ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

আর্থিক সংকট নিরসনে ইউনাইটেড এয়ারকে ডেকেছে বিএসইসি

নুরুজ্জামান তানিম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:৫১, ১১ ডিসেম্বর ২০২২  
আর্থিক সংকট নিরসনে ইউনাইটেড এয়ারকে ডেকেছে বিএসইসি

পুঁজিবাজারের ওভার দ্য কাউন্টার (ওটিসি) মার্কেট থেকে অল্টারনেটিভ ট্রেডিং বোর্ডে (এটিবি) স্থানান্তরে অপেক্ষায় রয়েছে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ (বিডি)। সাবেক পরিচালনা পর্ষদের সীমাহীন দুর্নীতি এবং তহবিল তসরুপের কারণে আর্থিক সংকটে থাকা কোম্পানিটিকে দাঁড় করানো কঠিন হয়ে পড়েছে। বিগত ৬ বছর ধরে ব্যবসায়িক কার্যক্রম বন্ধ থাকা কোম্পানিটিকে পুনরায় চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় কোম্পানিটির আর্থিক সংকট নিরসনের লক্ষ্যে পুনর্গঠিত পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে বৈঠক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

সম্প্রতি ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে বৈঠকের বিষয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

বিএসইসির চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের আর্থিক অবস্থা নিয়ে বৈঠক আয়োজন করা হয়েছে। এ জন্য সোমবার (১২ ডিসেম্বর) বিকাল সাড়ে তিনটায় কমিশনে উভয় পক্ষের এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। বৈঠকে সভাপতিত্ব করবেন বিএসইসির কমিশনার অধ্যাপক ড. শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ। উক্ত বৈঠকে উপস্থিত থাকার জন্য সকলকে জানানো হয়েছে। যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে এ চিঠি জারি করা হয়েছে।

তথ্য মতে, ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের শেয়ারে ১ লাখ ৬০ হাজার প্রান্তিক বিনিয়োগকারীর বিনিয়োগ রয়েছে। এ বৃহৎ পরিমাণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ বিবেচনা করে কোম্পানিটিকে ফের আকাশে উড্ডয়নের স্বপ্ন দেখছে বিএসইসিসহ পুনর্গঠিত পর্ষদ। আর এ স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে ইতোমধ্যে কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও কর্তৃপক্ষের সহযোগিতাসহ চারটি সুপারিশ বাস্তবায়নের প্রস্তাব দিয়েছে।

ইউনাইটেড এয়ারের পুনর্গঠিত পরিচালনা পর্ষদের সুপারিশগুলো হলো- বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) কর্তৃক সমূদয় বকেয়া মওকুফ করে এয়ারলাইনটি পুনর্জীবিত করার অনুমতি প্রদান করা। বিমানবন্দরে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা বিভিন্ন অকেজো যন্ত্রাংশ, যানবাহন ইত্যাদি প্রাপ্য সর্বোচ্চ দামের বিনিময়ে বিক্রি করে, প্রাপ্ত অর্থ কোম্পানির পরিচালনা ব্যয় নির্বাহের অনুমতি প্রদান করা। কোম্পানির মালিকানাধীন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা উড়োজাহাজগুলো বিক্রির জন্য একটি টেন্ডার কমিটি গঠনপূর্বক তা সত্বর বিক্রির ব্যবস্থা গ্রহণ করা। সর্বশেষ কোম্পানির রেজিস্টার্ড ও অস্থায়ী অফিসে রক্ষিত মূল্যবান ফাইলপত্র ও অন্যান্য অফিস সামগ্রী উদ্ধারে প্রয়োজনীয় আইনগত সহায়তা প্রদান।

এ সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে ইউনাইটেড এয়ারকে পুনর্জীবিত করে উড্ডয়ন করানো সম্ভব হবে বলে মনে বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ।

বিএসইসি সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে ইউনাইটেড এয়ারে কাছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) মোট ৩৫৫ কোটি ৩৩ লাখ ৮৯ হাজার ৭৫১ টাকা বকেয়া রয়েছে। এ টাকা মওকুফের জন্য ২০২১ সালের অক্টোবরে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলীকে অনুরোধ জানিয়েছে বিএসইসি। একইসঙ্গে কোম্পানিটির এয়ার অপারেটর সার্টিফিকেট (এওসি)  নবায়ন করার বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানানো হয়। এদিকে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার্থে বেবিচকের মূল পাওনা বাদে সারচার্জসহ অন্যান্য সকল পাওনা মওকুফ করার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠায় বিএসইসি। তবে কোম্পানিটি বন্ধ হওয়ার কারণ, বন্ধ হওয়ার পেছনে কারা জড়িত ও জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা জানতে চেয়ে বিএসইসিকে চিঠি দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। একইসঙ্গে মন্ত্রণালয় বকেয়ার পুরো টাকা ইউনাইটেড এয়ারকে পরিশোধ করতে হবে বলেও জানানো হয়েছে।

