালমনিরহাট বিভাগীয় রেলের ১৪টি স্টেশনে এসব সরবরাহের কাজ পান ক্লিন সার্ভিস নামের একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান।
চুক্তি মতে, প্রতি স্টেশনে একজন পরিচ্ছন্নকর্মী ও প্রয়োজনীয় পরিষ্কারক সরবরাহ করবেন। পরিষ্কারকের মধ্যে রয়েছে, হারপিক, সাবান, লাইজল, ফুল ঝাড়ু, কাঠের ঝাড়ু, ফেসিয়াল টিস্যু, টয়লেট টিস্যু, এয়ার ফ্রেশনার, এডোনিল, ড্যামফিক্স, হ্যান্ডওয়াশ, টয়লেট ব্রাশ, বেলচা, অ্যারোসল, মপ, ফিক্সল ও বালতি। ১৪টি স্টেশন শুধু পরিষ্কার বাবদ প্রতিমাসে বিল ধরা হয়েছে দুই লাখ ৪৫ হাজার টাকা।
বেসরকারিভাবে পরিচালিত স্টেশনগুলো হলো- আদিতমারী, কাকিনা, হাতীবান্ধা, পাটগ্রাম, বুড়িমারী, কাউনিয়া, গাইবান্ধা, বোনারপাড়া, বগুড়া, দিনাজপুর, সেতাবগঞ্জ, পীরগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়।
নিয়ম অনুযায়ী ঠিকাদার এসব পরিষ্কারক সামগ্রী স্টোরকিপারের কাছে বুঝে দেবেন। তিনি তা বুঝে নিয়ে স্টেশনগুলো সমহারে বণ্টন করবেন। আর এ বিভাগের স্টোরকিপারের দায়িত্বে রয়েছেন লালমনিরহাট বিভাগীয় বাণিজ্য পরিবহন কর্মকর্তার কার্যালয়ের অফিস সহকারী (বড় বাবু) নুরুজ্জামান সরকার সোহেল।
গত অর্থ বছরের মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত বেসরকারিভাবে পরিচালিত ১৪টি স্টেশনে পরিচ্ছন্নকর্মীদের বেতন প্রদান করা হলেও কোন পরিষ্কারক সামগ্রী প্রদান করা হয়নি। বলা হয়েছে, নিজের মত করে সামগ্রী ক্রয় করে স্টেশন পরিষ্কার করতে। জুনের শেষে বিল তুলে সমন্বয় করা হবে। এজন্য পণ্য না দিয়েও স্টেশন মাস্টারদের কাছ থেকে প্রত্যয়ন সংগ্রহ করেন অফিস সহকারী সোহেল। এ প্রত্যয়ন সংগ্রহ করে ঠিকাদারের কাছ থেকে বিল উত্তোলন করা হয়।
এমন অনিয়মের কারণে চলতি অর্থ বছরে কোন ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়নি। সবগুলো স্টেশন সরকারিভাবে সরবরাহ করা প্রক্রিয়া হাতে নিয়েছে রেলভবন। সেই প্রক্রিয়াও সম্পন্ন না হওয়ায় গত তিন মাস ধরে বেতন পাচ্ছেন না পরিচ্ছন্নকর্মীরা। পরিষ্কারক সামগ্রী দেওয়া হলেও তা নামমাত্র। দুই স্টেশন মিলে একটা ঝাড়ু বা একটা হারপিকের বোতল। যা দিয়ে একটা স্টেশন এক দিনও পরিচ্ছন্ন রাখা সম্ভব নয়। ফলে নোংরা আবর্জনায় পড়ে থাকছে রেলওয়ে স্টেশনগুলো। এ কারণে দ্রুত নীতিমালা প্রণয়ন করে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি সংশ্লিষ্টদের।
স্টেশনগুলো সরেজমিনে গিয়ে নোংরা অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ দেখে কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্টদের সাথে যোগাযোগ করলে ঝাড়ুসহ পরিষ্কারক সামগ্রীর টাকা লোপাটের তথ্য বেরিয়ে আসে। স্টোরকিপার ও ঠিকাদারের দিকে অভিযোগের তীর ছোড়েন স্টেশন মাস্টারসহ সংশ্লিষ্টরা।
বুড়িমারী স্টেশনের কর্মচারী জুয়েল ইসলাম বলেন, “আমি পাটগ্রাম ও বুড়িমারী স্টেশনের জন্য পরিষ্কারক সামগ্রী নিতে গেলে স্টোরকিপার দুই স্টেশন মিলে মাত্র একটি ঝাড়ু ও দুইটি ফুল ঝাড়ু দেন। একটা ঝাড়ু দিয়ে ১০ কিলোমিটার দূরের দুই স্টেশন কীভাবে ঝাড়ু দিবে?”
