ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

‘শাহিন ভাই আইছে, শাহিন ভাই আইছে’

শেখ নাসির উদ্দিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৪৭, ৩ আগস্ট ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
‘শাহিন ভাই আইছে, শাহিন ভাই আইছে’

চারপাশে যতদূর চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। একটা ইঞ্জিনচালিত নৌকায় থরে থরে সাজানো নতুন কাপড়ের ব্যাগ। গন্তব্য সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা ও খুলনার কয়রা উপজেলা। 

নৌকা একটা চরে এসে ভিড়তে না ভিড়তেই বেশ কয়েকজন শিশুর হাক-ডাক শোনা গেলো। ‘শাহিন ভাই আইছে, শাহিন ভাই আইছে’ নৌকা থেকে হাত নেড়ে হাসিমুখে শিশুদের উষ্ণ অভ্যর্থনা গ্রহণ করলেন সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের স্নাতক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী এস এম শাহিন বিল্লাহ। নৌকাটিকে চারপাশে ঘিরে ধরল শিশুরা, আর তাদের পছন্দসই ঈদের নতুন কাপড় হাতে তুলে দিলেন তাদের প্রিয় ভাই।  

উপকূলের এই সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সাথে শাহিনের সখ্যতা একদিনে গড়ে ওঠেনি। ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের পর শুধু উপকূলের শিশু নয়, বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের ঘরে ঘরে কখনো বিশুদ্ধ পানি, রান্না করা খাবার, আবার কখনো ত্রাণসামগ্রী নিয়ে ছুটে এসেছেন এই তরুণ। তাই সব শ্রেণীর মানুষের কাছে এখন তিনি কেবল একজন পরিচিত মুখই নন, বন্ধুও বটে। 

শাহিন বিল্লাহ বলেন, ঘূর্ণিঝড় আইলার সময় আমার বয়স মাত্র ৮ বছর। সেসময় খুব কাছ থেকে দেখেছি উপকূলের মানুষকে কতটা সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে হয়। আইলা পরবর্তী সময়ে দীর্ঘ দিন আমরা ঘরের মধ্যে মাচা করে তার উপর থাকতাম। জোয়ারের সময় ঘরে পানি ঢুকতো। লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। খাবার কিছু ছিল না। আমাদের এই দ্বীপে যখনই কোনো ট্রলার আসতো আমি ছুটে যেতাম। এই বুঝি কেউ আমাদের জন্য কিছু নিয়ে এলো। সেই সময় থেকেই উপকূলের মানুষের জন্য কিছু করার ইচ্ছে জাগে। 

আপনার মানবসেবার শুরুর গল্প জানতে চাই, প্রশ্নে তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড় ফণী, বুলবুলের সময়ে মানুষের পাশে ছিলাম। তবে বড় পরিসরে কাজ শুরু করি আম্ফান পরবর্তী সময়। শুরু থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খুবই সক্রিয় ছিলাম। সবসময় উপকূলের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা ছবির মাধ্যমে তুলে ধরেছি। যেসব ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় সচারচার গণমাধ্যমকর্মীরা যেতে পারে না, আমি সেসব জায়গাতে গিয়ে নিয়মিত ফেসবুক লাইভে এসে বিশ্ববাসীর কাছে  উপকূলের মানুষের কষ্টের কথা বলতাম। 

আমার ছবি আর লাইভ দেখেই দেশ-বিদেশের অনেক বিত্তবান মানুষ ও সংগঠন উপকূলবাসীর পাশে দাঁড়িয়েছে এবং আমাকে অনেকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করতে চেয়েছেন। প্রথম দিকে একা কাজ করতাম, পরে আমার কাজ দেখে আমার বন্ধুরা যোগ দেয়। এখন আমরা ১০ জনের একটি টিম কাজ করছি, বলেন তিনি।

শাহিন বিল্লাহ আরও বলেন, উপকূলের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য খাবার এবং নিরাপদ পানির ব্যবস্থা, শিশুদের জন্য পুষ্টিকর খাবার এবং খেলনাসামগ্রী, ঈদের নতুন কাপড় দিয়েছি। গর্ভবতী মায়েদের জন্য পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা এবং কিশোরীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে স্যানিটারি ন্যাপকিন ঘরে ঘরে গিয়ে পৌঁছে দিয়েছি। করোনার এই প্রাদুর্ভাবে মানুষকে সচেতন করতে বারবার সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা ও সচেতনতামূলক প্রচারপত্র বিলি করেছি উপকূলের মানুষের মাঝে।

শিশুদের কেন বেশি প্রাধান্য দেন? তার জবাবে মুখে হাসি নিয়ে শাহিন বলেন, বেশির ভাগ সংগঠন বড়দের জন্য কাজ করে। শিশুদের সহযোগিতায় তেমন এখানে কোনো সংগঠন নেই। তাছাড়া এখানে অনেক সংগঠন শুধু সামনের কিছু বাড়িতে ত্রাণ দিয়ে চলে যায়। একেবারে ভেতরে যায় না, ফলে একজন বারবার সহায়তা পেলেও অনেকে সেটা থেকে বঞ্চিত হয়। তাই আমরা পানির মধ্যে নৌকা নিয়ে গ্রামের ভেতরে ভেতরে গিয়ে যারা সহযোগিতা পায়নি, তাদের সহযোগিতা করেছি। আর সেটা করতে গিয়ে শিশুদের অবসাদগ্রস্তের ছবি দেখেছি। এরপর আমরা উপকূলের দুইটি উপজেলার শিশুদের মাঝে খেলনাসামগ্রী ও চিপস দিয়েছি। এছাড়া এবার ঈদের নতুন কাপড় দিয়েছি। এতে ওদের মুখে হাসি ফুটেছে। 

পড়ালেখার পাশাপাশি শাহিন বিল্লাহ নিয়মিত স্থানীয় পত্রিকায় লেখালেখি করেন। নিজের আত্মতৃপ্তির কথা তুলে ধরে এস এম শাহিন আলম বলেন, যখন ট্রলারে করে ত্রাণসামগ্রী নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াই, অবহেলিত শিশুদের জন্য কিছু করতে পারি, তখন যে ভালো লাগা কাজ করে, পৃথিবীর আর কোথাও সে ভালো লাগা খুঁজে পাইনি। উপকূলের শিশুদের মুখে হাসি ফোঁটাতে পারলে প্রাণটা ভরে যায়। নিজেকে সফল মনে হয়।

আমি টেকসই কিছু করতে চাই, যাতে বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত হওয়া উপকূলবাসীকে প্রতি দুর্যোগে ঘর ছেড়ে যেতে না হয়। অন্যের সাহায্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে না হয়। শিশুরা যেন ঝরে না পড়ে, তাদের ভবিষ্যৎ যেন সুন্দর হয়, বলেন শাহিন।  


লেখক: শিক্ষার্থী, এইচএসসি পরীক্ষার্থী, ছাফদার আলী কলেজ, মির্জাপুর। 

টাঙ্গাইল/মাহি 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়