ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স: মেডিক্যাল সায়েন্স ও সাইকোলজির এক ভিন্ন জগৎ
আনিকা তাসনিম সুপ্তি || রাইজিংবিডি.কম
মালিহা তাবাসসুম
মেডিক্যাল থ্রিলারের একটি ভিন্নধর্মী ধারা ফরেনসিক থ্রিলার। ‘ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স’ বইটির লেখক মালিহা তাবাসসুম, তিনি শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজে এমবিবিএস পড়ছেন। তার ভাষ্যমতে এই বইটি বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ ফরেনসিক থ্রিলার উপন্যাস। এর উৎসর্গ নিয়ে কথা না বললেই নয়। লেখক মালিহা তাবাসসুম উপন্যাসটি উৎসর্গ করেছেন মৃত বুয়েট শিক্ষার্থী 'আবরার ফাহাদ'-কে। ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর আবরার ফাহাদকে র্যাগিংয়ের নামে অসহ্য অত্যাচারের মাধ্যমে হত্যা করা হয়৷ তাই ফাহাদের স্মৃতির স্মরণে গল্পের অন্যতম প্রধান চরিত্রে 'আবরার ফাহাদ' নামটি ব্যবহার করেছেন।
প্রথমেই উপন্যাসের প্লট নিয়ে একটি কথাই বলবো, খুবই আকর্ষণীয় প্লট। উপন্যাসের কাহিনীর সাথে মিল রেখে এর নামকরণ যথার্থই হয়েছে৷ ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স কী? মনোবিজ্ঞানের ভাষায়, বিভিন্ন কারণে নিজেকে অহেতুক ছোট করে দেখার একধরনের জটিলতার নামই হচ্ছে ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স।
কাহিনি সংক্ষেপ
গল্পের শুরুতেই যেই চরিত্রটির সঙ্গে পরিচিত হয়েছি, সে হচ্ছে ‘কুহেলি’। সমাজের দৃষ্টিতে সুন্দরী নয় কুহেলি, তবে মানবিক দিক থেকে সে কতটা উঁচুতে অবস্থান করছে, তা ভাবার সময় নেই সমাজের। বাহ্যিক সৌন্দর্যহীনতার কারণে প্রতি মুহূর্তে নিজেকে অন্যদের চেয়ে ছোট মনে করে হীনমন্যতায় ভুগতে ভুগতে নিজের ভেতর কুঁকড়ে থাকত সে। খুব ছোট্টবেলা থেকেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনা কুহেলির পরবর্তী জীবনের ক্রনিক ডিপ্রেশনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ‘ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স’ নামক ডিজঅর্ডারকে সঙ্গী করে বড় হওয়া কুহেলি ছোটবেলা থেকেই বুঝতে পেরেছে সদা সুন্দরের পূজারি সমাজ তার বাহ্যিক সৌন্দর্যহীনতাকেই বড় করে দেখছে। গুমরে মরতে মরতে নিজের জগতে গুটিয়ে গিয়ে তার সঙ্গী হয় এক গাদা বই আর লেখালেখির অদম্য তৃষ্ণা। ক্রনিক ডিপ্রেশনের শিকার কুহেলি যখন চিকিৎসার ফলে কিছুটা স্বাভাবিক জীবনযাপন করা শুরু করে, তখনই নতুন নতুন কিছু ঘটনার মাধ্যমে সোশ্যাল বুলিং আর বডি শেমিং তার অনুভূতির মৃত্যু ঘটাতে থাকে।
উপন্যাসের পরের অংশ ঢাকা শহরে ঘটতে থাকা অদ্ভুত এক সিরিয়াল কিলিংয়ের গল্প। গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের নাকের ডগার উপর দিয়ে খুনী নির্বিঘ্নে একের পর এক খুন করে যেতে থাকে। প্রথমে প্রত্যেকটি খুনকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে মনে করা হলেও খুনগুলো যে একটা সিরিয়াল কিলিংয়ের অংশ এবং কোনো নির্দিষ্ট কারণে করা হচ্ছে, এটা খুনি নিজেই জানান দেয়! প্রতিটি খুন করার পর খুনি ক্রাইম দৃশ্যে "Mother Goose Treasury" নামে নার্সারির বাচ্চাদের একটা ছড়ার বই রেখে যায়। খুনের মোটিভ সম্পর্কে জানার জন্য বিস্তর অনুসন্ধান করতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয় গোয়েন্দা বিভাগকে।
