ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

উত্তরের জেলাগুলোতে বাড়ছে চা চাষ

শেখ নাসির উদ্দিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৪৩, ২৪ জানুয়ারি ২০২১   আপডেট: ১৫:২৫, ২৪ জানুয়ারি ২০২১

বাংলাদেশে চায়ের চারণ ভূমি সিলেট হলেও এখন দেশের বিভিন্ন জায়গায় চা উৎপাদন হচ্ছে। এতে করে সেই অঞ্চলের অর্থনীতি যেমন পাল্টে যাচ্ছে, ঠিক সেইভাবে পাল্টে যাচ্ছে মানুষের জীবনযাত্রার মান। উত্তরের সমতল জেলা পঞ্চগড় এখন দেশের তৃতীয় বৃহত্তম চা উৎপাদন অঞ্চল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।

পঞ্চগড়কে অনুসরণ করে চা চাষে এগিয়ে যাচ্ছে পার্শ্ববর্তী ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী ও লালমনিরহাটও। এক সময়ের পতিত গো-চারণ ভূমি এখন চায়ের সবুজ পাতায় ভরে উঠছে। তাই কৃষকের চোখে কেবল সোনালি দিনের হাতছানি।

আক্তার হোসেন। দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জ উপজেলার শতগ্রাম ইউনিয়নের ধূলাউড়ি গ্রামে ২৪০ শতক পতিত জমিতে গড়ে তুলেছেন চা বাগান। তিনি পেশায় একজন পল্লী চিকিৎসক। শীতের গোধূলি বিকেলে চা বাগানে দেখা মিলে তার।

চা চাষে তিনি কেন আগ্রহী হয়ে উঠলেন, সেটাই ছিল তার কাছে প্রথম প্রশ্ন। হাসি মুখে আক্তার হোসেন বলেন, ‘‘পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জের এক বন্ধুর সঙ্গে চায়ের আড্ডায় হঠাৎ সে তার চা বাগানের গল্পজুড়ে দিল। চার বিঘা জমিতে চার বছর ধরেই চা চাষ করে সে প্রথম বছরেই দুই লাখ টাকা আয় করেন। পরে ভাবলাম আমার কিছু পতিত জমি আছে, সেগুলোতে চা বাগান করাই যায়। 

বাড়ী এসে পড়ে থাকা জমি সাজিয়ে পঞ্চগড়ের ভোজনপুর থেকে ২৫ টাকা মূল্যের চারা নিয়ে আসি। প্রথমে ১২০ শতক জমিতে দুই লাখ টাকা ব্যয় করে বাগান শুরু করি। দুই বছরে বাগান থেকে পাঁচবার চা পাতা সংগ্রহ করেছি। তিনবার চা পাতা তুলে দুই লাখ টাকা বিক্রি করেছি। এখন আরো ১২০ শতক জমিতে নতুন করে চা গাছ রোপণ করেছি।  এই চারার দাম অনেক কম পড়েছে ৫ থেকে ৮টাকার মধ্যে। 

রোগ বালাই হলে পঞ্চগড়ের চা চাষিদের কাছ পরামর্শ পাই। অন্যান্য ফসলে যেমন শ্রমিক লাগে, বাগানে তার চাইতে একটু বেশি শ্রমিক লাগে। তবে ওই ফসলে তো আপনার প্রতিবছর বীজ রোপণ করতে হয়, এখানে সেটা নেই বলে ওই ফসলের চেয়ে লাভ বেশি। আমার বাগান দেখে অনেকে চা চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। আশেপাশে ছোট ছোট বাগান তৈরি হচ্ছে, আমি তাদের পরামর্শ দিচ্ছি।’’

আক্তার হোসেনের এই বাগানে কাজ করতে করতে চা বাগানের পরিচর্যা ভালোভাবে রপ্ত করেছেন কছিম উদ্দিন। আগে জেলায় জেলায় কাজের জন্য ঘুরতেন, এখন সারাবছর এই চা বাগানের কাজ করেন।

