ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

স্মৃতিতে ভারতেশ্বরী হোমস ও পোশাক

নাসরীন সুলতানা হুমা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:২০, ৩০ নভেম্বর ২০২০  
স্মৃতিতে ভারতেশ্বরী হোমস ও পোশাক

দেশের পিছিয়ে পড়া নারী শিক্ষার প্রসারে দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা তার পিতামহী শ্রীমতী ভারতেশ্বরী দেবী’র নামানুসারে প্রতিষ্ঠা করেন ভারতেশ্বরী হোমস বা বি. হোমস। টাঙ্গাইল জেলার লৌহজং নদীর কূল ঘেঁষে অবস্থিত মির্জাপুর উপজেলার একটি আবাসিক স্কুল ও কলেজ।

আমি ভারতেশ্বরী হোমসের ১৯৮১ সালে এসএসসি ব্যাচের ছাত্রী। সুদীর্ঘ ৪২ বছর আগে ভারতেশ্বরী হোমস ছেড়ে এসেছি আমি। ভারতেশ্বরী হোমসে আমার অবস্থানকাল ছিল মাত্র সারে তিন বছরের। সে সময়ের সুমধুর স্মৃতিময় ওই দিনগুলোই আমার মানসপটে আজও সমহীমায় সমুজ্জ্বল।

ভারতেশ্বরী হোমস নিয়ে লেখার মতো অনেক অনেক আনন্দময় সুখস্মৃতি হৃদয়ের মণিকোঠায় ঠাসাঠাসি করে বসবাস করে আসছে সুদীর্ঘ ৪২/৪৩ বছর ধরেই। আমার জীবনে যে কয়জন মানুষ এবং অসম্ভব ভালোবাসার যে সব স্মৃতি জড়িয়ে আছে তার মধ্যে ভারতেশ্বরী হোমস এবং এর সঙ্গে জড়িত মানুষগুলো অন্যতম।

দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা শুধু নারী শিক্ষা প্রসারের জন্যই ভারতেশ্বরী হোমস প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এমনটা ভাবার কোন অবকাশ নেই। মাতৃভক্ত এই মানুষটির চোখের সামনে দেখেছেন মেয়েরা সমাজে কতটা অবহেলিত। শিক্ষাসহ সামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্রেই তারা নিগৃহীত। এ থেকে বের হওয়ার একমাত্র উপায় হিসেবে নারী শিক্ষার প্রসারই যথেষ্ঠ নয়। সেটা তিনি মনেপ্রানে বিশ্বাস করতেন। তাই মেয়েদের সুশিক্ষার পাশাপাশি তাদেরকে সর্বগুণে গুণান্বিত করে তোলার উপরও গুরুত্বারোপ করেছিলেন। পোশাক-আশাক, আচার-আচরণে কেউ যেন কারোর মন কষ্টের কারণ না হয় সে জন্য তিনি সবার জন্য একই ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিলেন। যা আজও একই ভাবে চলছে।  

একটি আবাসিক স্কুলের ছাত্রী হিসেবে ভারতেশ্বরী হোমসের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় আমরা যে সব পোশাক পরিচ্ছদ পরিধান করতাম তা নিয়েই আমার আজকের লেখা। বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিধানের জন্য আমাদের ছিল আলাদা আলাদা পোশাক পরিচ্ছদ। আর এই পোশাকের সিংহভাগই ভারতেশ্বরী হোমসের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় তৈরি করে হোমসের সব ছাত্রীকে সরবরাহ করা হতো।

প্রতি বছর গ্রীষ্মের ছুটি কাটানোর জন্য যখন আমরা নিজ নিজ বাড়িতে চলে যেতাম সেসময় ঐ বন্ধের অবসরে ভারতেশ্বরী হোমস কর্তৃপক্ষ তাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় নিজস্ব ডিজাইন ফেব্রিক্সের সমন্বয়ে নিজস্ব দর্জি দিয়ে আমাদের পোশাকগুলো তৈরি করে রাখতো। আর এর জন্য তাদের কাছে কিছু স্ট্যান্ডার্ড সাইজের মাপ থাকতো। বেশি ছোট, ছোট, মাঝারি, বড়, একস্ট্রা বড়, ইত্যাদি। তবে কারও জন্য যদি ভিন্ন কোনো প্রয়োজন হতো তবে সেই বিশেষ ধরনের পোশাকের ব্যবস্থাও ছিল তাদের। এর ফলে সারাবছর ভারতেশ্বরী হোমসে থাকাকালে পোশাক পরিচ্ছদ নিয়ে আমাদের বা অভিভাবকদের কোনো টেনসন, দায়িত্ব বা ঝামেলা কোনোটাই থাকতো না।

