ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

শিম্পাঞ্জি ও মানুষ: একই শারীরিক গঠনে দুই ভিন্ন সত্ত‌া

নাজমুল হাসান অনিক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ৯ জুলাই ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
শিম্পাঞ্জি ও মানুষ: একই শারীরিক গঠনে দুই ভিন্ন সত্ত‌া

সমাজে মিথ প্রচলিত আছে। বানর বা শিম্পাঞ্জি থেকে মানুষের উৎপত্তি। আর বিবর্তন বলতে সাধারণ মানুষ এই জিনিসটাকে বোঝে। এ নিয়েই একটা ধোঁয়াশা অবস্থা সকলের মধ্যে সৃষ্টি করে। অথচ আমরা ভালোভাবে জানি না আসল ঘটনাটা কি। মানুষে আর শিম্পাঞ্জিদের মধ্যে বেসিক পার্থক্য ঠিক কোথায় এই লেখায় তা স্পষ্ট করার চেষ্টা থাকবে।

সৃষ্টির শুরুর দিকের কথা চিন্তা করলে আমরা দেখব যে লক্ষ লক্ষ বছর আগে এ পৃথিবীর মাটিতে মানুষের পদচিহ্ন পড়েছিল। ধীরে ধীরে মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে। অনেকগুলো প্রজাতির আবির্ভাব ঘটে। প্রত্যেক প্রজাতিই বিবর্তন নামক কঠিন বাস্তবতার শিকারে পরিণত হয়। বিবর্তন এর সর্বশেষ রূপ হচ্ছে এই এখন। আমরা যারা আছি তারা। মানে- হোমো সেপিয়েন্সরা। বিবর্তন একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। সে প্রক্রিয়ার সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে আমরা খেয়াল করলাম যে আমাদের সাথে খুব কাছাকাছি মিল আছে এমন একটি প্রাণী হচ্ছে শিম্পাঞ্জি। আবার জনমনে প্রচলিত শিম্পাঞ্জি থেকেই মানুষের উৎপত্তি। এরাই হচ্ছে আমাদের আদিপুরুষ। এই বক্তব্য নিয়ে অনেক মতবিরোধ আছে। কিন্তু আসল কথা হচ্ছে যাদেরকে আমাদের অ্যানসেস্ট্রাল বা পূর্বপুরুষ বলা হচ্ছে তাদের সাথে আসলেই আমাদের কতটুকু গঠনগত মিল আছে? আর কোন সেই পার্থক্য যার জন্য তারা শিম্পাঞ্জি আর আমরা মানুষ সেটা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে?

আমরা বর্তমান হোমো সেপিয়েন্সরা হচ্ছি বনমানুষ গোত্রের সদস্য। আমাদের নিকট আত্নীয়রা হলো শিম্পাঞ্জি, গরিলা, ওরাংওটাং। এর মধ্যে সবচেয়ে কাছের আত্মীয় হচ্ছে শিম্পাঞ্জি। শিম্পাঞ্জির সাথে মানুষের প্রায় ৯৬% এর ও বেশি জেনেটিক মিল আছে। তাহলে বুঝাই যাচ্ছে এখানে যে প্রায় শতভাগের কাছাকাছি সামঞ্জস্য রয়েছে আমাদের সাথে আমাদের নিকটাত্মীয়দের।

বনমানুষদের একটি প্রাচীণ গন ছিল অস্ট্রালোপিথেকাস। প্রায় ২৫ লক্ষ বছর পূর্বে এই গনের বিবর্তনের ফলে পূর্ব আফ্রিকায় প্রথম মানবজাতির উদ্ভব ঘটে। পরবর্তীতে এই মানুষেরা উত্তর আফ্রিকা, ইউরোপ এবং এশিয়াতে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে টিকে থাকার জন্য মানুষের সে পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেয়া অতীব জরুরি ছিল। যার ফলে সে পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্যও তাদের মধ্যে দেখা যেতে শুরু হল। আমাদের এই বনমানুষেরা আস্তে আস্তে নিজেদের বিভিন্ন প্রজাতিতে বিবর্তিত হওয়া শুরু হল। হোমো রুডলফেনসিস, হোমো এরগেষ্টার, নিয়েন্ডারথাল এবং যার শেষ সংস্করণ হল আমাদের এই বর্তমান হোমো সেপিয়েন্স।

 

নিয়ান্ডারথাল প্রজাতির একজন মানুষ

 

হোমো সেপিয়েন্সদের মস্তিষ্ক ছিল প্রাণীজগতের মধ্যে সবচেয়ে বৃহৎ এবং উন্নত। শরীরের প্রায় ২-৩ শতাংশই হচ্ছে মানব মস্তিষ্ক। এই মস্তিষ্ক প্রতিনিয়ত বিবর্তনের ফলে আকার বৃদ্ধি করেছে। ২৫ লক্ষ বছর আগে যেখানে মানুষের মস্তিষ্ক ছিল ৬০০ ঘন সেন্টিমিটার সেখানে বর্তমান সময়ে এসে মস্তিষ্ক হচ্ছে ১২০০-১৪০০ ঘনসেন্টিমিটার। মস্তিষ্কের এই উন্নতি আমাদেরকে পৃথক করেছে আমাদের নিকটাত্মীয় শিম্পাঞ্জি থেকে। আমরা শুরু করলাম শিকার করা। আগুন জ্বালানো। আর শিম্পাঞ্জি গোত্রের প্রাণীরা বঞ্চিত হল সে সুবিধা থেকে। আমাদের প্রাইমেট বা পূর্বপুরুষেরা সোজা হয়ে হাঁটতে পারত না। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে তাদের অস্থি বিকশিত হয় । চার পায়ের একটি কাঠামোকে সোজা হয়ে দুই পায়ে চলতে সাহায্য করেছিল এই বিকশিত অস্থি। বিবর্তনের শুরুটা এভাবেই হয়েছিল আমাদের। এখানেও আমাদের সাথে গভীর পার্থক্য হয়ে গেল শিম্পাঞ্জিদের সাথে। (তথ্যসূত্র: Sepiens: A breif historyof human kind- Yuval Noah Harari)

 

মানুষ ও শিম্পাঞ্জির স্কেলিটন

 

ইতিহাস তো দেখা হল। এবার আসি জেনেটিকাল ব্যাপারস্যাপারে। আমাদের সাথে শিম্পাঞ্জির ৯৬% এরও বেশি জেনেটিক সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যায়। তাহলে কোন সে বিষয় যার জন্য তারা শিম্পাঞ্জি আর আমরা মানুষ?

আমাদেরকে ক্রোমোজোম, ডিএনএ সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে এ বিষয়টা ভালোভাবে বুঝতে। প্রথমেই আমাদেরকে যে জিনিসটি বুঝতে হবে সেটা হচ্ছে ক্রোমোজোম।ক্রোমোজোম হচ্ছে বংশগতির প্রধান উপাদান যা জীবের সকল বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। এর মাধ্যমেই বৈশিষ্ট্যসমূহ বংশ পরস্পরায় সঞ্চারিত হয়। ক্রোমোজোম ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড বা ডিএনএ অণু ধারণ করে এবং ডিএনএ-এর মাধ্যমে প্রোটিন সংশ্লেষণ করে। এটি নিউক্লিয়াসের মধ্যে অবস্থিত। এবার তাহলে ক্রোমোজোমের পূনর্বিন্যাস জিনিসটা কি? ক্রোমোজোম পূনর্বিন্যাস বলতে বোঝায় ক্রোমোজোমের স্ট্রাকচার বা কাঠামোর পরিবর্তন। অর্থাৎ মূল কাঠামোকে ঠিক রেখে তার সামান্য এদিক সেদিক করা যাকে বলে।ক্রোমোজোমের পূনর্বিন্যাসকে ৪ ভাগে ভাগ করা হয়-

১.ডুপ্লিকেশন

২.ডিলেশন

৩.ইনভারশন

৪.ট্রান্সলোকেশন

এই ট্রান্সলোকেশনেই লুকিয়ে আছে আমাদের কাঙ্খিত সে প্রশ্নের উত্তর। অ-সমজাতীয় বা নন-হোমোলোগাস ক্রোমোজোমের মধ্যে যখন জিনগত উপাদানের আদান-প্রদান হয়, তখন এটি ট্রান্সলোকেশন নামে পরিচিত হয়। ট্রান্সলোকেশন চলাকালে বিভিন্ন ক্রোমোসোমের মধ্যে জিনগত উপাদান হচ্ছে বিনিময়যুক্ত ক্রোমোজোমের টুকরো। এক ক্রোমোজোমের ক্রোমোজোম অংশগুলিকে অন্য নন-হোমোলোগাাস ক্রোমোজোমে চলাচলের কারণে এটি অত্যন্ত ভিন্ন জিন সংমিশ্রণে ফল দেয় যা নতুন স্থানে অবস্থান করে। ট্রান্সলোকেশন ক্রোমোজোমের একটি অস্বাভাবিকতা। অতএব, এটি এক ধরণের পরিব্যাপ্তি যা ভুল ক্রোমোসোমগুলির সাথে জিনের পুনর্বিন্যাসের কারণে ক্যান্সার, ডাউন সিনড্রোম, বন্ধ্যাত্ব, এক্সএক্স মেল সিন্ড্রোম ইত্যাদির মতো রোগের সৃষ্টি করে। সুতরাং, ট্রান্সলোকেশনকে একটি বিপজ্জনক প্রক্রিয়া হিসাবে বিবেচনা করা হয় যা জীবদেহে বিভিন্ন মারাত্মক রোগের কারণ হতে পারে।

