ঢাকা     রোববার   ২১ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৬ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

তিতুমীর কলেজ ছাত্রীনিবাসের ‘শাসক’ ছিলেন ছাত্রলীগ নেত্রীরা

তিতুমীর কলেজ সংবাদদাতা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৫৪, ১৯ জুলাই ২০২৫   আপডেট: ১৭:৫৪, ১৯ জুলাই ২০২৫
তিতুমীর কলেজ ছাত্রীনিবাসের ‘শাসক’ ছিলেন ছাত্রলীগ নেত্রীরা

ফাইল ফটো

রাজনীতির পালাবদলে তিতুমীর কলেজের ছাত্রীনিবাসগুলো অনেকটাই শান্ত। অথচ অতীতের কথা ভাবলেই অনেক শিক্ষার্থীর মনে পড়ে দাপুটে কিছু মুখের কথা, যারা ছিলেন তৎকালীন ছাত্রলীগের নেত্রী।

দল আজ ক্ষমতার বাইরে। জুলাই আন্দোলনের পর পাল্টে গেছে দৃশ্যপট। সেই সঙ্গে অদৃশ্য হয়ে গেছেন তিতুমীর কলেজ ছাত্রীনিবাসের ‘ক্ষমতাধর’ কয়েকজন।

আরো পড়ুন:

তৎকালীন সময়ে সুফিয়া কামাল ছাত্রীনিবাসে অবস্থান করতেন উপ-ছাত্রীবিষয়ক সম্পাদক সাবিকুন্নাহার মুক্তা ও সহ-সম্পাদক বনলতা বিউটি, সিরাজ ছাত্রীনিবাসে অবস্থান করতেন উপ-ছাত্রী বিষয়ক সম্পাদক মোহিনী আক্তার এবং অপরাজিতা ছাত্রীনিবাসে থাকতেন ছাত্রলীগের ছাত্রীবিষয়ক সম্পাদক তাহসিনা আক্তার অতিথি ও উপ-ছাত্রী বিষয়ক সম্পাদক খাদিজা আক্তার রাফিন।

ছাত্রীদের অভিযোগ, ছাত্রলীগের যে যেই হলে থাকতেন, সেই হল পরিচালনার দায়িত্ব ছিল তার। ছাত্রীনিবাসে শিক্ষক নন, সর্বেসর্বা ছিলেন এসব নেত্রীরা। ক্ষমতার দাপটে প্রশাসনও তখন ছিল নিশ্চুপ। যেখানে ছাত্রীনিবাসের সব দায়দায়িত্ব কলেজ প্রশাসনের ওপর বর্তায়, সেখানে হল কর্তৃপক্ষ দায়িত্বে থেকেও নিষ্ক্রিয় ছিল।

ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে এই নেত্রীরা বিভিন্ন সময়ে হলে নানা ধরনের ‘সিন্ডিকেট’ করতেন। প্রতি সিটে দুজন করে থাকার নিয়ম থাকলেও নেত্রীরা থাকতেন একাই। এছাড়াও অবৈধভাবে বেশি টাকার বিনিময়ে ছাত্রীদের সিট দেওয়া ছিল তাদের অন্যতম ব্যবসা। তবে সেই সিট দেওয়ার রশিদ কিংবা টাকা কোনটাই পৌঁছাতো না হল কর্তৃপক্ষের কাছে। এছাড়াও নিজেদের হল ফি না দেওয়া, রান্না‌ঘরের সব সুযোগ-সুবিধা নিজেদের দখলে রাখা, ওয়াইফাই বিল বেশি নেওয়া, ক্যান্টিনের খাবারের বিল না দেওয়া ছিল তাদের রোজকার রুটিন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হলের বেশ কয়েকজন আবাসিক ছাত্রী বলেন, “তৎকালীন ক্ষমতাসীন নেত্রীরা কেবল নিজেরা সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেই ক্ষান্ত হননি। বিভিন্ন সময়ে হলের শিক্ষার্থীদেরও মানসিক ক্ষতি করেছেন। যেকোনো সময় তুচ্ছ বিষয়ে মিটিং ডেকে অন্য শিক্ষার্থীদের হয়রানি করতেন। কেউ মিটিংয়ে না এলে বা তাদের কথা না শুনলে অযথা হয়রানি করতেন।” এছাড়াও তাদের নানা সময়ে ছাত্রলীগের প্রোগ্রামে অংশ নিতে বল প্রয়োগ করা হত বলেও জানান তারা।