প্রতিটি খুনের পর পাওয়া ছড়ার বইটির পৃষ্ঠায় পাওয়া যায় এলোমেলো কিছু শব্দ, প্রতিটা লাশের আশেপাশে লুকায়িত থাকে ঐতিহাসিক ফসিল। ধর্ম, বর্ণ, জাত, বয়স, উচ্চতা, লিঙ্গ, পেশা- কোনোকিছুর ভিত্তিতেই খুনগুলোকে সাজাতে পারে না সিআইডি অফিসাররা। এসময় তাদের সহায়তা করতে গল্পে আগমন ঘটে গোয়েন্দা বিভাগের ফরেনসিক ইনভেস্টিগেটর ডাক্তার 'আবরার ফাহাদ' এর। কখনো ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ুয়া ছোট ভাগ্নের মাধ্যমে ক্রাইম দৃশ্যে পাওয়া অ্যানাগ্রামের জট খুলতে সক্ষম হয়, কখনো বা তার বড় বোনের দেওয়া কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্যের ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ক্লু খুঁজে পায় আবরার। নিজের ডাক্তারি জ্ঞান ও তার বাস্তব প্রয়োগের সমন্বয় করে এগিয়ে নেয় অনুসন্ধান। গল্পের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র এএসপি ও গোয়েন্দা নিশাত নাহরিন অবন্তি। চঞ্চল স্বভাবের দুষ্টুমিষ্টি চোখের এই তরুণী স্কুল-কলেজ লেভেলের বিজ্ঞান, বলিউড মুভি ও বিভিন্ন থ্রিলার সিরিজ থেকে পাওয়া জ্ঞান দিয়ে সাহায্য করার চেষ্টা করে তাদের টিমকে।
খুনীর কাছে পৌঁছাতে গিয়ে যখন গোয়েন্দাদের নাস্তানাবুদ অবস্থা, ঠিক তখনি এক বিশেষ ঘটনার প্রেক্ষিতে বিশেষ অনুসন্ধানে ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্সে ভোগা কুহেলির নাম ওঠে আসে সন্দেহভাজন হিসেবে। ঘটনাক্রমে উপন্যাসের টানটান উত্তেজনার এক মুহূর্তে বেরিয়ে আসে কুহেলির পিতা আশফাক সাহেবের জীবনের অজানা রহস্য যার সাথে কুহেলির আসল পরিচয় জড়িত। ঘটনার ধারাবাহিকতায় জানা যায় সিরিয়াল কিলিংয়ের পরবর্তী এবং সর্বশেষ ভিকটিম হতে চলেছে ফরেনসিক ইনভেস্টিগেটর আবরার ফাহাদ! এটি উপন্যাসের সবচেয়ে আকর্ষণীয় রক্তহিম করা অংশ।
কে ছিল সেই সিরিয়াল কিলার, যে কিনা নিখুঁতভাবে প্রতিটা খুন সম্পন্ন করছিল? তাহলে কি কুহেলিই এই ক্রাইম খুনের মূল হোতা? নাকি কুহেলি অন্য কারোর মাধ্যমে খুনগুলো করাচ্ছে? নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে অন্য কোনো রহস্য? এটা কি কোনো টিমওয়ার্ক? তাহলে কে বা কারা সেই প্রকৃত খুনী? কেনই বা খুনগুলো করানো হচ্ছে? রহস্যের জাল ছিঁড়ে গোয়েন্দারা বের করে আনতে পেরেছিল সেই সত্য? কিভাবে উন্মোচন হয়েছিল সিরিয়াল কিলিংয়ের রহস্য? এই প্রশ্নগুলোর সাথে কুহেলির সম্পর্ক খুঁজে বের করতে গিয়ে পাঠক নিজেকে আবিষ্কার করবেন মেডিক্যাল, সায়েন্স আর সাইকোলজির অতীন্দ্রিয় ক্ষমতাসম্পন্ন এক ভিন্নধর্মী থ্রিলার প্লটে।
নিজস্ব পর্যালোচনা
বইটি শেষ করার পর থেকে এখন পর্যন্ত ঘোরের মধ্যে আছি। অদ্ভুত এক ভালো লাগা কাজ করছে আমার মস্তিষ্কে আর মনে! সমসাময়িক বিষয় নিয়ে প্লট সাজানো আর বিজ্ঞান সম্পর্কিত এত এত কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়ের সহজ সাবলীল ব্যাখ্যা আমার ভালো লাগাটা বহুগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছিল। বইয়ের শেষদিকে যেভাবে লেখক রহস্যের সুতা ধীরে ধীরে ছেড়েছেন, সেটা প্রশংসনীয়। লেখিকা এই উপন্যাসে ২টি চরিত্রের মধ্য দিয়ে বেশ ভালোমতোই 'ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স'কে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন। ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্সে ভোগা একজন মানুষ কিভাবে চিন্তা করে, কেমন আচরণ করে, তার আচরণ আশেপাশের মানুষের উপর কেমন প্রভাব ফেলে, মানুষের সাথে তাদের সম্পর্ক কেমন হয় সেটাও তিনি বেশ ভালোভাবেই ব্যাখ্যা করেছেন।