ভারতেশ্বরী হোমস কর্তৃপক্ষ নিজেদের তত্ত্বাবধানে ওগুলো তৈরি করতো বিধায় অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি নান্দনিক বিষয় শুরুতেই শতভাগ নিশ্চিত হয়ে যেত। আর তা হলো আমাদের পরিধেয় পোশাকের মাপ, ফেব্রিক্স, রঙ, ডিজাইন এবং কোয়ালিটি। যদি ছাত্রীদের অবিভাবকদের তত্ত্বাবধানে এটা ছেড়ে দেওয়া হতো তাহলে সেক্ষেত্রে পোশাকের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো একই রকম রাখা সম্ভব হতো না। আর এর ফলেই ভারতেশ্বরী হোমসে আমাদের মাঝে দৃশ্য বা অদৃশ্যমান কোনো ভেদাভেদ সৃজনের অবকাশ ছিল না, আর হতোও না। তাই ভারতেশ্বরী হোমসের ছাত্রীদের পোশাকের কথা বলতে গেলে সবার আগে বলতে হয় যে, ছোট-বড় ধনী-গরীব সবাই মিলে একই পোশাক পরিধান করতে হয়। এরফলে ধনী, মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত বা এতিম মেয়েটির মধ্যে কোন ভেদাভেদ থাকতো না। হোমসে পড়াকালে কখনই এই ভেদাভেদ আমাদের কারো চোখে পড়েনি।  আর এটাই ভারতেশ্বরী হোমস কর্তৃপক্ষের সবচেয়ে বড় একটি স্বার্থকতা। ধনী গরিব জাত-পাত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আমাদের একই রূপে রূপায়িত করার এই শক্ত সুন্দর কাজটি আজও অনায়াসে করে চলেছে  প্রাণপ্রিয় জ্যাঠামনির ভারতেশ্বরী হোমস কর্তৃপক্ষ।

দুই মাসের গ্রীষ্মের ছুটি কাটিয়ে যখন আমরা ভারতেশ্বরী হোমসে ফিরতাম তখন যার যার প্রয়োজনীয় সংখ্যক পোশাক সরবরাহ করা হতো। ছুটি শেষে পরবর্তী ১০ মাস হোমসে থাকাকালে পরিধানের জন্য ৬-টি সাদা ড্রেস, ৪-টি সাদা সেমিজ, ২-টি নেভি ব্লু-টিউনিক, ৪-টি সাদা ব্লাউজ, ২-টি রয়েল ব্ল্যাক ড্রিলের স্কাট, ৩-টি সাদা রঙের বিছানার চাদর, ২-টি সাদা রঙের বালিশের কভার, ইত্যাদি।

নিচের ক্লাসের ছাত্রীদেও ক্লাসে পরার জন্য সাদা বেল্টসহ একটু ঢিলেঢালা ড্রেস দেওয়া হতো। ওরা ক্লাসে বড়দের মত টিউনিক-ব্লাউজ পরতো না। এ ছাড়াও ২/১-টি বিশেষ ধরণের ড্রেসও কিন্তু সরবরাহ করা হ’তো। যেমন আটটি গ্রুপে বিভক্ত পুরো ড্রিল দলের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য যে মেয়েটি থাকতো তার জন্য এবং ড্রিল মাস্টার হিসেবে আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় ‘কালু দিদি’র’ জন্য সাদা ফুল প্যান্ট ও সাদা ফুল হাতা সাফারি ইত্যাদি সরবরাহ করা হতো। এটা শুধু তাদের জন্যই বরাদ্দ থাকতো। কারো কোনো পোশাক হারিয়ে, ছিড়ে বা অন্য কোনো কারণে নষ্ট হয়ে গেলে সেক্ষেত্রে তার চাহিদামতে বিষয়টি যাচাই করে তাকে তা সরবরাহ করা হতো।

