আমার মায়ের কোনো ক্লান্তি নেই
আসাদ আল মাহমুদ
মা—এই ছোট্ট শব্দটার ভেতর লুকিয়ে আছে একটা বিশাল জগৎ। আমার জীবনের প্রথম পরিচয়, প্রথম শব্দ, প্রথম আশ্রয় ছিল- মা। ছোটবেলায় যখন হাঁটতে শেখার আগ্রহে পা ফেলতাম, তখন পাশে হাত ধরে ছিলেন যিনি, তিনিই মা। আমি পড়ে গেলে তিনি কেঁদে ফেলতেন, আমি হাসলে তিনি হাসতেন। যেন আমার সুখই তার জীবনের উদ্দেশ্য।
আমার মা একজন সাধারণ গৃহিণী। তবে তার অসাধারণত্ব আমি প্রতিদিন অনুভব করি। ভোরবেলায় উঠে তিনি সবার আগে আমাদের দিনের শুরু করেন। বাবার টিফিন, আমার স্কুলের ব্যাগ, ছোট ভাইয়ের জামা—সবই যেন নিখুঁতভাবে গুছিয়ে রাখেন। অথচ কখনো কোনো অভিযোগ নেই, ক্লান্তি নেই। কতবার ভেবেছি, মা কি কখনো বিশ্রাম চান না? কিন্তু তার মুখে সবসময় একটাই কথা— “তোমরা ঠিক থাকলে, আমি ভালো থাকি।”
একটা ঘটনা আজো মনে আছে। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি তখন। পরীক্ষায় খারাপ ফল করে খুব ভয় পেয়েছিলাম। ভাবছিলাম, মা হয়তো খুব রেগে যাবেন। কিন্তু মা আমার মুখ দেখে কিছুই বললেন না। শুধু পাশে বসে বললেন, “ভুল করেছ, বুঝেছ, এবার শেখ; আমি পাশে আছি।” সেই দিনটা আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। মা-ই আমাকে শিখিয়েছেন, ভুল হতেই পারে, কিন্তু থেমে যাওয়া চলবে না।
আমার মা শুধু পরিবারের প্রতি দায়িত্বশীলা নন, আশেপাশের মানুষদের প্রতিও তিনি অসম্ভব আন্তরিক। প্রতিবেশীর বিপদে-আপদে ছুটে যান, গ্রামের কোনো বুড়ি অসুস্থ হলে খোঁজ নেন। তার মধ্যে এক অদ্ভুত মমতা আছে, যা অজান্তেই সবাইকে ছুঁয়ে যায়।
একবার মাকে চমকে দেওয়ার ইচ্ছে হল। দশম শ্রেণির পরীক্ষা শেষে জমানো কিছু টাকা দিয়ে আমি মায়ের জন্য একটি হালকা গোলাপি রঙের শাড়ি কিনেছিলাম। জানতাম, এই রঙটা মায়ের খুব পছন্দ, কিন্তু কখনো নিজে কেনেননি। সবসময় বলেন, “এই রঙ আমার মানায় না।”
শাড়িটা হাতে তুলে দিলে মা কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। তারপর চোখ ভিজে উঠে বলেছিলেন, “তুই না থাকলে, কেউ কোনোদিন আমাকে এমন করে কিছু দিত না।” সেই মুহূর্তটা আজো আমার হৃদয়ে গেঁথে আছে—ছোট্ট একটি উপহার, অথচ মায়ের জন্য ছিল অনেক বড় ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।
আজ মা দিবস। সকালবেলা মাকে বললাম, “তোমার জন্য একটা চিঠি লিখেছি।” তিনি অবাক হয়ে তাকালেন, আবার লজ্জাও পেলেন। তারপর যখন পড়ে শুনালাম, তার চোখ ভিজে উঠল। বললেন, “আমি তো কিছুই করিনি!” অথচ জানি, তিনিই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষক, আশ্রয় আর প্রেরণা।
মা—তোমার ভালোবাসা, ত্যাগ আর নিঃস্বার্থ স্নেহের কাছে আমি চিরঋণী। আজ শুধু একটা কথাই বলতে চাই—মা, আমি তোমায় খুব ভালোবাসি।
(লেখক: সংবাদকর্মী)
ঢাকা/মেহেদী