ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততা, হুমকিতে কৃষি  

সিফাত জামান মেঘলা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৪৩, ১৬ নভেম্বর ২০২০  
দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততা, হুমকিতে কৃষি  

বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে সামগ্রিকভাবে দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে, এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের কৃষি তথা সার্বিক জীবনযাত্রার ওপর। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ততার সমস্যাটি দীর্ঘ দিনের। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই সমস্যা আরও প্রকট হচ্ছে। এ অঞ্চলের লবণাক্ততা ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়ে পশ্চিমাঞ্চলের এলাকাগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে সমগ্র কৃষি ব্যবস্থাপনা বিন্যাসে।

বাংলাদেশের কৃষি জমির শতকরা ৩০ ভাগ উপকূলীয় এলাকায়। উপকূলীয় ২.৮৫ মিলিয়ন ২৮.৫ লাখ হেক্টর জমির মধ্যে ০.৮৩ মিলিয়ন ৮.৩ লাখ হেক্টর জমিই লবণাক্ততায় নানাভাবে প্রভাবিত হয়। গত চার দশকে দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ততা বেড়েছে ২৬ শতাংশ। আর গত এক দশকে এর মাত্রা বেড়েছে ৩.৫ শতাংশ।

বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় নদ-নদীর পানিপ্রবাহ শুষ্ক মৌসুমে স্বাভাবিক মাত্রায় থাকে না। ফলে নদীর পানির বিপুল চাপের কারণে সমুদ্রের লোনাপানি যতটুকু এলাকাজুড়ে আটকে থাকার কথা ততটুকু থাকে না, পানির প্রবাহ কম থাকার কারণে সমুদ্রের লোনাপানি স্থলভাগের কাছাকাছি চলে আসে। ফলে লবণাক্ততা বেড়ে যায় দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের বিপুল এলাকায়।

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল যশোরে এমনটা দেখতে পাওয়া যায়, সেখানে শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় লবণাক্ততা বৃদ্ধি পায়। সুস্পষ্ট প্রমাণের ভিত্তিতে বলা যায়, দেশের দাকোপসহ দক্ষিণাঞ্চলে সমুদ্র ভূভাগের অনেক ভেতর পর্যন্ত লোনাপানি ইতোমধ্যেই (২০০৯) ঢুকে পড়েছে। এই সমস্যা উপকূলীয় অঞ্চল থেকে যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর ও কুমিল্লা পর্যন্ত উত্তর দিকে বিস্তৃত হয়েছে (২০১০), আরও উত্তরে বিস্তৃত হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত দিয়েছেন। 

১৯৯০ সালে দেশে লবণাক্ত ভূমির পরিমাণ ছিল ৮,৩০,০০০ হেক্টর, আর ২০০১ সালে এসে তা হয়েছে ৩০,৫০,০০০ হেক্টর। কম বৃষ্টিপাতের কারণে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততার সমস্যা দিনে দিনে আরও প্রকট হয়ে উঠবে।

বরিশাল ও পটুয়াখালীতে লবণাক্ততার পরিমাণ ২ পিপিটি (লবণাক্ততা পরিমাপক মাত্রা) থেকে বেড়ে ৭ পিপিটি হয়ে গেছে (প্রেক্ষিত ২০০৯)। চট্টগ্রাম শহর সন্নিকটের হালদা নদীর পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে ৮ পিপিটি হয়ে গেছে (২০০৯)।

এছাড়া খুলনার সুন্দরবনের অবস্থান এমন একটা জায়গায়, যা ত্রিভূজাকৃতির বঙ্গোপসাগরের শীর্ষ বিন্দুতে গাঙ্গেয় মোহনায় অবস্থিত। এই গাঙ্গেয় মোহনার মহীঢাল খুব মসৃণভাবে সমুদ্রে নেমে গেছে। ফলে আন্দামান সাগরে উৎপন্ন ঘূর্ণিঝড়গুলোর উত্তরমুখী যাত্রায় মহীঢালের অগভীরতার কারণে জলোচ্ছ্বাস অত্যন্ত উঁচু হয়ে আসে। সাগরের জোয়ারও অপেক্ষাকৃত উঁচু হয়। তাই সাগরের লোনাপানি ঢুকে পড়ে উপকূলভাগে, লবণাক্ত করে তোলে ভূ-অভ্যন্তরের পানিও।

