ঢাকা     শনিবার   ০৪ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২১ ১৪৩১

গাড়ির শব্দেই শিয়াল-কুকুর বুঝে নেয়, খাবার আসছে!

শেখ তাজুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:২১, ৮ আগস্ট ২০২১   আপডেট: ১৮:০৯, ৮ আগস্ট ২০২১
গাড়ির শব্দেই শিয়াল-কুকুর বুঝে নেয়, খাবার আসছে!

বন্ধ ক্যাম্পাসে অভুক্ত প্রাণীদের পাশে মানবিক শিক্ষক। ছবি: তাজ, স্থান: জাবি

রাত প্রায় সাড়ে ১০টা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন পরিবহন চত্বরে এসে থামলো বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গাড়ি। ড্রাইভার সুজন ভাই এবং বড় একটি হাঁড়িতে ৩-৪ কেজি চালের রান্না করা ভাত, তরকারি (ভাতের সাথে মুরগির গিলা, কলিজা, পা ইত্যাদি রান্না)।  গন্তব্য আর কোথাও নয়; এই সাতশো একর। 

রান্না করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থানরত কুকুর, শিয়াল, বিড়ালদের জন্য। গাড়িটি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কাছে ছুটে আসতে দেখা গেলো একদল কুকুর। পেছনে এসেই থামলো তাদের যাত্রা। আর তখনই গাড়ি থেকে পাতিল হাতে বের হলেন সুজন ভাই; রান্না করা খাবার বের করে দিলেন তাদের সামনে। কুকুরগুলোও কোনো দিকে আর খেয়াল না করে এক মনে খেতে শুরু করলো। 

এবার গাড়ির চাকা থামলো এসে মুরাদ চত্বরে। দূর থেকে গাড়ি আসতে দেখে কিছু কুকুর আবারও দৌড়ে আসলো গাড়ির দিকে। এখানেও গাড়ি থেকে বের হলো খাবার; প্রাণভরে খেতে শুরু করলো কুকুরগুলো। এই বাস্তব গল্পের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর অনুভূতির শুরু এখানেই। 

মুরাদ চত্বর থেকে গাড়ি আবার যাত্রা শুরু করলে দেশের সর্বোচ্চ শহীদ মিনারের পাশেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান সড়কেই দেখা মিলতে থাকলো একঝাঁক শিয়ালের। সুজন ভাইয়ের মুখেও হাসি; শহীদ মিনার থেকে ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান গবেষণাগার যেতেই গাড়ির পেছনে জঙ্গল থেকে বের হয়ে জড়ো হতে থাকলো ২০টিরও বেশি শিয়াল। এযেন এক অচেনা নগর; বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান সড়কেই প্রায় ২০টির বেশি শিয়াল একটি গাড়িকে কেন্দ্র করে চলাফেরা করছে। উদ্দেশ্য গাড়িতে তাদের জন্য নিয়ে আসা খাবার। প্রায় দেড় বছর ধরে প্রধান সড়কে এই সময়ে চলে তাদের রাজত্ব। মনের সুখে খাবার খেয়ে শিয়াল মামারা আবার ঢুকে পড়ে জঙ্গলে। 

প্রায় দেড় বছর ধরে এদের খাবার বহন করা ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম সুজন ভাই। তিনি বলেন, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের আলী আজম স্যার এই খাবারের ব্যবস্থা করেন। আমি জানি, শহীদ মিনার পার হলেই এই শেয়ালগুলো জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসবে গাড়ি দেখে। প্রতিদিন এদের জন্য রান্না করে, এদেরকে নিজের হাতে খেতে দিয়ে আমি তৃপ্তি পাই। আমার মনে খুবই শান্তি শান্তি লাগে। এটা আমার কাজ না, তবুও এদের খাবার নিয়ে না আসতে পারলে আমার ভালো লাগে না; আমি নিজেও খেতে পারি না ঠিকমতো। মনে হয়, এরা আমার পথ চেয়ে বসে আছে। আমি খাবার নিয়ে আসার পর আনন্দে ওদের ছোটাছুটি দেখলেই আমার মন ভরে যাই।

ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান গবেষণাগার থেকে আবার শুরু হয় গাড়ির যাত্রা। এবারে ক্যাফেটেরিয়া, মেয়েদের হল, প্রান্তিক, ব্যাচেলর কোয়ার্টার হয়ে শহীদ সালাম-বরকত হলে আসতে আসতে আরও প্রায় ৩০টির মতো প্রাণীকে খেতে দিয়ে শেষ হয় যাত্রা। যার ভেতর ১০টির বেশি বিড়ালও রয়েছে। এভাবে গত দেড় বছর ধরে নিয়মিত রান্না করে খাওয়ানো হচ্ছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে বসবাসরত প্রায় অর্ধশতাধিকের বেশি প্রাণীকে। ক্যাম্পাসের সব হল, দোকানপাট বন্ধ তাই তাদের খেতে দেওয়ার জন্যই এই ব্যবস্থা। এজন্য কেবল খাদ্য ক্রয় বাবদ প্রায় ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা প্রতি মাসে খরচ হচ্ছে। করোনায় দেশের অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ন্যায় বন্ধ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কিন্ত তখনও ছিল ক্যাম্পাসের প্রাণীরা। তাদের শিক্ষার্থীদের মতো চলে যাওয়ার ছিল না নির্দিষ্ট কোনো স্থান। জানা গেছে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আলী আজম তালুকদার নিজ উদ্যোগে খাবার রান্না করে এই সব শেয়াল, কুকুর, বিড়ালদের খাওয়াচ্ছেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সালাম-বরকত হলের প্রাধ্যক্ষ ও মাইক্রোবায়োলজির অধ্যাপক। 

তিনি বলেন, প্রথম ৬ মাস আমি নিজে গাড়িতে থেকে ওদের খাইয়েছি অসহায় ও অভুক্ত এসব প্রাণীর প্রতি মমতা ও ভালোবাসা থেকেই সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে কাজটি করছি। এ কাজে সার্বিক উৎসাহ দিচ্ছেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলামও। তার বাসার সামনের কুকুরগুলোকে কিছু দিন খেতে দেওয়ার পর বিষয়টা তার নজরে আসলে তিনি আমাকে ডেকে এই কাজের প্রসংশা করেন এবং নিজেও সম্পৃক্ত থাকার ইচ্ছা পোষণ করেন। কাজটা বিশ্ববিদ্যালয় পূর্ণাঙ্গভাবে চালু না হওয়া পর্যন্ত খাদ্য সরবরাহ কাজটি চালিয়ে যাব। 

এভাবে প্রতিদিনই নির্দিষ্ট সময়ে গাড়ির হর্নের আওয়াজ শুনলেই প্রাণীদের ছুটতে দেখা যায় পেছন পেছন। কারণ, তারা জানে যে খাবার এসেছে, এই দুঃসময়ে এটাতেই বাঁচবে তাদের জীবন। 

লেখক: শিক্ষার্থী ও ক্যাম্পাস সাংবাদিক, ইংরেজি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

/মাহি/ 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়