গ্রীষ্মের ছুটি কাটানোর জন্য বাড়ি যাওয়ার আগে আমরা নিজেদের পোশাকগুলোর ধরন অনুযায়ী সংখ্যা উল্লেখ করে একটি তালিকা তৈরি করে আমাদের বিছানার চাদর দিয়ে পোটলা বেঁধে কর্তৃপক্ষের কাছে জমা রেখে আসতাম। তবে সারা বছর পরার পর যে পোশাক গুলো নষ্ট যেতো সেগুলো আলাদা করে জমা দিতে হয়। ওই পুরনো কাপড়গুলো কর্তৃপক্ষ ধুয়ে গুছিয়ে আলাদা করে রেখে দিতো।

ছুটি শেষে আমরা যখন ফিরে আসতাম তখন আমাদের নতুন ড্রেসের সঙ্গে প্রত্যেককে আলাদা করে ওই পুরনো কাপড়গুলোও সরবরাহ করা হতো একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে। চারতলা বিশিষ্ট প্রসাদসম ওই সুবিশাল ভবনের প্রতিটি ঘর দুয়ার, জানালা, দরজা, সুবিশাল বারান্দা সিঁড়ি, শ্রেণিকক্ষ, লাইব্রেরি, সায়েন্স ল্যাব, টিভি রুম, ডাইনিং হল, রান্না ঘর, ওয়াসরুম, ড্রেন ইত্যাদি ঘষে মেজে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার কাজে ব্যবহার করা হতো ওই পুরনো কাপড়গুলো।

পোশাকের গল্প বলার সঙ্গে সঙ্গে অবধারিত ভাবেই চলে আসে খুব সুন্দর আরেকটি বিষয়। তা হচ্ছে এই যে আমরা প্রায় ১,২০০/১,৩০০ ছাত্রী একই ধরনের পোশাক পরে থাকতাম তাতে কিন্তু কারো পোশাকের সঙ্গে কারোটা মিশে যেতো না।  কারণ ধরণ ভেদে প্রতিটি পোশাকের সংখ্যা উল্লেখ করে এর প্রতিটি ড্রেসের গলার পেছনে সুই আর রঙ্গিন সুতো দিয়ে যার যার নাম বা নামের আদ্যাক্ষর লিখে রাখা হয়। যেমন "হুমা-ড্রেস-১" বা "হুমা-টিউনিক-২" ইত্যাদি। স্বাভাবিক ভাবেই ভারতেশ্বরী হোমসেও একই ক্লাসে একই নামে একই বেডরুমে একাধিক ছাত্রী বসবাস করতো। তখন তাদের নামের ভিন্নতা অনুযায়ী পোশাকে সেলাই করে নাম লিখে রাখা হতো। তাই কখনো কারোটা অদল বদল হয়ে যেতো না বা হারিয়ে যেতো না। ধোপার পক্ষেও ওগুলো ব্যবস্থাপনায় কখনই কোন ত্রুটি হতো না।

কারো কোনো পোশাক নষ্ট হয়ে গেলে সে বিষয়টি জানিয়ে স্টোর সুপার শ্রদ্ধেয় ‘মিস বেগম’ এর কাছে চাহিদাপত্র দেওয়া হতো। তিনিই সব যাচাই করে সিদ্ধান্ত নিতেন। প্রত্যাশিত সাইজের পোশাক এভেইলেবল থাকলে তাৎক্ষণিক সরবরাহ করা হতো। আর রেডি না থাকলে অপেক্ষা করতে বলা হতো। পরবর্তীতে তা তৈরি করে সরবরাহ করা হতো। তবে তাৎক্ষণিকভাবে না থাকলে স্টোর থেকে সরবরাহ করতে দেরি হলে বা ওই পোশাকটির খুব জরুরি হলে ছাত্রীরা একে অপরকে নতুন ড্রেস ধার দিতো।