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় ইতোমধ্যেই সুন্দরবনের সুন্দরী গাছে ব্যাপক মাত্রায় আগামরা রোগ দেখা দিয়েছে। অনেকে একে মানবসৃষ্ট কারণ হিসেবে উল্লেখ করতে চাইলেও গবেষকরা একে প্রাকৃতিক কারণ হিসেবেই শনাক্ত করেছেন। সুন্দরবনের অন্যান্য গাছও আগামরা ও পাতা কঙ্কালকরণ পোকার আক্রমণের শিকার হচ্ছে। আক্রান্ত হচ্ছে বাইনের বাগানও। সুন্দরবনের বুড়িগোয়ালিনী রেঞ্জ ইতোমধ্যেই পানির উচ্চতাজনিত কারণে লবণাক্ততার শিকার। 

এদিকে ননিয়ানরেঞ্জ আক্রান্ত হওয়ার মুখে (পরিপ্রেক্ষিত ২০১০)। এই অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ যে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছে, জমির উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাচ্ছে এবং অনেকের জীবিকা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে—এ তথ্যও পুরোনো। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক গবেষণায় বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার ২০ শতাংশ নারী লবণাক্ততার কারণে অকালগর্ভপাতের শিকার হন বলে যে তথ্য ওঠে এসেছে, তা খুবই উদ্বেগজনক।

উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বন্ধে পাকিস্তান আমল থেকে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, তার মধ্যে বেড়িবাঁধ উল্লেখযোগ্য। কিন্তু সিডর ও আইলার পর অনেক স্থানেই সেই বাঁধ ভেঙে গেছে। এ ছাড়া চিংড়ি চাষের জন্য অনেকে বাঁধ কেটে ঘের এলাকায় লবণপানি ঢুকিয়ে থাকেন। এতে গুটিকয়েক চিংড়িচাষি লাভবান হলেও এলাকার বেশির ভাগ বাসিন্দার জীবন-জীবিকা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।

মানুষের শরীরে নির্দিষ্ট পরিমাণ লবণের প্রয়োজন ও সেটি আসে খাদ্য ও পানি থেকে। কিন্তু উপকূলীয় এলাকার পানিতে লবণের পরিমাণ অনেক গুণ বেশি। এই পানি শরীরে প্রবেশ করলে স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যায়। বিশেষ করে গর্ভবতী নারীদের জন্য তা হয়ে ওঠে আরও বেশি বিপজ্জনক। গর্ভাবস্থায় নারীরা বেশি লবণাক্ত পানি খেলে খিঁচুনি ও উচ্চ রক্তচাপ হয়। এ কারণে নারীদের গর্ভাবস্থায় সন্তান মারা যাওয়ার হারও বেশি, যা বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে ওঠে এসেছে। 

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণাকেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) এক গবেষণায় বলা হয়, লবণাক্ততার কারণে উপকূলের নারীরা শুধু অকালগর্ভপাতেরই শিকার হন না, ৩ শতাংশ শিশুও মারা যায়। এ ছাড়া বেশি লবণ খাওয়ার সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপের সম্পর্ক রয়েছে, যা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।

যে মাটিতে গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধিকে সাংঘাতিকভাবে বাঁধা দেওয়ার মতো নিরপেক্ষ দ্রবণীয় উপাদান যেমন-ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, সোডিয়ামের ক্লোরাইড ও সালফেট প্রচুর পরিমাণে থাকে; কিন্তু মাটির ধর্ম পরিবর্তন করার মতো পর্যাপ্ত পরিমাণে সোডিয়াম থাকে না। তাকে লবণাক্ত মাটি বলে। এই মাটির দ্রবণে যে দ্রবণীয় লক্ষণ থাকে, তার অর্ধেকেরও বেশি সোডিয়াম। ফলে বেশ কিছু লক্ষণ মাটির কলয়েডের বাইরে থাকে ও দূও থেকে দেখলে মাটির ওপর সাদা সারের স্তরের মতো দেখা যায়। এ জন্য একে অনেকে সাদা সার মাটি বলে।

দক্ষিণাঞ্চলে লবণ প্রধানত দুইভাবে ছড়াচ্ছে। সমুদ্রের পানিতে প্লাবিত হয়ে ও মাটির নিচের স্তর থেকে ওপরে ওঠে এসে। মার্চ ও এপ্রিলে জোয়ারের পানি এসে দক্ষিণাঞ্চলে যেসব আবাদি জমি তলিয়ে যায়, সে সব মাটিতে লবণ ছড়িয়ে পড়ে। এ পানিতে ক্ষতিকর মাত্রার লবণ থাকে। এ পানি সেচ কাজে ব্যবহার করা হলে মাটি লবণাক্ত হয়।

এমতাবস্থায় আমাদের লবণাক্ততা কমাতে মনযোগী হতে হবে। লবণাক্ত মাটিকে চাষাবাদের উপযোগী করার জন্য দ্রবণীয় লবণকে মাটি থেকে সরিয়ে দিতে হবে। 

