ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

নকশী কাঁথায় উদ্যোক্তা লাকীর স্বপ্ন 

মিফতাউল জান্নাতি সিনথিয়া || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:১৪, ২৬ নভেম্বর ২০২০   আপডেট: ১৩:২৫, ২৬ নভেম্বর ২০২০
নকশী কাঁথায় উদ্যোক্তা লাকীর স্বপ্ন 

‘নকশী কাঁথা’ আমাদের দেশীয় সংস্কৃতিতে একটি অনন্য নাম। গ্রাম-বাংলার হাজারো কথা সুই-সুতার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার এক ভিন্ন নিদর্শন। এমন একটি শিল্প নিয়ে অনলাইনে ব্যবসা করছেন উদ্যোক্তা ফারহানা আক্তার লাকী। তার ফেসবুক পেজের নাম ‘ফারহানা’স ড্রিম’, যেখানে রয়েছে কাঁথা থেকে শুরু করে পোশাক ও বিভিন্ন নকশী পণ্যের সমারোহ।

পৈতৃক নিবাস শরীয়তপুর জেলায় হলেও খুব বেশি সময় সেখানে কাটানো হয়নি তার। বাবার সেনাবাহিনীতে চাকরির সুবাদে ঘুরে-বেড়িয়েছেন উত্তরে রংপুর সেনানিবাস থেকে দক্ষিণে যশোর সেনানিবাস পর্যন্ত তিনি। বাবা-মায়ের তিন সন্তানের মধ্যে বড় সন্তান লাকী।

যশোরের দাউদ পাবলিক স্কুল থেকে এসএসসি ও বিএএফ শাহীন কলেজ তেজগাঁও থেকে এইচএসসি পাস করেন তিনি। পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগ থেকে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করেন। চার বছর একটি প্রথম সারির ফার্মাসিটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রির কোয়ালিটি কন্ট্রোল ডিপার্টমেন্টে কর্মরত ছিলেন লাকী।  

সংসার ও সন্তানের যথাযথ দেখাশোনার জন্য পুরোদস্তুর গৃহিণীতে মনোযোগী হয়ে পড়েন তিনি। প্রয়োজনের তাগিদে চার বছর কাটিয়েছেন দক্ষিণ কোরিয়ায়। মূলত দক্ষিণ কোরিয়ায় থাকাকালীন অবস্থায় নকশি কাঁথা নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনাটি তার মাথায় আসে।

বোঝার পর থেকেই হাতের কাজের প্রতি অনেক বেশি দুর্বলতা ছিল তার। তাই শখের বসে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কিছু হাতের কাজ শিখেছিলেন তিনি। পরবর্তী সময়ে বাবার চাকরির সুবাদে যখন যশোরে ছিলেন, তখন খুব কাছ থেকে এই সুচিশিল্পের সঙ্গে জড়িত সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল তার।

দেশে ফিরেই নকশি কাঁথা নিয়ে কাজ করার বিষয়টি বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য যথেষ্ট কঠিন হয়ে পড়েছিল তার পক্ষে। একদিকে সমাজে মেয়েদের এমন ব্যবসায় যথেষ্ট প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এখনো মেয়েদের ব্যবসায় সেভাবে সম্মানজনক অবস্থান দেওয়া হয় না। তার উপরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে অনলাইনে কাঁথা সেল করা। প্রথমে ঘরে-বাইরে কারো কাছ থেকে সমর্থন পাননি তিনি।

ফারহানা লাকী বলেন, “দেশে ফেরার কিছু দিন পরে আমি (উইমেন অ্যান্ড ই- কমার্স) উইর সঙ্গে যুক্ত হই। আর তখনই আমার সামনে আমার স্বপ্নপূরণের দরজা উন্মুক্ত হয়। আমার স্বামী ডক্টর নুরুল হুদা ভূঞার সহযোগিতায় ও রাজীব স্যারের সার্বিক উৎসাহ, অনুপ্রেরণায় আমার উদ্যোগ ‘Farhana's Dream’ এর পথচলা শুরু হয়।

