ঢাকা     শুক্রবার   ১১ অক্টোবর ২০২৪ ||  আশ্বিন ২৬ ১৪৩১

চবির শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া: চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

হাসনাত হাসান রাহাত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:২১, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪  
চবির শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া: চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষকর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া শিক্ষার মানকে সরাসরি প্রভাবিত করে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) বিভিন্ন অনুষদে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে সিজিপিএসহ বিভিন্ন মানদণ্ড অনুসরণ করা হয়। তবে সেগুলো সবসময় সামঞ্জস্যপূর্ণ বা পর্যাপ্ত নয় বলে অনেকে মনে করেন।

শিক্ষক নিয়োগে সিজিপিএ ও পরীক্ষার ভূমিকা: বর্তমানে চবিতে বিভিন্ন অনুষদে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণে ভিন্ন ভিন্ন সিজিপিএ মানদণ্ড অনুসরণ করা হয়। কিছু অনুষদে সিজিপিএ ৩.৫০ প্রয়োজন। আবার কোনো কোনো অনুষদে ৩.৭৫ উল্লেখ করা হয়। তবে এটি শুধু একটি মানদণ্ড। অনেক ক্ষেত্রে মৌখিক ও লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমেও প্রার্থীদের যোগ্যতা যাচাই করা হয়। তবে এই নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে কিছু প্রশ্ন দেখা দেয়।

মূল সমস্যা

১. সিজিপিএ নির্ভরতা: সিজিপিএ একজন শিক্ষার্থীর অ্যাকাডেমিক দক্ষতার প্রতিফলন হলেও তা দিয়ে তার শিক্ষাদানের দক্ষতা পুরোপুরি নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। একজন ভালো শিক্ষার্থী সবসময় ভালো শিক্ষক হবেন, এটি নিশ্চিত নয়।

২. লিখিত পরীক্ষার অনুপস্থিতি: কিছু অনুষদে লিখিত পরীক্ষা থাকলেও, তা সব জায়গায় সমভাবে মানা হয় না। অনেক ক্ষেত্রে পরীক্ষার প্রশ্ন শিক্ষাদানের উপযুক্ততা যাচাইয়ে যথেষ্ট নয়। উদাহরণস্বরূপ- বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে লিখতে বলা হলে, এটি একজন প্রার্থীর ইতিহাস জ্ঞান যাচাই করতে পারে। তবে তার শিক্ষাদানের দক্ষতা কিংবা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষমতা সম্পর্কে কিছু বলে না বা পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায় না।

৩. প্রকৃত মানদণ্ডের অভাব: বর্তমান প্রক্রিয়ায় শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে যে মানদণ্ডগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে, সেগুলো সবসময় প্রার্থীর শিক্ষাদানের দক্ষতা নির্ধারণে কার্যকর ভূমিকা রাখে না। সঠিকভাবে একজন প্রার্থীর শিক্ষণ দক্ষতা, বিষয়বস্তুর জ্ঞান, শিক্ষার্থীদের প্রতি সহানুভূতিশীল মনোভাব এবং গবেষণার আগ্রহ মূল্যায়ন করা কঠিন।

সমাধানের পথ

টিএ (টিচার অ্যাসিসট্যান্ট) এবং আরএ (রিসার্চ অ্যাসিসট্যান্ট) পদ্ধতি: বহির্বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে টিএ ও আরএ পদ্ধতি শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়ায় একটি কার্যকর ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশের কিছু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়েও এ পদ্ধতি চালু রয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও এই পদ্ধতি চালু করা গেলে শিক্ষার মানে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা সম্ভব।

টিএ পদ্ধতি-

১. কাজের বিবরণ: সাধারণত তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে টিএ’গণ নির্বাচিত হন। তারা শিক্ষকদের সহকারী হিসেবে কাজ করেন এবং ক্লাস লেকচার শেষে শিক্ষার্থীদের বিষয়বস্তু বুঝতে সাহায্য করেন। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ কাজ করার মাধ্যমে টিএ’রা প্রাথমিক শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা লাভ করে।

২. ফিডব্যাক প্রক্রিয়া: শিক্ষার্থীরা টিএ’দের পারফরম্যান্স সম্পর্কে ফিডব্যাক দিতে পারে। এ ফিডব্যাক ভবিষ্যতে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এতে করে, শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার আগে একজন প্রার্থী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারেন।

৩. সুবিধা: টিএ হিসেবে কাজ করার মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী ভবিষ্যতের শিক্ষক হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করে। এটি তাদের শিক্ষাদানের সক্ষমতা বাড়ায় এবং শিক্ষকদের অ্যাকাডেমিক কাজগুলোতেও সহায়তা করে।

আরএ পদ্ধতি-

১. গবেষণা সহযোগী: আরএ’রা মূলত গবেষণায় সহায়তা করে থাকেন। আরএ’গণ শিক্ষকদের গবেষণার কাজে সাহায্য করে এবং গবেষণার মান উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। আরএ নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর গবেষণার প্রতি আগ্রহ, জ্ঞান ও যোগ্যতা বিবেচনা করা হয়।

২. গবেষণার মান উন্নয়ন: একজন আরএ গবেষণার মাধ্যমে তার নিজস্ব জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধ করে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে যায়। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার মান উন্নত করা সম্ভব হয়।

টিএ ও আরএ পদ্ধতির সম্ভাব্য ফলাফল

১. শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ার মানোন্নয়ন: টিএ ও আরএ পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকতার প্রতি আগ্রহী ও অভ্যস্ত হয়ে উঠবে। ভবিষ্যতে যখন তারা শিক্ষক হিসেবে আবেদন করবেন, তখন তাদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা মূল্যায়ন করা সহজ হবে। এভাবে যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ করা সম্ভব হবে।

২. যোগ্যতার সঠিক যাচাই: টিএ ও আরএ পদ্ধতির মাধ্যমে প্রার্থীর সিজিপিএ বা লিখিত পরীক্ষার বাইরেও তার শিক্ষাদানের দক্ষতা এবং গবেষণার প্রতি আগ্রহ মূল্যায়ন করা সম্ভব হবে। এটি একটি ব্যাপক ভিত্তিতে যোগ্যপ্রার্থীদের সনাক্ত করতে সহায়তা করবে।

৩. গবেষণার মানোন্নয়ন: আরএ পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা গবেষণায় জড়িত থেকে নতুন উদ্ভাবন এবং গবেষণার সুযোগ তৈরি করবে। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কার্যক্রম সমৃদ্ধ হবে এবং দেশের সামগ্রিক গবেষণা সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।

৪. আর্থিক স্বাবলম্বিতা: টিএ ও আরএ হিসেবে কাজ করা শিক্ষার্থীরা সামান্য হলেও পারিশ্রমিক পেয়ে থাকেন। এটি শিক্ষার্থীদের আর্থিকভাবে কিছুটা স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করবে এবং তাদের অ্যাকাডেমিক চাপ কমিয়ে দিবে।

টিএ ও আরএ পদ্ধতি চালু করলে শিক্ষাদানের গুণগত মান বৃদ্ধি পাবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক ও গবেষণা কার্যক্রমে একটি বড় পরিবর্তন আসবে। শিক্ষার্থীরা শিক্ষার পাশাপাশি শিক্ষাদানে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে, যা ভবিষ্যতে তাদের ক্যারিয়ারে সহায়ক হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং সদস্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় তরুণ লেখক ফোরাম

/মেহেদী/


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়