আবরার ফাহাদের আচরণের গুরুগম্ভীর ভাব কিংবা অবন্তীর আচরণের চঞ্চলতা তাদের ব্যাপারে পাঠকের আকর্ষণও বাড়িয়ে দিচ্ছিল। আবরার এবং অবন্তির মধ্যকার খুনসুটি নিভৃতে রূপ নিচ্ছিল দুজনের মধ্যকার প্রচ্ছন্ন রসায়নে। এই প্রচ্ছন্ন রসায়ন যে পরবর্তী সময়ে উপন্যাসের সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর অংশে এত চমৎকারভাবে ব্যবহার করা হবে, তা আগে আন্দাজ করতে পারিনি! ব্যক্তিগত মতামত দিতে গেলে বলবো, সিলিয়াল কিলারের অসম্ভব সম্মোহনী শক্তির মধ্য দিয়ে কাহিনির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিভিন্ন রকমের হিপনোসিসের যে চমৎকার ব্যাখ্যা ছিল, তাতেই বেশি মুগ্ধ হয়েছি।
বইতে প্রচুর মেডিক্যাল সম্পর্কিত তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে। এর প্রতিটি খুনের পদ্ধতিতে, খুনের অনুসন্ধান পদ্ধতিতে বিজ্ঞানের বিচিত্র সব শব্দ ও ব্যাখ্যা আমার মতো বিজ্ঞান প্রিয় মানুষকে বারবার চুম্বকের মতো আকর্ষণ করবে। খুন, রহস্য, ধাঁধাঁ ভালোবাসা, উত্তেজনা দারুণ সব অনুভূতির মিশ্রণ নিয়ে লেখক বইটি সৃষ্টি করেছেন। বইটি পড়ে ভালো লেগেছে আবরার অবন্তিসহ অন্যান্য সিআইডি অফিসারদের মিথক্রিয়া, যা লেখক সুন্দর করে তুলে ধরেছেন।
তাছাড়া অভ্র আর কুহেলির বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কটিও উল্লেখ করার মতো, আর বইয়ের কাহিনিতে এই সম্পর্কের ভূমিকা কতদূর তা বইটি পড়া ছাড়া বোঝার উপায় নেই। তবে এর শেষের দিকে মনে হচ্ছিল যেনো কিছু অধ্যায় খুব তাড়াহুড়ো করে শেষ করা হয়েছে৷ রহস্যময় সিরিয়াল কিলারকে নিয়ে কাহিনি যখন পুরোপুরি জমে উঠেছে, তখনই খুব দ্রুত যেনো কাহিনির ইতি টানা হলো। বইটি অনায়াসে আরও অনেকখানি বাড়ানো যেত! গল্পের শেষে কিছুটা মন খারাপও লাগছিল, ভাবছিলাম আরও কিছুক্ষণ যদি বইতে ডুবে থাকতে পারতাম!
সার্বিকভাবে বইতে কিছু তথ্যবহুল বিষয়ের খুবই আকর্ষণীয় ব্যাখ্যা ছিল- ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স, সাইকোসিস, নিউরোসিস, মাল্টিপল পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার, হিপনোসিস IVF, সারোগেট মাদার, PET (Positron Emission Tomography), CRH (Corticotropin Realising Hormone) ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়সহ স্কুল-কলেজ লেভেলের বিজ্ঞানের নানাবিধ জ্ঞানের ব্যবহারে বইটি হয়ে উঠেছে প্রচুর তথ্যবহুল একটি বই। তবে আপাত ভারী ভারী জ্ঞান সরবরাহের মাঝেও লেখকের বর্ণনাশৈলী এত নিঁখুত আর চমকপ্রদ ছিল যে, পাঠক এতে ডুবে যেতে বাধ্য। রূপক আর উপমা ব্যবহারের কৌশলে লেখকের বুদ্ধিবৃত্তিক দক্ষতার ছাপ স্পষ্ট। শব্দচয়ন আর বাক্যবিন্যাসে কিঞ্চিৎ জটিলতা থাকায় মনে হয়েছে, বইটি সাহিত্যের মান রক্ষা করেছে। বাংলাদেশের পাঠক সমাজ যে ভবিষ্যতে লেখকের কাছ থেকে অসাধারণ সব থ্রিলার উপন্যাস উপহার পেতে যাচ্ছে, তা সহজেই অনুমেয়।
লেখক: শিক্ষার্থী ও ক্যাম্পাস সাংবাদিক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।
কুবি/মাহি
আরো পড়ুন