ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

মহেশখালীর মিষ্টি পান

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৫১, ২৭ মার্চ ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মহেশখালীর মিষ্টি পান

মহেশখালীর পানের বরজ

ফেরদৌস জামান : ফোকগান শিল্পী শেফালী ঘোষের কন্ঠে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক জনপ্রিয় গান ‘যদি সুন্দর একখান মুখ পাইতাম, মহেশখালীর পান খিলি তারে বানাই খাওয়াইতাম...।’ উপমহাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী রুনা লায়লার কন্ঠে শোনা যায়- ’পান খাইয়া ঠোঁট লাল করিলাম, কেউ বন্ধু হায় তো হইলো না ...।’

 

ইতিহাসবিদদের ধারণা, দক্ষিণ এশিয়ার আধিবাসীরা পান খাওয়ার অভ্যাস রপ্ত করেন হাজার বছর আগে থেকেই। পান যে অত্র অঞ্চলের সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ তার প্রমাণ মেলে খোদ শ্রীমদ্ভগবতে। তাতে দেবতা কৃষ্ণের পান খাওয়ার অভ্যাসের কথা পাওয়া যায়।

 

জানা যায় ভারতবর্ষের রাজা, স¤্রাটদের অন্দরমহলেও পান খাওয়ার প্রচলন ছিল। স¤্রাট জাহাঙ্গীরের প্রিয়তমা নূরজাহানের পান খাওয়ার অভ্যাস ছিল এবং তিনি তা অন্দরমহলের অন্যান্যদের নিকট জনপ্রিয় করে তোলেন।

 

বাংলাদেশে উৎপাদিত বাংলা, মিঠা, সাচি, কর্পূরী, গ্যাচ, নাতিয়াবাসুত, উজালী, মাঘি, মহানলী, চেরফুলী, ভাবনা, সন্তোষী, জাইলো, ভাওলা, ঝালি, প্রভৃতি জাতের মধ্যে মহেশখালীর মিষ্টি পান উল্লেখযোগ্য।

 

বাংলাদেশের একমাত্র পাহাড়ি দ্বীপ মহেশখালী। এখানকার অধিবাসীদের অন্যতম সুপ্রাচীণ ও ঐতিহ্যবাহী পেশা পান চাষ। পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় এর ভূমি পান চাষের জন্য বিশেষ উপযোগী। মহেশখালীর পানের বিশেষত্ব হল তার মিষ্টি স্বাদ, যার কারণে এই পান সারাদেশে বিখ্যাত।
এক সময় মহেশখালীর মিষ্টি পান মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হত। অধিকন্তু, এখানকার পানের সুনাম দেশের সীমানা পেরিয়ে এশিয়া মহাদেশ ছাড়াও ইউরোপ-আমেরিকাতেও ছড়িয়ে রয়েছে। কারও কারও মতে আফ্রিকা মহাদেশের কিছু কিছু দেশও বাদ যায় না। সমগ্র বাংলাদেশের দুই তৃতীয়াংশ মিষ্টি পান মহেশখালী দ্বীপে উৎপাদিত হয়ে থাকে।

 

মহেশখালীর শাপলাপুর ইউনিয়নের পান চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পান অত্যন্ত স্পর্শকাতর ফসল। সুতরাং, পান চাষের জন্য বিশেষ দক্ষতা ও দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা জরুরী। পান খেতকে বলা হয় পানের বরজ।

 