অভিযোগ রয়েছে, জুলাই আন্দোলনে যোগ দিতে চাওয়ায় মেয়েদের ছাত্রলীগ নেতাদের হাতে তুলে দেওয়ার হুমকি দেন তৎকালীন সুফিয়া ছাত্রীনিবাসের সাবিকুন্নাহার মুক্তা। ওইসময় এ ঘটনার কোনো ব্যবস্থা নেননি ছাত্রীনিবাসের তৎকালীন দায়িত্বরত অধ্যাপক ফরিদা ইয়াসমিন।

শুধু ছাত্রীনিবাস নয়, কলেজজুড়ে বিভিন্ন আয়োজনে ছাত্রলীগ নেত্রীদের দাপট ছিল দৃশ্যমান। বিভিন্ন উৎসবে নানা বিভাগের শিক্ষার্থীরা অংশ নিলেও প্রথম পুরস্কার যেত ছাত্রলীগ নেত্রীতে ঝুলিতে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন, “তৎকালীন ছাত্রলীগের উপ-ছাত্রী বিষয়ক সম্পাদক খাদিজা আক্তার রাফিন অবৈধভাবে ইডেন কলেজের এক শিক্ষার্থীকে নিয়ে অপরাজিতা হলে থাকতেন। এছাড়াও যারা গণরুমে ছিলেন তারা সর্বদা ছাত্রলীগ নেত্রীদের আদেশ মানতে একপ্রকার বাধ্য ছিল।”

জানা যায়, সেই ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী সম্পর্কে ছাত্রলীগ নেত্রী রাফিনের বোন। কিন্তু অন্য কলেজের শিক্ষার্থী হলে থাকার কোনো বৈধতাই নেই বলে স্পষ্ট বিধান রয়েছে।

এ বিষয়ে ছাত্রলীগ নেত্রী রাফিনকে বেশ কয়েকবার ফোন দেওয়া হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। এছাড়াও নানা অভিযোগের বিষয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও, জুলাই আন্দোলনের পর থেকে অতিথি ও মুক্তার সিম বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।

তথ্য অনুযায়ী, জুলাই আন্দোলন শেষে হল ছেড়ে যাওয়ার পর, বিয়ের পিঁড়িতে বসেছেন ছাত্রলীগ নেত্রী তাহসিনা আক্তার অতিথি। সহ-সম্পাদক বনলতা বিউটি ৫ আগস্টের পর ক্যাম্পাসে পা রাখলে, শিক্ষার্থীরা তাকে তুলে দেন পুলিশের হাতে। এছাড়াও খাদিজা আক্তার রাফিন ফিরে গেছেন পরিবারের কাছে। তবে সাবিকুন্নাহার মুক্তা কিংবা মোহিনী আক্তারের বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

তিতুমীর কলেজ ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সহ-সাধারণ সম্পাদক শেখ শাহানাজ পারভীন বলেন, “আমার হল জীবনের শেষের দিকে কয়েকজন মেয়ে ছাত্রলীগ শুরু করলেও তারা কখনো আমাকে কিছু বলেনি। কিন্তু কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি, সম্পাদকসহ বিভিন্ন নেতা আমাকে হল থেকে বের করে দেওয়ার জন্য বারবার চেষ্টা করেছে। হলের কেয়ারটেকার কয়েকবার বলেছে, ‘আমার উপর অনেক চাপ আসছে, তুমি সকালে হল ছাড়বে।’ আমি বারবার ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের হেনস্তার শিকার হয়েছি।”