বুড়িমারী রেলওয়ে স্টেশনের পরিচ্ছন্নকর্মী মালতি রানী বলেন, “আগে চার মাস বেতন পেলেও হারপিক, সাবান, ঝাড়ু কিছুই পাইনি।”
আদিতমারী স্টেশনের পরিচ্ছন্নকর্মী রবি বাসপোর বলেন, “সামনে পূজা, এদিকে তিন মাস বেতন নেই। এখন শুধু একটা ঝাড়ু পেলেও আগে চার মাস কোন সামগ্রী পাইনি। নিজের টাকায় স্টেশন পরিষ্কার রাখছি।”
পীরগঞ্জ স্টেশন মাস্টার সুজন বলেন, “গত অর্থ বছরের শেষ চার মাসের মধ্যে মাত্র এক মাসের পরিষ্কারক সামগ্রী বাবদ এক হাজার টাকা দিয়েছে। সেটাও ডিআরএম স্যারের পরিদর্শনের কারণে পেয়েছি।”
সোনাতলা স্টেশন মাস্টার খলিল বলেন, “গত অর্থ বছরে বোনাপাড়া স্টেশনে থাকা অবস্থায় এক বছরে কোনো বরাদ্দই পাইনি। অফিস বলেছে বরাদ্দ নেই।”
বাংলাদেশ রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক বুড়িমারী ও পাটগ্রাম স্টেশন মাস্টার নুর আলম বলেন, “প্রত্যয়ন নিয়েও গত অর্থ বছরের মার্চ থেকে জুনে চার মাসে কোন পরিষ্কারক সামগ্রী দেওয়া হয়নি। একটি স্টেশন পরিচ্ছন্ন রাখতে প্রতি মাসে কমপক্ষে দুই হাজার টাকার পরিষ্কারক সামগ্রী প্রয়োজন হয়। ওই চার মাস নিজের টাকায় কখনো বাকিতে পণ্য কিনে স্টেশন পরিষ্কার রেখেছি। কিন্তু সেই টাকা আজও পাইনি।”
ক্লিন সার্ভিসের মালিক ওয়ালিউর রহমান বলেন, “প্রতি মাসে পরিষ্কারক সামগ্রী ক্রয় করে সরবরাহ করার জন্য অফিস সহকারী সোহেলকে তার রূপালী ব্যাংকের হিসাব নম্বরে টাকা পাঠিয়ে দিয়েছি। অসুস্থতায় দেশের বাইরে থাকায় চার মাসে পণ্য না দিয়ে সোহেলকে টাকা পাঠিয়ে দিতে হয়েছে। তিনি তা পৌঁছে না দিলে সেটা তার ব্যাপার। আমি প্রত্যয়ন পেয়েছি, বিলও পেয়েছি।”
অফিস সহকারী ও স্টোরকিপার নুরুজ্জামান সরকার সোহেল বলেন, “চার মাস নয়। শুধু মাত্র এক মাসের টাকা পাবেন তারা। ঠিকাদারের কাছ থেকে টাকা পেলে তা দ্রুত সমাধান করা হবে।”
লালমনিরহাট বিভাগীয় রেলওয়ে বাণিজ্যিক পরিবহন কর্মকর্তা (ডিসিও) আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, “স্টেশন মাস্টারদের প্রত্যয়ন স্বাপেক্ষে বিল দেওয়া হয়েছে। তারা না পেয়ে প্রত্যয়ন কেন দিবেন? এমন হলে তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
ঢাকা/সিপন/এস