ভারতেশ্বরী হোমসের ছোট বড় কেউ কখনো নোংরা বা ছেড়া ড্রেস পরতো না। কারণ বড়রা নিজেরা নিজেদের কাপড় ধুয়ে নিতাম অন্যদিকে ছোটদের জন্য ধোপার ব্যবস্থাও ছিল। নিজেরা যখন ধুয়ে দিতাম তখন কাপড়ে মার দিতাম। নীল দিতাম। লম্বা বারান্দায় টানানো দড়ির উপর ধোয়া কাপড় শুকোতে দিতাম। বৃষ্টির দিনে ঘরের মধ্যে দড়ি বেঁধে সেগুলো শুকোতে হতো। আর নিজেরা যেহেতু ইস্ত্রি করতে পারতাম না আবার ধোপার কাছে ইস্ত্রি করতে দিলে একটু বেশি সময় লাগতো তাই ঝামেলা এড়ানোর জন্য মাঝে মাঝে আমরা ধোয়া শুকনো কাপড় ভাঁজ করে নিজেদের তোষকের নিচে রেখে দিতাম। এতে করে কাপড়গুলো যদিও ধোপাদের ইস্ত্রি করা কাপড়ের মত অত টান টান হতো না কিন্তু ঠিকই পাট পাট করে ভাজ হয়ে থাকতো। তা দিয়ে অনায়াসে কাজ চালানো যেতো। কারণ ভারতেশ্বরী হোমসে নোংরা এবং ইস্ত্রি বিহীন কোঁকড়ানো কাপড় পরা নিষেধ ছিল। আর এমনি করেই ভারতেশ্বরী হোমসের মেয়েরা সেখানে অধ্যায়নকালে ছোটবেলা থেকেই ধীরে ধীরে ছোট বড় সবাই নিজেরাই নিজেদের সব কাজ করতে শিখে যেতো।  

যখন সবাই ঝকঝকে তকতকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ড্রেসগুলো সম্পূর্ণভাবে গুছিয়ে পরতাম তখন আমরা যেন ভালোলাগার অন্য এক জগতে চলে যেতাম। একদম স্মার্ট এলিগ্যান্ট। দেখে মনে হতো বেহেশতের বাগানের শুভ্র সাদা নিষ্পাপ কোন ডানাকাটা পরীর দল।

ঘরে পরার পোশাক

ভারতেশ্বরী হোমসে রুমে এবং রুমের বাইরে সাধারণভাবে যে কাপড়টি আমরা পরতাম সেটার নাম ছিল “ড্রেস।” সেটার রঙ ছিল ধবধবে সাদা। হাফ হাতা। হাঁটুর কিছু নিচ পর্যন্ত ছিল এর দৈর্ঘ্য ব্যাপ্তি। এর সঙ্গে সেমিজ পরা ছিল শতভাগ বাধ্যতামূলক।

এই ড্রেসটা আমরা ক্লাস শেষে যার যার রুমে গিয়ে পরিবর্তন করে নিতাম। এটা পরেই চলতো সারাবেলা, দুপুরের খাবার, অবসর, বিকেলের চা-চক্র, বিকেলের শরীর চর্চা, সন্ধার স্টাডি (পড়াশুনা), রাতের খাবার ও এটা পড়েই ঘুমাতে যাওয়া। দুপুর বেলা এরই মাঝে স্নান সেরে ওই ড্রেস পরিবর্তন করে নিতাম। মোটাদাগে বলা যায় ওই “ড্রেস”ই ছিল আমাদের সারাদিনের অধিকাংশ সময়ের পোশাক। বিকেলের শরীর চর্চা ও সন্ধ্যার স্টাডির সময় ওই পোশাকে থাকলেও বাধ্যতামূলকভাবে পায়ে থাকতো হাটু অব্দি সাদা মোজা আর ছেলেদের জুতোর মতো কালো চামড়ার শক্ত জুতো। আমরা ক্লাসে, বিকেলের স্টাডিতে, মাঠে বা স্টেডিয়ামে ফাইনাল ড্রিল করার সময় আমরা এই কালো জুতো পরে থাকতাম।

শ্রেণিকক্ষের পোশাক 

শ্রেণিকক্ষে আমরা যে ড্রেস পারতাম সেটার নাম ছিল “টিউনিক-ব্লাউজ।” সাদা সেমিজসহ সাদা রঙের হাফ হাতা শার্ট (যাকে আমরা বলতাম ব্লাউজ) পরতাম। আর ওই ব্লাউজের উপরে পারতাম ডার্ক নেভি ব্লু-রঙের অত্যন্ত উন্নত মানের কাপড়ের  তৈরি টিউনিক। এই টিউনিকগুলো হাঁটুর নিচ অব্দি লম্বা হতো। কোমড়ে পরতাম ওই টিউনিকের মতো একই কাপড়ের তৈরি চওড়া বেল্ট। পায়ে থাকতো হাঁটু অব্দি লম্বা সাদা মোজা আর কালো চামড়ার জুতো। পরিপাটি করে চুল আঁচড়িয়ে বাঁধতে হতো দুটো বেণী। লম্বা দুটো বেণী করে সেটাকে ফোল্ড করে কালো ফিতা দিয়ে বাধা হ’তো। ঐ বেণীটাকে বলা হতো কলা বেণী। ছোট চুলের ক্ষেত্রে অবশ্য শুধুমাত্র দুটো বেণীতেই চলে যেতো।

আর বাচ্চারা তাদের ছোট ছোট চুলে দুটো ঝুটি বাঁধতো। অবশ্য দুএকজন বাচ্চার লম্বা চুল থাকলে ওদের রুম ক্যাপ্টেন বা কেয়ার টেকার দিদি/মাসীরা ওদেরকে বেণী করে দিতেন। বাচ্চারা ওদের ড্রেসের সঙ্গে পরতো সামনে বেল্টেওয়ালা কালো বেবি সু।

বাচ্চারা যে সব বেড রুমে থাকতো সে গুলোর প্রতিটি রুমে দুজন করে সিনিয়র মেয়ে রুম ক্যাপ্টেন হিসেবে দায়িত্ব পালন করতো। আর ২/৩ জন করে কেয়ার টেকার থাকতেন। আমরা উনাদের নাম ধরে সাথে "দি" বা "দিদি" বা "মাসী" সম্মোধন করতাম। যেমন "ইতিদি" "রেণুদি" "কল্পনাদি" "চিনি মাসী"-ছিলেন এমন আরও অনেক অনেক জন।

রুম ক্যাপ্টেন আর ওই দিদি/মাসীরা ছোট ছোট বাচ্চাদের সকালে ক্লাসের জন্য তৈরি হতে প্রয়োজনে সহযোগিতা করতেন। তবে বলাই বাহুল্য যে, বড়দের মত বাচ্চারা খুব দ্রুতই ফুল ড্রেসিং করতে শিখে যেতো। দু'একজনের হয়তো কালে ভদ্রে টুকটাক অসুবিধা হলে দিদিরা সহযোগিতা করতেন।

এত গেলো গ্রীষ্ম বর্ষা শরতের ড্রেসআপ। হেমন্ত আর শীতে কিছু সংযোজন ছিল। টিউনিকের উপর নেভি ব্লু /কালো ফুল হাতা সোয়েটার। তবে শীত/গ্রীষ্ম কোন সময়েই পা ঢাকার জন্য কিছু থাকতো না। কারণ হাঁটু অব্দি লম্বা ড্রেস বা টিউনিক বা স্কাটের পরেই থাকতো লম্বা মোজা।

শরীর চর্চার পোশাক

এবার বলবো ড্রিল বা শরীর চর্চা প্রদর্শনের জন্য নির্ধারিত ড্রেসের কথা। সেমিজসহ সাদা হাফহাতা টপস, যেটাকে হোমসের ভাষায় বলা হতো ব্লাউজ পরতাম উপরে। আর নিচে অত্যন্ত উন্নত মানের স্যুটের কাপড়ে তৈরি করা রয়েল ব্ল্যাক স্কাট পরতাম। কি যে সুন্দর ছিল ড্রিলের ওই ড্রেসটি।  শুধু হোমসের মেয়েরাই জানে ওটার সৌন্দর্য, মূল্য বা কদর। ওটার আভিজাত্য আর নান্দনিকতা। ওই ড্রেসটা পরার আনন্দ, আরাম ছিল অন্যরকম।

কারণ দিনে বা রাতে স্কুল মাঠে বা জাতীয় স্টেডিয়ামে নানা ধরনের নাচের মুদ্রা সমৃদ্ধ শরীর চর্চা করতে ঠিক ওই রকম লাগসই একটি ড্রেস “ওয়াজ এ মাস্ট’’। যাইহোক ওই ড্রেসের সঙ্গে ছোট ছোট সোনাপাখি ছাত্রীরা তাদের চুলে দুই ঝুটি আর বড় ছাত্রীরা চুলে দুটা কলা বিনুনী বাঁধতাম ঠিকই কিন্তু এই বেলায় শ্রেণিকক্ষের জন্য চুলে ব্যবহৃত কালো ফিতার যায়গাটা দখল করে নিতো "সাদা ফিতা।"

বাচ্চাদের ড্রিলের জন্য বড়দের মতো রয়েল ব্ল্যাক রঙের পরিবর্তে ছিল লাল রঙের স্কাট আর সাদা ফুলহাতা ব্লাউজ। ওদের জন্য ড্রিলের থিমের সঙ্গে মিলিয়ে হাতে বেঁধে দেয়া হতো রঙ্গিন ফিতা বা অন্য কোন পতাকা বা রুমাল বা পাখা ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের প্রোব। এছাড়াও মাঠের উপর বাংলাদেশের ম্যাপ এঁকে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর আর সাগরের জলরাশীর উন্মত্ত উত্তাল ঢেউ ফুটিয়ে তুলতে/আঁকতে বড় মেয়েদের জন্য সরবরাহ করা হতো হালকা আকাশী রঙের একটি অ্যাপ্রন।