মহেশখালীর পানের বরজ সাধারণত দুই ধরণের-পাহাড়ি বরজ এবং বিল বরজ। উপজেলার বড় মহেশখালী, হোয়ানক, কালারমারছড়া, ছোট মহেশখালী ও শাপলাপুর ইউনিয়নের পাহাড়ের ঢালু ও সমতল কৃষি জমিতে যুগ যুগ ধরে পান চাষ করে আসছে স্থানীয় পানচাষিরা। জমির শ্রেণি অনুসারে পাহাড়ি এলাকার ভূমিতে পান চাষ দুই/তিন বছর স্থায়ি হলেও সমতল জমিতে পান চাষ হয় মাত্র ছয় মাস। সমতল জমিতে সেপ্টেম্বর/অক্টোবর মাস থেকে শুরু হয়ে মে/জুনে শেষ হয়। অপরদিকে পাহাড়ি ঢালু জমিতে পান চাষ হয় বছরের যে কোন সময়। এমনটাই জানান স্থানিয় পানচাষিরা।
সপ্তাহে অন্তত দুই দিন মহেশখালীর বিভিন্ন এলাকায় পানের হাট বসে থাকে। উপজেলার জনতা বাজারে গিয়ে দেখা যায়, বরজ থেকে সদ্য ভেঙ্গে আনা থরে থরে পান নিয়ে বসে রয়েছেন অনেক চাষি।

 

 

কক্সবাজারের চকরিয়া, বান্দরবান, চট্টগ্রাম, পটিয়া, বাঁশখালী সহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যপারিরা এসব বাজার থেকে পান সংগ্রহ করে থাকে। তারপর ট্রাক বোঝাই করে পাঠিয়ে দেয় দেশের বিভিন্ন জায়গায়। এসব পাইকারি বাজারে পানের আকার ভেদে প্রতি বিরা বিক্রি হয় ৮০ থেকে ২৫০ টাকা দরে।

 

শাপলাপুর ইউনিয়নের একাধিক পানচাষির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, খেত প্রস্তুত থেকে শুরু করে বরজ থেকে পরিপক্ক পান পাতা সংগ্রহ পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে অনেক বেশি সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। অধিকন্তু মানতে হয় যুগ যুগ ধরে চলে আসা কিছু সংস্কার। যেমন-নাপাক বা অপরিস্কার শরীরে , গরুর মাংশের তরকারী খেয়ে এবং মাথায় নারকেলের তেল ব্যবহার করে বরজে প্রবেশ অনুচিৎ। অনেক ক্ষেত্রে বরজে নারীদের প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত।

 

পান চাষের প্রধান ঝুঁকি অতি বৃষ্টি। সেপ্টেম্বরে শেষ বর্ষা অর্থাৎ পান চাষ মৌসুমের শুরুতে দেখা যায় বহু বরজ নষ্ট হয়ে যায়। ২০-২৫ শতক পরিমাণ জমিতে একটি পানের বরজ প্রস্তুতে ব্যয় হয় লক্ষাধিক টাকা। বৃষ্টির মাত্রা অধিক হলে চাষিরা নিশ্চিত লোকসানে পড়ে।

 

নানা কারণে মহেশখালীর পান চাষ আর সেই পূর্বের অবস্থায় নেই। কয়েক বছর ধরেই চাষিরা নানামুখী সমস্যায় জর্জরিত। কখনও কখনও ভালো ফলন হলেও লোকসানের স্বীকার হতে হচ্ছে। কখনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়, কখনও রোগ-বালাইয়ের উপদ্রব, আবার কখনও বাজার মূল্য ধসের কারণে চাষিরা যেন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হিমসিম খাচ্ছে।

 

বর্তমানে পান চাষের উপকরণ শন, উল, বাঁশ, কীটনাশক, সার, খৈল ইত্যাদির দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে পান চাষ করতে অধিক টাকার প্রয়োজন পড়ছে। যার কারণে চাষিরা জীবিকার তাগিদে মহাজনের নিকট থেকে উচ্চ মুনাফার শর্তে টাকা ধার নিতে বাধ্য হচ্ছে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে বাম্পার ফলনের পরও তাদের মুখে হাসি ফুটছে না। লাভের বড় অংশটি চলে যায় মহাজনের খাতায়। সংশ্লিষ্টদের ধারণা চাষিরা এই দূর্দিনে যদি সরকারীভাবে পৃষ্ঠপোষকতা পায় তাহলে পূর্বের দিন ফিরে আসতে পারে।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ মার্চ ২০১৬/শাহ মতিন টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়