তবে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের সারচার্জ মওকুফে সম্মতি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি তার কার্যালয়ের সচিবকে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) মূল পাওনার ওপর আরোপিত সারচার্জ মওকুফের নির্দেশ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিনিয়র সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়াকে এই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এদিক অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের আগের পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএসইসি। একইসঙ্গে কোম্পানিটির আর্থিক অসঙ্গতি খতিয়ে দেখতে ২০১২ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সমাপ্ত হিসাব বছরের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন বিশেষ নিরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কোম্পানিটির পূর্বের পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে তহবিল তসরুপের অভিযোগ রয়েছে। তাই বিষয়টি খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এছাড়া আগের পরিচালনা পর্ষদ কারসাজির উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে লোকসানি কোম্পানিতে পরিণত করেছে কিনা তা খতিয়ে দেখবে কমিশন। এদিকে স্টক এক্সচেঞ্জের লিস্টিং রেগুলেশন লঙ্ঘনের কারণে কোম্পানিটির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ক্যাপটেন তাসবিরুল আহমেদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কাজ করছে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই)।

ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ না দেওয়া ও বিভিন্ন সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘনের কারণে ২০১৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর মূল মার্কেট থেকে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে স্থানান্তরিত হয়েছে। একইসঙ্গে গত ছয় বছরের বেশি সময় ধরে কোম্পানিটির সব ধরনের ব্যবসায়িক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। দীর্ঘ সময় ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে অবস্থান করা কোম্পানিটির আর্থিক অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। এ ব্যর্থতার জন্য কোম্পানিটির সাবেক স্বতন্ত্র পরিচালকসহ পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা দায়ী বলে মনে কমিশন। পরবর্তীতে চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি ইউনাইটেড এয়ারকে ওটিসি মার্কেটে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় বিএসইসি। ২০২১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর বিএসইসি ওটিসি মার্কেট বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে ওটিসি মার্কেটের আওতাভুক্ত কোম্পানিগুলোকে আর্থিক সক্ষমতা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার ভিত্তিতে এসএমই প্ল্যাটফর্ম ও অল্টারনেটিভ ট্রেডিং বোর্ডে (এটিবি) স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএসইসি। এরই ধারাবাহিকতায় বিএসইসি’র সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কোম্পানিটিকে ওটিসি থেকে অল্টারনেটিভ ট্রেডিং বোর্ডে স্থানান্তর করা হবে।

এদিকে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার্থে ২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি এয়ারওয়েজের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করে বিএসইসি। ইউনাইটেড এয়ারওয়েজে মনোনীত স্বতন্ত্র পরিচালকরা হলেন, কাজী ওয়াহিদ উল আলম, এম সাদিকুল ইসলাম, মাসকুদুর রহমান সরকার, এটিএম নজরুল ইসলাম, প্রফেসর ড. বদরুজ্জামান ভূঁইয়া, মুহাম্মদ ইউনুস, মোহাম্মদ শাহ নেওয়াজ ও সৈয়দ এরশাদ আহমেদ। কোম্পানিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন কাজী ওয়াহিদ উল আলম।

প্রসঙ্গত, ২০১০ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ। কোম্পানিটি ১ কোটি শেয়ার ছেড়ে পুঁজিবাজার থেকে ১০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করে। তালিকাভুক্তির পরের বছর ২০১১ সালে কোম্পানিটি ১০ টাকা ফেসভ্যালুর সঙ্গে অতিরিক্ত ৫ টাকা প্রিমিয়াম নিয়ে ২১ কোটি রাইট শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে ৩১৫ কোটি টাকা পুঁজিবাজার থেকে সংগ্রহ করে। ৮২৮ কোটি ৯ লাখ ৮০ হাজার টাকা পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানিটির মোট শেয়ার সংখ্যা ৮২ কোটি ৮০ লাখ ৯৮ হাজার ৪৮০টি। এর মধ্যে উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের হাতে ২.৫ শতাংশ, প্রতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের ১১.০৭ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে ৮৬.৪৩ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। রোববার (১১ ডিসেম্বর) ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের শেয়ার সর্বশেষ ২.২০ টাকায় লেনদেন হয়েছে।

ঢাকা/এনএইচ

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়