শরীর চর্চার আগে সম্পূর্ণ ওই ড্রেস পরে তৈরি হবার পর কি যে সুন্দর লাগতো সবাইকে, আহা আজও আমার লোভ হয় যদি আবার একবার সুযোগ পেতাম ড্রিলের ড্রেস ওইভাবে নিজেকে সাজিয়ে তুলতে!

ড্রিলের ড্রেসের কথা বলতে যেয়ে অবধারিত ভাবেই একটি অবিচ্ছেদ্য ঘটনা চলেই আসে, যা শেয়ার না করলেই নয়। আর তা হলো কোন জাতীয় বা আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য যখন আমরা ঢাকাস্থ জাতীয় স্টেডিয়ামে সদলবলে যেতাম সে সময়ের একটি সুন্দর স্মৃতি। প্রায় ৪০০/৫০০ জন (সঠিক সংখ্যা মনে নেই) ছাত্রী একত্রিত হয়ে ৭/৮-টি বড় বড় বাসে চেপে আমরা যখন স্টেডিয়ামে যেতাম তখন মাঠে নামার আগে এই বিশাল সংখ্যক ছাত্রীদের ফ্রেস হয়ে ড্রিলের ড্রেস পরে তৈরি হওয়ার জন্য যে বিশাল আয়োজন প্রয়োজন হতো তার জন্য স্টেডিয়ামের জিমনাসিয়াম হলটি আমাদের জন্য বরাদ্দ রাখা হতো। আহা কি যে মজা হতো তখন! সবাই মিলে ফ্রেস হয়ে ড্রিলের জন্য তৈরি হতাম।

তাছাড়াও স্টেডিয়ামে যাওয়ার সময় আমরা আমাদের গানের খাতা বা ডাইরি সঙ্গে নিতাম। এতটা দীর্ঘ পথে বাসে বসে সবাই মিলে গলা ছেড়ে গান গাইতে বা অন্তাক্ষসরি খেলতাম। গানের পর গান। একটার পর আরেকটা। যত বড় পথ তত লম্বা গানের গানের তালিকা। মূল্যবান সেই আনন্দ অনুভূতির হাজারো কথামালা মনের বাক্সে লুকিয়ে গুছিয়ে রাখা আছে দীর্ঘ যুগ যুগ ধরে। আজ সেসব কথামালা কাগজ-কলমে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়। তবে ভারতেশ্বরী হোমসের প্রতিটি ছাত্রীর অন্তরেই জাগরুক হয়ে আছে সেসব অমূল্য আনন্দ স্মৃতিকথার শতদল।

ড্রিলের ড্রেস আপ করতে যেয়ে আরেকটা বিষয় নিয়ে খুব মজা হতো। আর তা হলো সবার মাথার লম্বা লম্বা চুলে দুটো করে কলা বেণী করা নিয়ম। সবাই আমরা চেষ্টা করতাম স্টেডিয়ামে পা রাখার আগে কে কত বেশি সুন্দর করে চুল বাঁধতে পারে। মজার ব্যাপার হলো, আমি কিন্তু বরাবরই খুব সুন্দর করে দুই বেণী বাঁধতে পারতাম নিজের ও অন্যের, উভয়ের ক্ষেত্রেই। আর সে কারণে স্টেডিয়ামে যাবার প্রস্তুতি হিসেবে ছোট ছোট অনেক আপুরাই আমাকে অগ্রিম বুকিং দিয়ে রাখতো স্টেডিয়ামে গিয়ে দুটো কলা বেণী বেঁধে দেয়ার জন্য। প্রতিবারই স্টেডিয়ামের জিমনেসিয়ামে বসে কতজনের চুলে যে কলা বেণী বেঁধে দিয়েছি আমি, তার হিসেব আজ আর মনে নেই।

