ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৫ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

কিসসাকারের কিচ্ছা

অহ নওরোজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৫৩, ২০ নভেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কিসসাকারের কিচ্ছা

ঢাকা আন্তর্জাতিক লোক উৎসবে ইসলাম উদ্দিন

অহ নওরোজ :  ভাটিয়ালি ভাওয়াইয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশে পালাগান এই মাটির  অনন্য সম্পদ। মৈমনসিংহ গীতিকার সূত্রমতে, মধ্যযুগে বাংলা ভাষায় কাব্য,  লোকগীতি  ও পালাগানের আসল প্রচলন ঘটে। যার বিকাশ ঊনবিংশ শতাব্দীতে সবচেয়ে বেশি ঘটে। আর এসব গানের ভাঙ্গা গড়ার মাধ্যমেই বাংলা গান শুরু করেছে তার আধুনিকতার পথচলা।

 

সাম্প্রতিককালে পালাগানের শিল্পী হিসেবে বাংলা সংস্কৃতির স্বকীয়তা জিইয়ে রাখার পেছনে যারা কাজ করছেন তাদের মধ্যে অন্যতম ইসলাম উদ্দিন। কিশোরগঞ্জের এই কিসসাকার চলতি মাসে অনুষ্ঠিত ঢাকা আন্তর্জাতিক লোক উৎসবের মাধ্যমে নতুন করে আলোচনায় ওঠে এসেছে।

 

এ উৎসবের প্রথম পর্বে তিনি বন্দনাগীতি পরিবেশন করেন। এরপর দ্বিতীয় পর্বে নেচে নেচে পরিবেশন করেন ‘উথুলা সুন্দরী’র পালা। এই উৎসবে তার দুই পর্বের পরিবেশনা পালাগানের প্রতি নতুন করে তরুণদের আগ্রহী করে তুলেছে। কারণ এই পরিবেশনার সময় তরুণরা এই মাটির গানে গলা মিলিয়ে একাত্মতা প্রকাশ করেন। অনেককে নাচতেও দেখা যায়।

 

ইসলাম উদ্দিন কিসসাকার মূলত একজন পালাকার ও অভিনয়শিল্পী। অভিনয় দিয়ে যাত্রা শুরু হলেও তিনি নিজেকে পালাকার বলতে পছন্দ করেন। সংগীত পরিবেশনায় ইতোমধ্যেই তিনি তৈরি করেছেন নিজস্ব রীতি। লোকনাট্যের গায়েন দোহার রীতির অভিনয়শৈলীতে এক ভিন্ন আবেদনের কারনে তিনি বিস্ময়কর গায়েন হিসেবে খ্যাতি পেয়েছেন। তার অভিনয় শক্তি ও গায়েন রীতির অভিনয়ের কৌশল দিয়ে এক অনন্য দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছেন। ইসলাম উদ্দিন নিজস্ব সেই ভঙ্গিতে ময়মনসিংহ অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী পালাগানগুলোকে দেশে ও দেশের বাইরে দর্শকদের কাছে পরিচিত করে তোলার কারণে মূলত ভিন্নধর্মী পালাকার হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত।

 

ইসলাম উদ্দিনের জন্ম ১৯৬৯ সালের ২ আগস্ট কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ থানার নোয়াবাদ গ্রামে। পালাকার হিসেবে ইসলাম উদ্দিনের যাত্রা শুরু খুব অল্প বয়সে। ছেলেবেলায় তিনি গ্রামীণ নাট্যপালার অভিনয়ের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। প্রথম পর্যায়ে ‘কাশেম-মালা’ ও ‘দস্যু বাহরাম’ নামের দুটি ঝুমুর যাত্রাপালায় অভিনয় করেন। তখন তার বয়স ১২/১৩। এরপর ১৯৮৯ সালের শেষের দিকে তিনি নিজেই ‘ইসলাম উদ্দিন কিসসাকার ও তার দল’ নামে একটি পালা গানের দল গড়ে তোলেন। এই দলের মাধ্যমে তার প্রথমদিকের দুইটি কিচ্ছা গান ‘উথুলা সুন্দরী’ ও ‘কাকাধরের খেলা’ প্রথমবারের মতো পরিবেশিত হয়। এরপর নিয়মিতভাবে দল নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে পরিবেশন করতে লাগলেন ‘আমির সাধু’, ‘সুন্দরমতি’, ‘রাম-বিরাম’, ‘গেন্দেকুল’, ‘জাহাঙ্গীরবাদশা’, ‘মতিলাল’, ‘ফিরোজ খাঁ’, ‘রূপকুমার’ ইত্যাদি কিচ্ছা গান। ইসলাম পালাকারের ‘কমলারাণী সাগরদীঘি’ পালাটি খুবই জনপ্রিয়।

 

কোমরে জড়ানো কাপড়ের নানাবিধ ব্যবহার পালাকার ইসলাম উদ্দিনের অভিনয়ের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। নারী চরিত্র রূপায়নের ক্ষেত্রে কস্টিউমের সাজেশন হিসেবে এ কাপড়ের শেষ অংশ সহজেই শাড়ির আঁচল হয়ে ওঠে। গায়েন অভিনেতারা নারী চরিত্র হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে নারী পরিচায়ক যে ভঙ্গিগুলো সাধারণত ব্যবহার করেন ইসলাম উদ্দিনের তা অতিরঞ্জন নয় বরং এক সুক্ষ্ম প্রাকৃতিক অভিব্যক্তি আনয়নের প্রয়াস মাত্র। আয়না সামনে নিয়ে সাজগোজ অথবা অরবুলা সুন্দরীর (অরবুলা সুন্দরী ও রাজকুমারের পালা) পালা পরিবেশনের সময় ‘হাঁটু জলে নাইম্যা কইন্যা হাঁটু মাঞ্জন করে’ গানটিতে ইসলাম উদ্দিনের শারীরিক অভিনয় যে রমণীয়তা তৈরি করে তা নাগরিক রুচিকে বাংলার মাটির কথা মনে করিয়ে দেয়।

 

এছাড়া ‘আমার পাগলা ঘোড়া রে-কইর মানুষ কই লইয়া যাও’ গানটি বেশির ভাগ পালাতেই ব্যবহৃত বলে বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু এই গানে ইসলাম উদ্দিনের পরিবেশনা ভক্তদের কাছে বিশেষভাবে প্রশংসিত। ‘অরবুলা সুন্দরী ও রাজকুমারের পালা’তে এ গানটি গাওয়ার সময় ঘোড়া নিয়ে উজীরপুত্র মুনীর রূপী ইসলাম উদ্দিন পালাকারের যে যাত্রা,  তা বিশ্বাসযোগ্য ও কল্পনাসমৃদ্ধ আঙ্গিকাভিনয়ের গুণে শত শত মাইলের প্রকৃতিকে চোখের সামনে দিয়ে পার করে দেয়। যার মাধ্যমে মূলত প্রতিফলিত হয় এদেশের মানুষের বিভিন্ন কল্পনা ও লোককথার চিত্র।

 

তবে মঞ্চে মঞ্চে পালাগান গেয়ে বেড়ানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেননি এই গুণী শিল্পী। এদেশের পালাগানকে তরুণদের মাঝে পৌঁছে দেওয়া এবং বিশ্বদরবারে তুলে ধরার জন্য তিনি কাজ করে চলছেন। বাংলাদেশের পালাকারদের মধ্যে ইসলাম উদ্দিন-ই সম্ভবত প্রথম যিনি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। ময়মনসিংহ অঞ্চলের এই পালাকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগের প্রশিক্ষক। তার সব থেকে জনপ্রিয় কিচ্ছাপালা ‘কমলারানীর সাগরিদিঘি’ নিয়ে ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনে একটি নবযাত্রার সূচনা করেছে নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগ। এ পর্যন্ত এ বিভাগের শিক্ষার্থীরা নাটকটি ভারতের জাতীয় নাট্যশিক্ষা প্রতিষ্ঠান দিল্লির এনএসডি এবং অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে পরিবেশন করেছে।

 

নিজস্ব বাদ্যযন্ত্রী ও দোহারদের নিয়ে ইসলাম উদ্দিন নিজেও একবার রাষ্ট্রীয়ভাবে লন্ডনে তার কিচ্ছাপালা পরিবেশন করে এসেছেন। তবে লন্ডন সফরে গিয়েও সার্থকতা পেয়েছেন এই পালাকার। তার কিচ্ছাগানের প্রশংসায় লন্ডনের ওই রাষ্ট্রীয় সফরে টনি ব্লেয়ার ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে যৌথভাবে একটি প্রশংসাসূচক পত্র পেয়েছিলেন তিনি। এ পর্যন্ত এ পালাকারের ‘উথুলা সুন্দরী’, ‘অরবুলা সুন্দরী’, ‘সুন্দরমতি’ এই তিনটি কিচ্ছাপালা নিয়ে তিনটি অডিও ক্যাসেট প্রকাশিত হয়েছে। তাছাড়াও প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে বেশ কয়েকটি নতুন পালাগান।

 

 

রাইজিংবিডি/২০ নভেম্বর ২০১৬/ঢাকা/অহ/শান্ত

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়