এর চেয়ে হতাম যদি…
রাশেদুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম
আমার জন্ম হয়েছিল ছোট্ট একটা গ্রামে। বাড়ির পাশে কী ছিল না! নদী, আবাদি জমি, স্কুল, বাজার এমনকি বাড়ি থেকে একটু হাঁটলেই দেখা যেত সেনাবাহিনীদের ক্যান্টনমেন্ট। মা বলেন, ছোট থাকতে নাকি আমি অনেক দুষ্টু ছিলাম। যেখানে যা দেখেছি, বাড়ি এসে তাই করতে চেয়েছি। যেখানে যে পেশার মানুষ দেখেছি, সেই পেশাকেই নিজে বেছে নিতে চেয়েছি।
দাদু বাড়ি যাওয়ার পথে ধলেশ্বরী নদী পার হওয়ার সময় যখন দেখতাম তালেব চাচা খেয়া ঘাটের মাঝি, তখন নাকি বাড়ি এসে মাকে বলতাম সেই নৌকার মতো যেন আমাকে একটা নৌকা কিনে দেওয়া হয়, আমি খেয়া ঘাটের মাঝি হব। আমি সকাল-সন্ধ্যা গ্রামের মানুষ পারাপার করব। যতটুকু আয় হবে আমার মা-বাবাকে নিয়ে শান্তিতে থাকতে পারব।
আবার বাজারে যাওয়ার পথে যখন সেনাবাহিনীদের দেখতাম, তখন মনে হতো যদি আর্মি হতে পারতাম। তাহলে দেশের যেকোনো ক্রান্তিকালে সবার আগে ঝাঁপিয়ে পড়তাম দেশমাতাকে রক্ষা করার জন্য। যেকোনো বহিঃশক্তির হাত থেকে দেশমাতাকে রক্ষা করতাম। সেজন্য বাড়ি গেলে আবদুর রহিম মাস্টারের ছেলে মিজান চাচা এখনো আমাকে আর্মি সাহেব বলেই ডাকেন।
একদিন মায়ের অনেক জ্বর হয়েছিল, তখন মাকে নিয়ে গিয়েছিলাম পাশের এলাকার ডা. আবদুস সামাদ নানার কাছে। নানা মাকে সুস্থ করে দিয়েছিলেন। তারপর থেকেই বাবা-মাকে নাকি বলতাম, আমি ডাক্তার হব। অসুস্থতার জন্য মানুষ স্মরণ করার সাথে সাথেই আমি সাড়া দেবো। গরীব-দুঃখী মানুষের চিকিৎসা আমি বিনামূল্যে করব। দেশের বড় নাম করা ডাক্তার হব, বাবা-মায়ের মুখ উজ্জ্বল করব।
বেলটিয়া মাঠে শাহালম চাচার দোকান থেকে যখন মজা কিনে খেতাম, তখন মনে মনে ভাবতাম আমি চাচার মতো দোকানদার হব। তাহলে মজা খাওয়ার জন্য আমাকে আর আব্বার কাছে টাকা চাইতে হবে না। নিজের মতো করে যখন ইচ্ছে হবে তখনি আমি মজা খেতে পারব।
সেসময়ে আব্বু যখন আমাকে স্কুলে নিয়ে যেত, তখন আমি রহিম মাস্টারের মতো শিক্ষক হতে চাইতাম। একজন আদর্শ শিক্ষক, যেমন একজন শিক্ষার্থীর সার্বিক অবস্থা পরিবর্তন করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেন, ঠিক আমি আমার ছাত্র-ছাত্রীদের সার্বিক অবস্থা পরিবর্তনে সহায়ক ভূমিকা পালন করব। মানুষ গড়ার কারিগর হব আমি।
যখন দেখতাম পাশের বাড়ির মোন্নাফ চাচা মাথায় করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাটা কাপড় বিক্রি করছে, তখন নাকি আমার নিজের কাপড়গুলো আমার ছোট্ট লুঙ্গিটায় গিট্ট (বেঁধে) দিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরতাম আর বলতাম, রাখবেন কাটা কাপড়, রাখবেন কাটা কাপড়। তখন ভাবতাম, এর চেয়ে আরামদায়ক বা শান্তির আর কোনো ব্যবসা বা চাকরি নেই।
আনজু চাচা যখন ধান ভেঙে চাল বের করার জন্য মেশিন নিয়ে আমাদের বাড়ি আসতো, তখন আমি নাকি মাকে বলতাম, আমাকে এমন একটা মেশিন কিনে দাও, যাতে আমি বাড়ি বাড়ি গিয়ে সবার ধান ভেঙে চাল বের করে দিতে পারি।
সবুর চাচা যখন লাঙ্গল-জোয়াল এবং গরু নিয়ে জমি চাষ করতে মাঠে যেত, তাই দেখে আমি নাকি ছাগলের সঙ্গে বাঁশ বেঁধে বাড়িতেই হালচাষ করার প্র্যাকটিস করতাম, আর বলতাম, আমি হব দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ কৃষক। আমি ধান, কলাই, গমসহ সব প্রকার ফসল চাষ করব।
পাশের বাড়ির কাকা যখন নৌকা-জাল নিয়ে যমুনা নদীতে মাছ ধরতে যেত, তা দেখেই আমি জেলে হতে চাইতাম, যাতে বড় মাছটা যেন আমাদের বাড়িতেই আসে। বাবার যেন প্রত্যেক দিন বাজারে মাছ কিনতে না যেতে হয়।
আবার পাশের বাড়ির ওসমান ক্বারীকে মসজিদে ইমামতি করতে দেখে আমি নাকি মাথায় টুপি পরে বন্ধুদের নামাজ পড়াতাম। সবাইকে নামাজ পড়তে বলতাম, আরো নাকি বলতাম পর্দার কথা।
জন্ম যেহেতু অজপাড়া গাঁয়ে, তাই ছোটবেলায় কখনো পাইলট দেখেনি, ইঞ্জিনিয়ার দেখিনি, সরকার কি বুঝিনি, আদালত কি বুঝিনি। হয়তো তাই কখনো রাজনীতিবিদ হতে চাইনি, পাইলট হতে চাইনি, আইনজীবী হতে চাইনি। যা দেখেছি তাই হতে চেয়েছি।
আজ নিজেকে যখন দেখি, তখন একটা জিনিসই মাথায় কাজ করে, কী হলাম! এত কিছু বিকল্প থাকা সত্ত্বেও নিজেকে এই পৃথিবীর সাথে কোনো রকম মানিয়ে নিয়েছি। ছোটবেলায় যখন যেটা করতে মনে হয়েছে, তখন সেটার স্বাদ নেওয়ার চেষ্টা করেছি। এখন আমি একজন মাঝি, সৈনিক, ডাক্তার, মাস্টার, চাষি, জেলে...। আর ভবিষ্যতে এমনই হতে চাই, যার ভেতরে সবগুলো বৈশিষ্ট্য থাবকে। যাকে বলে পরিপূর্ণ মানুষ।
লেখক: শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ঢাবি/হাকিম মাহি
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন