ঢাকা     রোববার   ২১ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৬ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

একজন বাবার গল্প

রায়হান হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:১১, ১৩ এপ্রিল ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
একজন বাবার গল্প

বাবা একটি শব্দ। এর সাথে জড়িয়ে থাকে হাজারো স্মৃতি। এই সুন্দর পৃথিবীতে মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ হলো মা-বাবা। যাদের বাবা নেই, তারাই বোঝেন বাবা হারানোর ব্যথা। বাবা সাধারণ কেউ নন। তিনি সুপারম্যান কিংবা ব্যাটম্যানের চেয়েও অসাধারণ কেউ।

রোদ কিংবা বৃষ্টি থেকে বাঁচাতে মাথার উপর যে কেউই ছাতা হতে পারে, কিন্তু বট বৃক্ষের মতো শীতল ছায়া যে কেউ দিতে পারে না। বটবৃক্ষ হয়ে মাথার উপর থাকেন ‘বাবা’। যতক্ষণ থাকেন, ততক্ষণ বোঝা যায় না তার মর্ম! মাথার উপর থেকে ছায়া সরে গেলেই টের পাওয়া যায়, কঠিন এই জীবনটা কেউ একজন অনেক সহজ করে দিয়েছিল। জীবন আসলে এতটা সহজ নয়, যতটা আমরা মনে করি।

আজ আপনাদের একজন বাবার গল্প বলব, সত্তরের দশকের প্রথম দিকে বরিশালের প্রত্যন্ত অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। অভাব অনটনের মধ্যে পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণের ফলে নুরজাহান-সফী দম্পতি খুব খুশি হলো। আদরের সন্তানের নাম রাখলেন বেল্লাল।

বেল্লাল হোসেন ছোটবেলা থেকেই একটু বেশি মা ভক্ত ছিল। মা-বাবা ভাই-বোন নিয়ে তাদের পরিবার চলছিল ভালোই। হঠাৎ আকাশ ভেঙে পড়ল তার মাথায়। মাত্র ১৫ বছর বয়সেই সবার প্রিয় বাবাকে হারায় বেল্লাল। তখন তাদের পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৬ জন। তার বাবা মৃত্যুর সময় পরিবারের জন্য এক কেজি চালও রেখে যেতে পারেনি। তিনি সেই কিশোর বয়সেই জীবিকার টানে ঢাকা চলে আসেন। পরিবারের তিন বোন, এক ভাই ও মায়ের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য। ঢাকা এসে এলাকার একজনের সাহায্যে একটি কাজও পেয়ে যান।

বেল্লাল হোসেনের মা ছিলেন একজন মহিয়সী নারী। তিনি খুব কষ্ট করে তার ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়েছেন। তিনি তার ভাই-বোনদের মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন এবং তা পেরেছিলেনও। ভাই-বোনের বিয়ে দেওয়ার পর নিজে বিয়ে করেন।

বেল্লাল হোসেনের বড় ছেলে নাম রায়হান হোসেন। বড় আদরের সন্তান ছিল রায়হান। ছোট সময় রায়হান একবার খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রিয় সন্তানের অসুস্থতায় তিনি খুব অস্থির হয়ে পড়েন। ছেলেকে সুস্থ করার জন্য তিনি হাসপাতালে ভর্তি করেন। বাবা-মায়ের সেবায় সে যাত্রায় রায়হান সুস্থ হয়ে উঠেন। কিন্তু এখানে একটি মজার ঘটনা হলো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সুস্থ হয়ে ওঠে একবার হারিয়ে যায় রায়হান। তখন বেল্লাল হোসেনের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল।এই মনে হয় সাত রাজার ধন হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। অনেক খোঁজাখুঁজি পর হাসপাতালে সিড়ির কোণায় খুঁজে পান।

বেল্লাল হোসেনের স্বপ্ন ছিল ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তোলার। সেই স্বপ্ন জয়ের লক্ষ্যে ছেলেকে স্থানীয় একটি স্কুল থেকে এসএসসি ও জেলার শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ থেকে এইচএসসি পাস করান। রায়হান বর্তমানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত আছেন। তার বাবা সবসময় একটি কথা বলতেন, দেখ বাবা আমি তোমাদের জন্য কোনো সম্পদ রেখে যেতে পারব না। আমি থাকতে তোমরা লেখাপড়া শিখে মানুষের মতো মানুষ হও, এটাই আমার চাওয়া। আমার শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত দিয়ে আমি তোমাদের লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করার চেষ্টা করব।

রায়হান ছাত্র হোস্টেলে থাকার সময় মাসের শেষে যখন টাকার প্রয়োজন হত, তার বাবা নিজে থেকেই টাকা দিয়ে বলতো আরও লাগলে বলো। নিজে শত কষ্টের মধ্যে থেকেও ছেলেকে বুঝতে দিতেন না। রায়হান তার বাবার কাছে যখন যা চেয়েছে, তাই পেয়েছে।

একবার রমজানের ঈদের সময় তার বাবা সবার জন্য ঈদের পোশাক নিয়েছেন, কিন্তু নিজের জন্য নেননি। সেই বার রায়হান তার বাবাকে বলেছিল, বাবা আপনি একটি পাঞ্জাবি নেন। তখন তিনি বলেন, আমি এক দিনের জন্য পাঞ্জাবি কিনে কী করবো? আমি তো ঘুরতেও যাই না। তোমাদের হলেই আমি খুশি।

রায়হান এখন মাত্র সম্মান তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। তার মেজ ভাই এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। সবার ছোট ভাইটি অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। তার নব্বই বছর বয়স্ক দাদী ও মা রয়েছেন। এই পৃথিবীতে তাদের বাঁচার একমাত্র অবলম্বন ছিল তার বাবা। গত ৩০ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার গুরুতর অসুস্থ হয়ে রায়হানের বাবা রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে যান এবং পাঁচ দিন পর ২ ফেব্রুয়ারি রাত পৌনে ১০টার সময় সন্তানদের মায়া ত্যাগ করে পরপারে পাড়ি জমান।

৩ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টার দিকে রায়হানের বাবার লাশ গ্রামের বাড়িতে এসে পৌঁছায়। ওই দিন ছিল তার মেজ ভাই রিয়াদের এসএসসি পরীক্ষা। পরীক্ষা দিয়ে বাড়ির উঠানে যখন রিয়াদ বাবার লাশ দেখে, তখন বার বার মূর্ছা যাচ্ছিল। সারা পরীক্ষা জুড়ে ও অসুস্থ ছিল।

রায়হানের সবার ছোট ভাই আরিয়ান। সে তার বাবার সবচেয়ে প্রিয় ছিল। আরিয়ানের কান্না শুনে সারা এলাকায় যেন শোকের ছায়া নেমে এসেছিল।

লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা কলেজ।


ঢাকা/হাকিম মাহি

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়