ট্রান্সলোকেশন আবার দুই রকমের হতে পারে। একটা হচ্ছে পারস্পরিক ট্রান্সলোকেশন। আরেকটা রবার্টসোনিয়ান ট্রান্সলোকেশন। মূল বিষয় হচ্ছে এই রবার্টসোনিয়ান ট্রান্সলোকেশন নিয়ে আমরা আলোচনা করতে পারি। একটি ক্রোমোজমের একটি সেন্ট্রোমিয়ার এবং দুইটি প্রান্ত থাকে। একটি লং আর্ম বা লম্বা প্রান্ত আরেকটি শর্ট আর্ম বা ছোট প্রান্ত। এবার এক্সপেরিমেন্ট এর জন্য দুইটি ক্রোমোজোম নিলাম। যখন রবার্টসোনিয়ান ট্রান্সলোকেশন ঘটে তখন দুইটি ক্রোমোজোমের লম্বা দুইটা প্রান্ত এবং ছোট দুইটি প্রান্ত প্রত্যেকের সাথে সংযুক্ত হয়।কখনো কখনো ছোট দুটি প্রান্ত পরস্পরের সাথে সংযুক্ত হতে পারে না বরং এই দুইটি ক্রোমোজোম নষ্ট হয়ে যায়। ফলে ক্রোমোজোম সংখ্যা কমে যায়।এই পরিস্থিতিকে বলে ডাউন সিনড্রোম যেটা ইভ্যালুশন বা বিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে। (তথ্যসূত্র: Genetics : A conceptual Approach- Benjamin A.Pierce)।

রবার্টসোনিয়ান ট্রান্সলোকেশন

 

বিবর্তনে ট্রান্সলোকেশনের ভুমিকা

ট্রান্সলোকেশন সবচেয়ে বড় ভুমিকা রাখে বিবর্তনে। অনেকেরই এ ব্যাপারে ধারনা অস্পষ্ট। মানুষ আর শিম্পাঞ্জির মধ্যে তফাৎ আমাদের জানা নেই। তবে শিম্পাঞ্জির সাথে আমাদের গঠনগত দিক দিয়ে অনেকটাই মিল আছে যেটা আমরা শুরুতেই বলেছি। তাহলে কি এমন জিনিস যার জন্য শিম্পাঞ্জি এবং মানুষের মধ্যে এই তফাৎ। এখানেই আছে সবচেয়ে মজার ব্যাপার। আমরা এখন সেটাই দেখব যে শিম্পাঞ্জি, বানর, গরিলা, ওরাংওটাং এর সাথে আমাদের আসলে মূল পার্থক্যটা কোন জায়গায়।

আমরা জানি আমাদের মানবদেহে মোট ২৩ জোড়া বা ৪৬ টি ক্রোমোজোম আছে। কিন্তু আমরা যদি শিম্পাঞ্জি, গরিলা, ওরাংওটাংয়ের দিকে তাকাই তাহলে দেখব যে ওদের আছে মোট ২৪ জোড়া বা ৪৮ টি ক্রোমোজোম। দেখা যাচ্ছে ক্রোমোজোম এদের দুই জোড়া বেশি। আমরা একটু আগেই রবার্টসোনিয়ান ট্রান্সলোকেশন বিষয়টা দেখেছি। দেখেছি যে মানুষের একজোড়া ক্রোমোজোমের দুইটি ছোট প্রান্ত মিলিত হয়ে ছোট একটা ক্রোমোজোম উৎপন্ন করে। কিন্তু এরা বিলুপ্ত হয়ে যায় বিবর্তনের কারনে। এইযে দুইজোড়া ক্রোমোজোম থেকে এক জোড়া প্রান্ত বিলুপ্ত হয়ে যায় ঠিক এই জায়গাতেই মানুষের আর শিম্পাঞ্জির মধ্যে একমাত্র পার্থক্য। মানুষের ছোট ক্রোমোজোম দুইটি বিলুপ্ত হবার কারনে আমাদের ক্রোমোজোম সংখ্যা ৪৬ টি অন্যদিকে শিম্পাঞ্জিদের ক্রোমোজোম সংখ্যা থাকে ৪৮ টি। মানুষের ক্রোমোজোমে রবার্টসোনিয়ান ট্রান্সলোকেশন ঘটে যেটা শিম্পাঞ্জি বা বানরের মধ্যে ঘটে না। আর এই পুরো প্রক্রিয়াটির পেছনে সবচেয়ে বড় হাত রয়েছে বিবর্তনের।

এটাই মূলত আমাদের আর আমাদের কথিত পূর্বপুরুষদের মধ্যে গঠনগত তফাৎ। সবচেয়ে কাছের আত্নীয় হবার পরেও শিম্পাঞ্জিরা আমাদের থেকে শুধু সামান্য একটা কারনে পৃথক।

লেখক: শিক্ষার্থী, বায়োটেকনোলজি এন্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

 

বশেমুরবিপ্রবি/ মাহফুজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়