তিনি আরও বলেন, “হলের মেয়েদের ছাত্রলীগ নেত্রীরা যখন টর্চার শুরু করে, তখন আমার অনার্স শেষ হয়ে গিয়েছিল, আমি হল ছেড়ে দিয়েছিলাম। আমি চাই, বিগত দিনের মতো যেন আর কোনো জোর-জুলুম, মেয়েদের টর্চার না চলে। আমি অনেকবার বাধার সম্মুখীন হয়েছি। তাই আমি চাই আমার মতো, গণতান্ত্রিক দেশে সুষ্ঠু রাজনৈতিক চর্চার ক্ষেত্রে কেউ যেন বাধাগ্রস্থ না হয়।”

ছাত্রলীগ নেত্রীদের এসব অপকর্মের ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে তৎকালীন সুফিয়া কামাল ছাত্রীনিবাসের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, “ছাত্রলীগ নেত্রীদের সঙ্গে কোনোদিনই আমার ভালো সম্পর্ক ছিল না। বিভিন্ন সময়ে তাদের এসব কর্মকাণ্ডে সচেতন করা হলেও তারা কখনোই কথা শুনত না। ক্ষমতাসীন হওয়ার কারণে তাদের কাছে প্রশাসন একপ্রকার অসহায় ছিল।”

সুফিয়া কামাল ছাত্রীনিবাসের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে হল তত্ত্বাবধায়ক সহযোগী অধ্যাপক রীতা খন্দকার ও সহকারী হল তত্ত্বাবধায়ক প্রভাষক এলমা আকতার ঈশিতা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

তবে অপরাজিতা ছাত্রীনিবাসের তত্ত্বাবধায়ক অধ্যাপক মোসা. মুর্শিদা জাহান বলেন, “আমার জানা মতে, হলে এখন ছাত্রলীগের কেউ নেই, যারা ছিল তারা চলে গেছে। আগের পরিস্থিতি সম্পর্কে আমি অবগত নই, কারণ তখন দায়িত্বে ছিলাম না। এখন এক সিটে দুজন থাকে এবং নতুন কিছু নিয়ম চালু করেছি। যেমন- রাত ৮টার মধ্যে হলে ফিরতে হবে, হলে থেকে কেউ চাকরি করতে পারবে না।”

তিনি আরো বলেন, “ক্যান্টিনের খাবারের মান উন্নয়নে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এবং হল মেট্রন ও সহকারী তত্ত্বাবধায়ককে নিয়মিত মনিটরিংয়ের বিষয়ে বলা হয়েছে। পূর্বের তুলনায় পরিস্থিতি ভালো।”

সিরাজ ছাত্রীনিবাসের তত্ত্বাবধায়ক সহকারী অধ্যাপক আক্তার জাহান বলেন, “বর্তমান প্রেক্ষাপট ভালো। যতটা শক্ত থাকা যায়, আমরা থাকছি। রাজনৈতিক প্রভাব, অহেতুক মিটিং, সিট বাণিজ্য এখন একেবারেই নেই। সিনিয়র-জুনিয়রদের মধ্যে যেন সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় থাকে, সেজন্য আমরা সচেষ্ট।”

ভবিষ্যতে হলে আবার রাজনৈতিক দখলদারিত্ব ফিরে আসতে পারে কি না—জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এটা পরিবেশের উপর নির্ভর করে। অগ্রিম কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে হলের সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।”

তিতুমীর কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. ছদরুদ্দীন আহমদ বলেন, “বর্তমানে কলেজের পরিবেশ ভালো। আমি বিশ্বাস করি, অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে রাজনৈতিক দলগুলো শিক্ষা নিয়েছে। ভবিষ্যতে কেউই এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করার দুঃসাহস দেখাবে না—এমনটাই আমার প্রত্যাশা। শুধু তিতুমীর কলেজ নয়, গোটা জাতির জন্য সুস্থ পরিবেশ বজায় থাকবে বলে আমি প্রত্যাশা করি।”

ঢাকা/হাফছা/মেহেদী

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়