আমার পেজের প্রধান পণ্য হচ্ছে হাতের কাজের এক্সক্লুসিভ নকশি কাঁথা। এর পাশাপাশি সাধারণ কাঁথা, হাতের কাজের সব ধরনের পোশাক, ব্যাগ, বেড সিট, ওয়ালমেটও রয়েছে। এটি সত্যি যে, নকশি কাঁথা কোনো অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নয়। এটি সৌন্দর্য, ভালোবাসা, সৌখিনতা আর দেশপ্রেমের প্রতীক। তাই টাকার মূল্যে একে মাপতে পারবো না।

সুই-সুতার নকশি শিল্পের জন্য যে পরিমাণ সময় আর শ্রম আমাদের শিল্পীরা দিচ্ছে, তার যথাযথ মূল্যায়ন হচ্ছে না। আমাদের দেশে তৈরি নকশী কাঁথা বিশ্ববাজারে ভারতীয় বলে সমাদৃত হচ্ছে। এমন অবস্থায় দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই নকশী কাঁথা নিয়ে আমার স্বপ্ন দেখা শুরু।’’

নকশী কাঁথার গুরুত্বের কথা বলতে গিয়ে লাকী আরও বলেন, “তৃণমূল পর্যায়ে যারা কাজ করেন, তাদের কোনো ধরনের শিক্ষা নেই, নেই কোনো সমন্বয়। যার ব্যাপক চাহিদা থাকার পরেও আমাদের নকশী শিল্পীরা তাদের প্রাপ্য সম্মান ও সম্মানীটুকু পান না। অনেক শিল্পীরাই এখন এই শিল্প থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। জড়িত হচ্ছে অন্য পেশায়। যদি এই নকশী পণ্যগুলোকে আমরা দেশে-বিদেশে সবার সামনে তুলে ধরতে পারি, এর জনপ্রিয়তা, গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে পারি, তখনই শুধু সম্ভব হবে এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখা।

যারা নকশী পণ্য নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী, তাদের প্রথম লক্ষ্য হবে যতটা সম্ভব এই পণ্যটি সবার সামনে তুলে ধরা অর্থাৎ এর প্রচার-প্রসার বাড়ানো। এটি আমাদের একান্ত নিজস্ব পণ্য, আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সামাজিকতার অংশ। আর সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই এই পণ্যটি সবার সামনে উপস্থাপন করতে হবে। এর ফলে সম্ভব হবে এই পণ্যের সঙ্গে জড়িত সবার স্বীকৃতি।

তিনি জানান, নকশি পণ্য নিয়ে তার মূল লক্ষ্য, বিদেশে দেশীয় পণ্য হিসেবে নকশী কাঁথাকে প্রতিষ্ঠিত করা। পৃথিবীর সর্বোত্র এই পণ্যটি এমনভাবে ছড়িয়ে যাবে যে, যারাই দেখবেন, তারা এক বাক্যে বলবেন এটা বাংলাদেশি পণ্য। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করবে দেশীয় নকশী কাঁথা।  এখন পর্যন্ত পাঁচটি দেশে তার উদ্যোগের নকশী কাঁথা বিক্রি হয়েছে। সেখান থেকে যথেষ্ট ভালো সাড়া পেয়েছেন তিনি। 

ইতোমধ্যে শুধু উই গ্রুপে লাকী পাঁচ লাখ টাকার উপরে নকশী পণ্য বিক্রি করেছেন। তার মূল লক্ষ্য ছিল সবার মাথায় ‘নকশী কাঁথা’ শব্দটি গেঁথে দেওয়া ও নামের সঙ্গে সঙ্গে সবার চোখের সামনে চমৎকার রঙিন একটি নকশি কাঁথার দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা। 

ব্যাপকভাবে প্রচারের মাধ্যমে তিনি পণ্যটিকে আন্তর্জাতিক বাজারে সমাদৃত একটি পণ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চান। এভাবেই দেশীয় নকশী কাঁথা একদিন তার নিজের মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে উঠবে আর ফিরে পাবে তার হারানো ঐতিহ্য।

ঢাকা/মাহি

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়