আমার মা একজন বীর যোদ্ধা
মাহফুজা আক্তার || রাইজিংবিডি.কম
মাহফুজা আক্তার
আমার মা ছিলেন নানুর চোখের মণি, নানুর প্রাণের টুকরো। আদর-ভালোবাসায় গড়া সেই মেয়েটির জীবন পাল্টে গেল, যখন তার বিয়ে হলো। আমার বাবার পরিবারের সদস্য সংখ্যা ছিল অন্তত ২৫ জন। সেই বিশাল পরিবারের সমস্ত দায়িত্ব গিয়ে পড়ল মায়ের কাঁধে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করেও কোনো প্রশংসা পেতেন না, বরং অবহেলাই ছিল নিত্যসঙ্গী।
প্রথমে হয়তো সবকিছু মেনেই নিয়েছিলেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে পরিস্থিতি কঠিন থেকে কঠিনতর হতে লাগল। দুই চাচা বিয়ে করার পর সম্পর্কে ফাটল ধরে। ফুপুরা মায়ের উপর রাগ ঝাড়ত, অপমান করত, এমনকি মারধরও করত। তবুও মা মুখ বুজে সহ্য করতেন। বাবাই ছিলেন তার একমাত্র ভরসা। কিন্তু সেই ভরসাও বুঝি, টিকলো না বেশিদিন।
পরিবারে অশান্তির মাঝেও মা আমাদের তিন ভাই-বোনকে নিয়ে আলাদা একটা ছোট সংসার শুরু করলেন। অথচ এই আলাদা সংসার গড়ার পথে বাবার পক্ষ থেকে কোনো সহায়তাই ছিল না। বাবা তখনও তার ভাই-বোনদের জন্য সবকিছু করতেন—ঈদে নতুন কাপড় কিনে দিতেন, দাওয়াত দিতেন, অথচ মাকে কিছু দিতেন না। আমাদের সংসারের খরচ, খাবার, স্কুলের ফি—সবকিছুর ভার ছিল মায়ের ওপর।
মা তখন নিজের বাবার বাড়ির সামান্য টাকায়, ধানক্ষেতে কাজ করে ছয় মাসের খাবার চাল মজুদ করে সংসার চালাতেন। বাবার অবহেলা আর অনুপস্থিতিতে মায়ের সাহস আর ভালোবাসায় আমরা বড় হই। একসময় বাবা আমাদের ছেড়ে আরেকটা বিয়ে করে অন্য কোথাও চলে যান। আমাদের কোনো খোঁজও নেননি। কিন্তু মা কখনো আমাদের ছেড়ে যাননি।
তিনি দিনের পর দিন না খেয়ে থেকেছেন, কিন্তু আমাদের মুখে হাসি রাখতে কখনো কার্পণ্য করেননি। অসুস্থ হলে নিজে ওষুধ কিনে খেতে পারতেন না। অথচ আমরা অসুস্থ হলেই ছুটে যেতেন ডাক্তারের কাছে। আমাদের স্কুলের ফি দিতে গিয়ে ধার করেছেন, নিজে না খেয়ে, আমাদের খাইয়েছেন। খাবারের থালায় বসে চুপচাপ কাঁদতেন। সেই কান্না আমরা বুঝিনি ছোটবেলায়, কিন্তু এখন বুঝি।
আজ আমরা সবাই প্রতিষ্ঠিত, সমাজে আমাদের একটা সম্মানজনক অবস্থান। কিন্তু এর পেছনে যে রক্ত, ঘাম আর অশ্রুর গল্প, তা শুধুই মায়ের। তিনি ছিলেন একজন নিঃস্বার্থ যোদ্ধা। নিরবে, নিঃশব্দে সবকিছু সহ্য করে আমাদের একটা ভবিষ্যৎ গড়েছেন।
আমার মা শুধু একজন মা নন, তিনি একজন বীর যোদ্ধা। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা।
(লেখক: শিক্ষার্থী, আলিম প্রথম বর্ষ, ভালুকা ফাযিল মাদরাসা, ময়মনসিংহ)
ঢাকা/মেহেদী