ঢাকা     রোববার   ২১ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৬ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

সক্রেটিস-প্লেটোর উত্তরসূরির বড় অভাব

নাবিল হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৪৭, ১২ নভেম্বর ২০২৩  
সক্রেটিস-প্লেটোর উত্তরসূরির বড় অভাব

শত শত বৎসর পিছনের বাস্তব একটি গল্প। এক হাতে অমোঘ সত্য আর অন্য হাতে হেমলক বিষ শক্ত করে ধরে নিশ্চল দাড়িয়ে আছেন একজন মহান দার্শনিক। অবশেষে হেমলক পানে তার কায়া বেয়ে নেমে আসে অবশতার করুণ ঢল। প্রাণ হারালেও জ্ঞানের জগতে অপ্রাণ না হওয়া এই ভাস্বর দার্শনিকের নামই জগদ্বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস।

এই মহান সক্রেটিস জীবদ্দশায় কিছুই লেখেন নি; চিরকূট, চিঠি, পুঁথি– কিছুই না। বই তো অনেক দূরের নজির। তো এই মহান শিক্ষক, যাকে বলা হয়ে থাকে 'জ্ঞানের পিতা'। তার সম্পর্কে পৃথিবীব্যাপী এতো গবেষণা, এতো জানার আগ্রহ কীভাবে তৈরি হলো?

হ্যাঁ, এখানেই চলে আসে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের মধুর অভেদ্য ব্যাপারটি। তাঁর সম্পর্কে আমরা আজ ঠিক যা যা জানি তা প্লেটো মারফত। এই প্লেটোই তার বইয়ে শিক্ষক সক্রেটিসকে সাচ্চা জীবন দান করেছেন। অনেকে তো এটা ভাবে যে, সক্রেটিস বলতে বাস্তবে কেউই নেই। ইহা শুধুই প্লেটোর বানানো একটি কাল্পনিক চরিত্র মাত্র।

গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিসের শিষ্য হলেন প্লেটো, আর মহান প্লেটোর শিষ্য এরিস্টটল। আর এরিস্টটলের শিষ্য মূলত দুইজন ছিলেন। যারা যথাক্রমে থিউফ্রাস্টাস ও আলেকজান্ডার। আজকের দুনিয়ার আর পাঁচটা স্বাভাবিকের মাঝে অস্বাভাবিক ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কগুলো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে কোনোটিতেই গ্রীক মনীষাদের এরকম প্রগাঢ় পরিপূরকতার ছিটেফোঁটাও পাওয়া যায় না; ব্যাপারটি হতাশাব্যঞ্জক।

আজকাল একটি শ্রেণীকক্ষের গণ্ডিতে পরস্পর বিবদমান দু'টি পক্ষ। একটি হলো শিক্ষক এবং আরেকটি নিঃসন্দেহে ছাত্রসকল। এখানে 'সকল' শব্দটি না ব্যাকরণের দিক থেকে নিপুণ, না গভীরতার দিক থেকে সঠিক। কারণ অনেক শিক্ষকগণই যেনো মেধাবী বা তথাকথিত টপারদের শিক্ষক আর তথাকথিত অমেধাবীদের কাছে যমদূত এর ন্যায়। এ যেনো ক্ষণে রাম, ক্ষণে রাবণ। এক ক্লাসে দুই নীতি। শিক্ষককের প্রতি যথাযোগ্য সমীহ রেখেই সখেদে প্রশ্ন করছি, এমনটি কেনো?

একটি শ্রেণীকক্ষের প্রথম বেঞ্চে বসা শিক্ষার্থীরাই যেনো হীরার টুকরো হয়ে উঠে। শিক্ষকদের যত মনোযোগ, ভালোবাসা, আদর, সমাদর যেনো ওদের জন্য বিশেষ রূপে বরাদ্দ। অথচ ক্রমান্বয়ে এই মারপ্যাচে পিছিয়ে পড়ারা কি অধমই থেকে যাবে? ব্যাপারটি ঠিক অধ্যাপক রাগনার নাকসের তত্ত্ব 'দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রের' মতোই। দরিদ্ররা ঘুরে ফিরে সেই দরিদ্রই থেকে যাবে।