রান্না ডিউটির পোশাক

রান্নার ডিউটি নিয়ে আমি এরমধ্যেই লিখেছি। পোস্ট করেছি। ওখানে রান্নার ডিউটির সময় আমরা যে ড্রেস পরতাম তা নিয়েও লিখেছি। তবে ‘‘ভারতেশ্বরী হোমসের পোশাক পরিচ্ছদ’’ নিয়ে লিখতে গিয়ে এখানেও এই বিষয়টি অবধারিতভাবে চলেই আসে। যাইহোক, রান্নার ডিউটির সময় হোমসের মেয়েরা ওই দিন পড়তো রঙ্গিন কাপড়ে তৈরি স্কাট (এটাই একমাত্র ড্রেস যা আমরা নিজ নিজ বাসা থেকে বানিয়ে নিয়ে যেতাম) আর হোমস থেকে সবরাহকৃত সাদা টপস। পায়ে থাকতো স্পঞ্জের স্যান্ডেল।

নাটক/সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পোশাক

ভারতেশ্বরী হোমসে বছরজুড়েই নাটক থিয়েটার হতো। বাৎসরিক নাটকসহ বিভিন্ন জাতীয়, আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানের জন্য নাটক তৈরি করা হতো। ওই সব নাটক থিয়েটারে অংশগ্রহণের সময় সাধারণত ধর্মভিত্তিক বা রাজকীয় কল্পনাট্য রম্যনাট্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে ভারতেশ্বরী হোমসের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পোশাক সরবরাহ করা হতো। বিশেষ কোনো স্টাইলে পোশাক পরিয়ে দেয়া (ধুতি পরানো, নাচের জন্য বিশেষ কোন কুচি দিয়ে শাড়ি পরানো, ইত্যাদি), চুল বাঁধা বা মেক আপ এগুলোও তারাই করে দিতেন।

আমাদের শ্রদ্ধেয় জ্যাঠামনির স্নেহের পুত্র ভবানী প্রসাদ সাহা রবী’র সুযোগ্য অর্ধাঙ্গিনী ছিলেন আমাদের সবার প্রিয় ‘শ্রীমতী সাহা’ আমাদের বৌদীমণি। স্বনামধন্য জমিদার পরিবারের পুত্রবধূ হিসেবে তার ছিল অত্যন্ত মূল্যবান সব দেশি-বিদেশি শাড়িসহ অন্যান্য সব পোশাক। যা তিনি খুব অল্পই পরতে পেরেছিলেন। বিয়ের খুব অল্প সময়ের মধ্যেই অকাল বৈধব্য অত্যন্ত নিষ্ঠুর হাতে তাকে জীবনের সব রঙ থেকে করেছিল বঞ্চিত।

হোমসে যে সব নাটক মঞ্চায়িত হতো সেখানে শ্রীমতী বৌদিমণির সব মূল্যবান শাড়িগুলো দিয়ে সাজানো হতো আমাদের। সাথে থাকতো নাটকের প্রয়োজনে তৈরি করা নানান ধরনের কসটিউম। "মেঘদূত", "ক্ষুধিত পাষাণ", "জুতা আবিষ্কার" ইত্যাদি সব নাটকের জন্য রাজকীয় পোশাক। যেমন, শিবের পোশাক। বিঞ্চুর পোশাক। মণিপুরিসহ বিভিন্ন সব নাচের পোশাক। গোপাল ভারের পোশাক। রাজার পোশাক। বুড়ি-বুড়োর পোশাক। সাদা চুল, জটা চুল ইত্যাদি।

এ ছাড়াও ‘ক্রস রোডে ক্রস ফায়ার’-এর মতো নানা ধরনের স্বনামধন্য নাটকে আমরা সাধারণত নিজেদের প্যান্ট শার্ট ধুতি শাড়িসহ অন্যান্য পোশাক পরতাম। আমাদের হাতে ধরে সাজিয়ে দিতেন "বাদলদা" সহ অন্যান্য শিক্ষিকারা। ড্রেস আপ। মেকআপ। সব, সব।

"ড্রেস ড্রামা" থেকে শুরু করে" ফাইনাল মঞ্চায়ন" পর্যন্ত পদে পদে চুলচেরা পর্যবেক্ষণ বিশ্লেষণের মাধ্যমে "এ-টু জেড" গাইড করতেন তারা আমাদের।