যদি জমির ওপর খুব বেশি লবণ জমে যায়, তবে তা চেঁছে পরিষ্কার করলে লবণাক্ততা কমে যাবে। অনেক সময় লবণ পরিষ্কার করার পর অন্যস্থান থেকে অলবণাক্ত মাটি এনে ভরাট করা হয়। পানির সঙ্গে লবণ ওঠে আসার ফলে কয়েক দিন পর জমি আবার লবণাক্ত হয়ে পড়ে। এই পদ্ধতি সীমিত ছোট এলাকার জন্য প্রযোজ্য।

এছাড়াও বাষ্পায়ন হ্রাস পেলে অন্তর্ভূমি থেকে লবণ-ভূত্বকে ওঠে আসে না। এ জন্য মালচিং ও বিভিন্ন ধরনের বাষ্পরোধক ব্যবহার করে মাটির লবণাক্ততা কমানো যায়।

লবণাক্ততা কমাতে ভূগর্ভস্থ পানির উচ্চতা ৮-১০ ফুট নিচে থাকা উচিত। পানি নিষ্কাশনের দ্বারাই পানির উচ্চতাকে সুবিধাজনকভাবে নিচে রাখা যায়। পানি নিষ্কাশনের সুষ্ঠু ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য টালি নালা, খোলা নালা, আবৃত্ত নালা, কুয়া থেকে পাষ্প করে পানি বের করে দেওয়া যায়।

এছাড়া প্লাবন সেচের মাধ্যমে লবণজাতীয় পদার্থগুলোকে পানিতে দ্রবীভূত করা হয় ও প্লাবনের মাধ্যমে এই দ্রবীভূত লবণগুলোকে ধুয়ে জমি থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়। এরূপ জমিতে সমন্বিত রেখা বরাবর ছোট ছোটভাবে বিভক্ত করে নেওয়া হয় ও প্রত্যেক জমিতে আইল বেঁধে উঁচু করা হয়। এরপর ঢালে আড়াআড়িভাবে ভেলির মতো করে দেওয়া হয়। এরপর পানি সেচ করে প্রতিটি জমি ভালোভাবে প্লাবিত করে দিতে হয়। বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় জমির লবণ হ্রাস করার পর লবণ সহ্য করতে পারে এমন ফসল (ধান: বিআর-২৩, ব্রিধান-৪০, ব্রিধান-৪১, ব্রিধান-৪৭, তিল, চীনাবাদাম) চাষ করতে হবে। 

এছাড়া জৈব ও সবুজ সার মাটিতে প্রয়োগ করলে তা থেকে যে কার্বন-ডাই অক্সাইড বের হয় তা লবণাক্ততা কমাতে সাহায্য করে। যেহেতু উপকূলীয় এলাকার লবণাক্ত পানি দ্বারা বাগদা চিংড়ি চাষের ফলে লবণাক্ততা বাড়ছে, তাই এর পরিবর্তে মিষ্টি পানির গলদা চিংড়ি চাষ করা যেতে পারে। এভাবে বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে লবণাক্ত মাটিকে চাষাবাদের উপযোগী করে তোলা যায়।

লবনাক্ততার সম্ভাবনাকেও আমরা কাজে লাগাতে পারি। লবণ সহ্য করতে পারে এমন ধান ব্রি ধান-৪৭ ও বিনা ধান-৮ কৃষক পর্যায়ে রয়েছে। এ ধান সর্বোচ্চ ১২ ডিএস/এম মাত্রার লবণ সহ্য করতে পারে। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে দক্ষিণাঞ্চলের বেশিরভাগ মাটির লবণের মাত্রা ১৬ বা তার বেশি হয়। ফলে ওইসব এলাকায় এ ধানের আবাদ অলাভজনক হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে আগামীতে অধিক মাত্রার লবণ সহ্য করতে পারে এমন ধানের জাত উদ্ভাবন শেষ পর্যায়ে রয়েছে।

পরিশেষে, দেশের উপকূল অঞ্চলে যে হারে লবণাক্ততা দিন দিন বেড়ে চলেছে সেই হারে প্রতিকারের ব্যবস্থা নেই। বরং কৃত্রিম উপায়ে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ত পানি দ্বারা বাগদা চিংড়ি চাষের ফলে লবণাক্ততা আরও বাড়ছে। এ পরিস্থিতিতে যত দ্রুত লবণাক্ততা দূরীকরণে সমন্বিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়, ততই মঙ্গলজনক। 

এমতাবস্থায়, সরকারি উদ্যোগেই পুকুর খনন ও বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। যদি এই লবণাক্তাতার অভিশাপ থেকে কৃষিকে না বাঁচানো যায়, তবে যেমন ধসে পড়বে কৃষিসমাজ, তেমনি দেশের অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি। তাই এ ব্যাপারে সরকারের যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

লেখক: শিক্ষার্থী, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।

ববি/মাহি

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়