স্কুল জীবনের একটি বিশেষ স্মরণীয় দিনের কথা আমার একদম স্পষ্ট মনে আছে। ওই দিনটির আগে কখনো আমি স্কুলে কোনো ক্লাসেই টুঁ-শব্দটি অবধি করতে পারতাম না। সবার কাছে পরিচিত বোবা ছেলেটি একদিন রুনা ম্যামের ক্লাসে একটি কবিতা পাঠ করিয়ে শোনানোতে সে-কি তেলেছমাতি কাণ্ডটাই না ঘটেছিলো। সেদিন সবাই আমাকে নিয়ে বিশেষ স্তুতি জপছিলো। কিন্তু এখানে আসলে কারিশমাটা কার ছিল? হ্যাঁ, অবশ্যই তা শ্রদ্ধেশ রুনা ম্যামের। তারপর থেকে আমার আর কথা বলতে গিয়ে আটকাতে হয়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকে আজ পর্যন্ত তিনটি 'জাতীয় বিতর্ক' করেছি এবং ডজনখানেক পুরষ্কার শুধু বিতর্ক-বক্তৃতায় পাওয়া হয়ে গেছে। বলুন তো আমি কার নিখুঁত আবিষ্কার? উত্তরটি দ্ব্যর্থহীনভাবে হবে, রুনা ম্যামের। শিক্ষকরা হবেন একেক জন প্রকাণ্ড আবিষ্কারক।
ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে মার্কিন দার্শনিক ও মনোবিজ্ঞানী জন ডিইউ বলেছিলেন, ‘একজন শিক্ষক হলেন চালক এবং পথ প্রদর্শক। তিনি গাড়ি চালিয়ে যাবেন, যার চালিকাশক্তির উৎস হলো শিক্ষার্থীরা।’

ক্রমবর্ধমান পুঁজিবাদের উত্থানের কাছে এই ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক অনেকটাই অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলের জটলায় আটকা পড়ে যাচ্ছে। শিক্ষকরা যেন ক্লাসের পড়াকে 'সংবাদের শিরোনাম' ভাবেন আর প্রাইভেট-টিউশনে থাকে সেটির 'বিস্তারিত'। এমনটির কারণে একটি আদর্শিক শ্রেণীকক্ষের যে ধর্ম তা আর বজায় থাকে না। আর অপরদিকে আর্থিক বিপর্যস্ত শিক্ষার্থীরা 'সংবাদের শিরোনাম' শুনেই তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেই তুষ্ট থাকে। জীবদ্দশায় হয়তোবা 'বিস্তারিত' শোনা হয়ে উঠে না।

সালটা ১৯৯৩, এদেশে চালু করা হয়েছিলো 'খাদ্যের বিনিময়ে শিক্ষা'। ব্যাপারটি এমন ছিল যে, দেশের হতদরিদ্র জনগণ খাদ্যের বিনিময়ে তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাবে। দরিদ্রতার ভারে নুয়ে পড়া মানুষগুলো যেনো সন্তানদের 'একবেলা' আহারের ব্যবস্থা করতেই শিক্ষার প্রতি অসম্ভব আগ্রহ পেয়েছিলো। সে দেশেই আজ সন্তানদের লেখাপড়ার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও বেশি ব্যয় করতে হয় বাংলাদেশের অভিভাবকদের।

ইউনেস্কোর ২০২১-২২ গ্লোবাল অ্যাডুকেশন মনিটরিং রিপোর্টে জানা যায়, শিক্ষার পেছনে গড় খরচ বেড়েছে ৮০ শতাংশ। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রায় ৭ শতাংশ পরিবারকে তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে অজস্র ঋণ নিতে হয়। এর পিছনে অতিরিক্ত টিউশন ফি, স্টেশনারির দাম ও সরকারের আনুপাতিক অপর্যাপ্ত বরাদ্দও দায়ী।

এত খরচ মেটানোর সাধ্য কি সবার আছে? আর তাই সমীক্ষা অনুসারে, বর্তমানে প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার প্রায় ১৯ শতাংশ আর মাধ্যমিকে ৩৯ শতাংশ। কী লোমহর্ষক!

কবি কাজী কাদের নেওয়াজের লেখা ‘শিক্ষা গুরুর মর্যাদা’ কবিতার লাইনগুলো আজ জীবন্ত হয়ে উঠলে এ দেশ সারা বিশ্বে পরিচিত হবে শ্রেষ্ঠ 'সোনার খনি’ ওয়ালা দেশ হিসেবে। সে সোনা মাটির নিচে নয়, উপরে তৈরি হয় একটু একটু করে আদর্শ শিক্ষকের যাদুকরী হাত থেকে। এ দেশ, মাটি, মানুষ আর জাতি হবে সোনার। শিক্ষকরা এই সোনা গড়ার সবচেয়ে অগ্রগামী নেতা। আর ছাত্ররা, তার ভিত।

/মেহেদী/

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়