বিভিন্ন পার্বণের পোশাক

ভারতেশ্বরী হোমসে বছরব্যাপী ধর্মভেদে বিভিন্ন ধর্মীয় নানা ধরনের আচার অনুষ্ঠান পালন করা হয়। তখন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমাদের নিজ নিজ বাসা থেকে নিয়ে আসা রঙ্গিন পোশাক পরতাম আমরা। শাড়ি সেলোয়ার কামিজ টিউনিক ড্রেস লেহেঙ্গা স্কাট সেট ইত্যাদি। অবশ্য কিছু কিছু পার্বণে প্রয়োজন ভেদে একই ধরনের পোশাক পরতে হলে হোমস কর্তৃপক্ষ তা সরবরাহ করতো।

শিক্ষক-শিক্ষিকাদের পোশাক

ভারতেশ্বরী হোমসের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরর পোশাকটি ছিল অত্যন্ত দৃষ্টি নন্দন একটি পোশাক। এতে রয়েছে বিরল এক ভিন্নতা। আপন স্বকীয়তায় সমুজ্জ্বল। শ্রদ্ধেয়া শিক্ষিকাগণ পরতেন হালকা বা গাঢ় রঙের রঙ্গিন পাড়ের সাদা শাড়ি। কুঁচি দিয়ে ভাজ করা আঁচল সেইফটিপিনে আঁটা থাকতো। উপরে পরতেন ডাক্তারদের মতো সাদা অ্যাপ্রন। পেছনে কোমড়ে থাকতো সাদা বেল্ট। চুলে বাঁধতেন লম্বা সুন্দর একটি বেণী। কেউ কেউ খোঁপাও বাঁধতেন।

আর শ্রদ্ধেয় শিক্ষকরা সাদা হাফহাতা বা ফুল হাতা কলারওয়ালা সাদা শার্ট এবং সাদা প্যান্ট। তার উপরে পরতেন শিক্ষিকাদের মতো একই রকমের সাদা অ্যাপ্রন। কোমড়ে থাকতো সাদা বেল্ট।

পরিপাটি পোশাক পরিচ্ছেদ দেখে দেখে কেটেছে আমাদের ছেলেবেলা। ফলে আমাদের মনেও পরেছে এর সুন্দর প্রভাব। ভারতেশ্বরী হোমসের ছাত্রী হিসেবে আমরা যে যেখানেই থাকি না কেন, আমরাও কিন্তু আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে একইভাবে নিজেদের পাট পাট করেই গুছিয়ে রাখার চেষ্টা করি। একটু খেয়াল করলেই দেখবেন যে, দূর থেকে দেখেও হোমসে মেয়েদের আপনি ঠিক আলাদা করতে পারবেন সহজেই।

অন্যদের পোশাক

ভারতেশ্বরী হোমসের দৈনন্দিন প্রশাসনিক দাপ্তরিক আনুষ্ঠানিক ইত্যাদি কাজে হোমসের শিক্ষক ছাত্রীদের সহযোগীতা জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে নিয়োজিত ছিলেন বেশ অনেকজন সহকর্মী।

হোস্টেলের মেয়েদের নানা ধরনের সহযোগিতার জন্য ছিলেন যারা তাদেরকে আমরা সাধারণত নামসহ "দি" "দিদি" "মাসী" ইত্যাদি ডাকতাম। উনাদের প্রত্যেকেই রঙ্গিন পারের সাদা শাড়ি পরতেন। তবে তাদের মধ্যে যারা বিধবা ছিলেন তারা পাড ছাড়া সাদা থান বা চিকন পারের সাদা থান পরতেন।

এছাড়াও ভারতেশ্বরী হোমসের প্রাত্যহিক কাজ এবং কিছু স্পেসাল কাজের জন্য বেশ কয়েকজন পুরুষ কর্মীও ছিলেন। আমরা তাদের নাম ধরে "দাদা" ডাকতাম। যেমন- ড্রাম বাজাতে "ভেলু দা",   বংশী বাদক "খগেনদা", ধোপা "রতন দা", সুপার "নীরঞ্জণ দা" ও "নারায়ণ দা"সহ আরও অনেকে। ভেলুদাসহ অন্যান্যরা সাদা পায়জামা আর পাঞ্জাবি পরতেন। অপরদিকে ধোপা "রতন দা", সুইপার "নীরঞ্জণ দা" ও "নারায়ণ দা" উনারা পরতেন খাকি কাপড়ের তৈরি হাফ বা ফুল হাতা শার্ট প্যান্ট।

লেখক: যুগ্ম সচিব, অর্থ বিভাগ, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। প্রাক্তন ছাত্রী, বি. হোমস, ১৯৮১ এসএসসি ব্যাচ।

ঢাকা/হাসনাত/মাহি

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়