তিনি বলেন, ‘পঞ্চগড়ে গিয়ে কয়েকদিন দেখে ছিলাম আর বাকিটা কাজ করতে করতে শিখে ফেলেছি। এখন আর অন্য কাজ করি বলতে গেলে সময় পাই না। এখানেই সারাবছর কাজ করে দৈনিক মজুরি ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা আয় করি। বেশি কাজ থাকলে বাড়তি শ্রমিক নেই। এ কাজের প্রচুর চাহিদা। যেভাবে বাগান বাড়তেছে, সেইভাবে শ্রমিক নেই।’

একই উপজেলা ও ইউনিয়নের রাঙ্গালীপাড়া গ্রামের মনিরুল ইসলাম নাঈম। নিজের জমিতে কৃষি কাজ করেই সংসার চালান। কখনো ঠিক ফসলের দাম পান আবার কখনো গুণতে হয় ঘাটতি। ঘাম আর শ্রমের সঠিক মূল্য না পেয়ে হতাশায় দিন কাটছিল তার। একদিন শখের বসে পঞ্চগড়ে তার চাচার বাড়িতে ঘুরতে গিয়ে চাচার চা বাগান খুব ভালো লাগে তার। চাচাও দেখালেন লাভের আশা। তাই নিজের জমি এবং ১৭ বছরের জন্য ১০০ শতক প্রতি বিঘা ১১ হাজার টাকা করে লীজ নিয়ে শুরু করেন চা বাগান।

তরুণ এই চা চাষি বলেন, ‘‘ধান লাগিয়ে কোনো বছর দাম পাই আবার কোনো বছর খরচও উঠে আসে না। সেদিন থেকে ভাবলাম চা বাগান করি এতে করে ফসলের ভালো মূল্য পাবো আর একসঙ্গে মোটা টাকাও পাবো। এরপর চারা লাগানো শুরু করি চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা খরচ করে এই বাগান করি। এখানে মাটি উঁচু থাকায় চা চাষের জন্য উপযোগী। 

পঞ্চগড়ের আবহাওয়া সঙ্গে দিনাজপুরের আবহাওয়ার মিল আছে। চায়ের জন্য নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া সবচেয়ে ভালো। চা বাগান বেশি শুকনো রাখা যাবে না, এতে করে গাছ মারা যায়। আবার বাগানে বেশি পানিও রাখা যাবে না, এতে গাছ পচে যায়। অন্যান্য ফসলের মতো চা গাছেও রোগ বালাই হয়। মাকড়সা ধরে, মেন্দা পোকা, পাতায় রুডুস হয় এবং গাছের গোড়া পচন ধরে। যাদের কাছ থেকে চারা এনেছি, তারা আর ওই চাচার কাছ থেকে কীটনাশক বিষয়ে পরামর্শ পাচ্ছি। 

এখন বড় সমস্যা হচ্ছে অভিজ্ঞ শ্রমিকের সংকট। তেঁতুলিয়া থেকে শ্রমিক নিয়ে আসি, ফলে খরচ বেশি লাগে। এখন নিজেরা কাটি আর স্থানীয় শ্রমিক নিলে বাগানের ক্ষতি হয়ে যায়। একটা বাগান থেকে বছরে আটবার চা পাতা সংগ্রহ করা যায়। আমার বাগানের বয়স এক বছর। তবুও তিনবার চা পাতা সংগ্রহ করেছি। করোনার সময়ে পাতার দাম কম হওয়ায় বেশি একটা দাম পাইনি। ভবিষ্যতে বাগান আরো বড় করার জন্য ভালো প্লট খুঁজতেছি। ঠিকঠাক চা বাগান করতে পারলে আশাবাদী ভালো লাভবান হতে পারবো। এখনো স্থানীয়রা ফসলের সঙ্গে পরিচিত নয় বলে অনেকে হতাশাজনক কথা বলেন। কী চাষ করলো তার চাইতে বেগুন করলে ভালো হতো। সফল তো আর এক দিনে হওয়া যায় না। যেদিন সফল হবো, সেদিন অবশ্যই মানুষ অনুপ্রাণিত হবে।’’

লেখক: শিক্ষার্থী, ছাফদার আলী কলেজ।

টাঙ্গাইল/মাহি 

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়