ঢাকা     রোববার   ২১ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৬ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

প্রাচীন সভ্যতার ৭টি সাংস্কৃতি রাজধানী

রুহুল আমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:১২, ২১ অক্টোবর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
প্রাচীন সভ্যতার ৭টি সাংস্কৃতি রাজধানী

রুহুল আমিন : সমাজ নির্মাণে কিংবা সামাজিক পরিচয় বিকাশে সংস্কৃতির গুরুত্ব অপরিসীম। সাংস্কৃতিক বিচারে সভ্যতার পরিচয় পরিমাপ করা যায়। আমরা দূর অতীতে দৃষ্টিপাত করলে দেখব, যোগাযোগ ব্যবস্থা, খাদ্য পর্যাপ্ততা এবং অনেক ক্ষেত্রে শত্রুর হাত থেকে সুরক্ষা প্রভৃতি বিবেচনায় যে জনবসতি এবং তাকে কেন্দ্র করে যে সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল সেখানকার সংস্কৃতি গৌরবময় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। এই সাম্রাজ্যগুলোতে ছোট ছোট যে শহর সেগুলোই ছিল মূলত সেই সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র। যদিও এখন সেগুলোর অধিকাংশই ধ্বসংপ্রাপ্ত। তারপরও যেগুলো অবশিষ্ট রয়েছে সেখানকার শিল্প-সংস্কৃতি, স্থাপত্যবিদ্যা ও রাজনৈতিক তত্ত্বে অবদান রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে কিছু শহর আছে যেগুলো চিন্তার প্রসার ও সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। শিল্প-সংস্কৃতিতে অগ্রগামী এই শহরগুলো সাম্রাজ্য ছাপিয়েও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে প্রভাববিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। এবং তারা পরিচিতি হতো ‘সাংস্কৃতিক রাজধানী’ হিসেবে। ঐশ্বর্যমণ্ডিত সেইসব ৭টি সাংস্কৃতিক রাজধানী নিয়ে এই লেখা।

 

১. কোস্কো : ষোড়শ শতাব্দিতে পৃথিবীর সম্ভাব্য সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য হলো ইনকা। এটি প্রাক-কলাম্বিয়ান আমেরিকান সাম্রাজ্য। এক সময় কোস্কো ছিল ইনকার রাজধানী। বর্তমানে কোস্কো পেরুর একটি শহর। তবে পনেরো শতাব্দিতে ইনকা সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী ছিল। কোস্কোকে ভিত্তি করে ইনকা সাম্রাজ্য তখন ইকুয়েডরের কুইটো থেকে চিলির সান্তিয়াগো পর্যন্ত সাম্রাজ্য বিস্তার করে। ৪০ হাজারের বেশি মানুষ ইনকার নিয়ন্ত্রণে এসেছিল তখন। যা পরবর্তীতে স্প্যানিশ যোদ্ধারা জয় করে নেয়।

 

 

কোস্কো নিজেই পশ্চিম গোলার্ধের সবচেয়ে পুরাতন শহর। ইনকা সাম্রাজ্যের স্থাপত্যশৈলী ছিল অসাধারণ। মিসরের পিরামিডের নির্মাণশৈলী যেমন আধুনিক মানুষকে বিস্মিত করে, ঠিক তেমনি নান্দনিক ছিল ইনকাদের স্থাপত্যশৈলী। ইনকাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্টেট অব দ্য আর্ট নিদর্শন যা এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত তা হলো-মাচুপিচু। সমতল থেকে প্রায় ১ হাজার ৮০০ ফুট উপরে এক দুর্গ শহর এটি। প্রযুক্তিহীন ওই সাম্রাজ্যের এতো উপরে পাথর তুলে কীভাবে তা নির্মাণ করা হয়েছে তা আজও এক বিস্ময়। পাথরের নির্মাণশৈলীর কারণে এই সভ্যতা বিখ্যাত। যা আজকের স্থাপত্যবিদ্যার জন্য স্মরণীয়। পরে বসন্ত রোগে ইনকার ৬৫-৯০ ভাগ মানুষ মারা গিয়েছিল।

 

২. বুখারা : পশ্চিম উজবেকিস্তানের বর্তমান রাজধানী শহর বুখারা। বুখারা রেশমের জন্য বিখ্যাত। এ ছাড়াও এর আশপাশের অঞ্চলে প্রাকৃতিক গ্যাস, তুলা ও ফল উৎপাদিত হয়। আছে বস্ত্র, কার্পেট ও পশমের কারখানা। বুখারাতে অনেক স্থাপত্য নিদর্শনও আছে, যেগুলোর কিছু কিছু ৯ম শতকের।

 

 

খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে বুখারা প্রতিষ্ঠা করা হয়। বুখারাতে প্রায় ২০০০ হাজার বছর পূর্বেই বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। বুখারা আরবি শেখার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল তখন। ৯ম খ্রিস্টাব্দেই বহু শিল্পী, কবি ও বিজ্ঞানী বুখারায় ভিড় করেছিল। তখনকার এক পণ্ডিত বুখারাকে বর্ণনা করেছিলেন ‘সময়ের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের মিলন স্থল, বিশ্বের শিল্প-সংস্কৃতির তারকা ব্যক্তিদের উত্থানের জায়গা এবং সময়ের কৃতি সন্তানদের সম্মেলন স্থল’ হিসেবে। তবে ওই সময়ের আরেক কবি বুখারাকে পৃথিবীর পায়ুপথও বলেছিলেন।

 

৩. ব্যাবিলন : ব্যাবিলনের খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ বছর আগের ইতিহাস পর্যন্ত খোঁজ করে পাওয়া যায়। কিন্তু এই ইতিহাসে জানা যায় খ্রিষ্টপূর্ব ৬০৫ থেকে ৫৬১ পর্যন্ত এই সভ্যতা সাংস্কৃতিগতভাবে কোনো গুরুত্বপূর্ণ সভ্যতা ছিল না। তবে তখন ব্যাবিলন ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শহর। এসাজিলা ছিল শহরের প্রাণকেন্দ্র। যেখানে একটি মন্দির কমপ্লেক্স ছিল এবং তা মার্ডক দেবতাকে নিবেদিত ছিল। আর ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যানকে পৃথিবীর সপ্তাচার্যের একটি বিবেচনা করা হয়। পার্সিয়ানদের নিয়ন্ত্রণে থাকার সময়ে এই শহর সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। পরবর্তীতে আলেকজান্ডার দি গ্রেটের সংক্ষিপ্ত রেনেসাঁর সময়ও এটি আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কারণ আলেকজান্ডারের স্বল্প সময়ের স্থায়িত্বে ব্যাবিলনকে তখন শিক্ষা এবং বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র করা হয়।

 

 

৪. বাগদাদ :  ৭৬২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত, যখন আব্বাসীয় খলিফা আল মানসুর বাগদাদকে রাজধানী বানাননি, এই শহর তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল না। মানসুর বিশাল এলাকায় তার সাম্রাজ্য বিস্তার করেন। তিনি পশ্চিমে মরোক্কো ও পূর্বে আফগানিস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত করেন এবং তখনই বাগদাদ বিশ্বের সবচেয়ে ধনী শহরে পরিণত হয়।

 

 

তখন বাগদাদ ছিল সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানের জন্য প্রাণকেন্দ্র। বিশেষ করে প্রাচীন গ্রিক গ্রন্থগুলো নিশ্চিত সংরক্ষণের জন্য আরবিতে অনুবাদ করা হয় এই সময়। এই তালিকায় এরিস্টটল, গ্যালেনসহ আরো অনেকের গ্রন্থ ছিল।

 

এই সময়ে রাজী ও আল-কিন্দির মতো স্কলাররা চিকিৎসা, দর্শন ও জ্যোর্তিবিদ্যায় নুতন যুগের সূচনা করেন। আর খলিফা মা’মুনের সময় একটি পর্যবেক্ষণাগার প্রতিষ্ঠা করা হয়। যাকে রাষ্ট্রীয় ব্যয়ে পৃথিবীর প্রথম সম্ভাব্য বড় ধরনের বৈজ্ঞানিক প্রকল্প ধরা হয়। যদি বাগদাদে এটা না হতো তবে প্রাচীন বিশ্বের সঙ্গে বর্তমান সময়ের সংযোগ করা খুব কঠিন হতো বলে ধারণা করা হয়।

 

৫. আলেকজান্দ্রিয়া : শহরটি আলেকজান্ডার দি গ্রেট ৩৩১ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন। আলেকজান্দ্রিয়া এক সময়ে বিশ্বের বিখ্যাত শহর ছিল। মিসরে এর অবস্থান। শহরটিতে প্রচুর বাতি থাকার কারণে বলা হতো ‘বাতিঘরের শহর’। সেখানে একটি যাদুঘর ছিল যা আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরি হিসেবে পরিচিতি ছিল। এই লাইব্রেরিতে ওই সময়ের বিখ্যাত ব্যক্তিরা আসা-যাওয়া করতেন। এদের মধ্যে রয়েছেন জ্যামিতির জনক ইউক্লিড, বিখ্যাত ভূগোলবিদ টলেমি, দার্শনিক প্লটাইনাস ও আর্কিমিডিস।

 

 

পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর এবং আরবিতে ভাষান্তরের আগে বহু প্রাচীন গ্রন্থ এই লাইব্রেরিতে সংরক্ষণ করা হয়। রোমান সভ্যতার পতন ও ইসলামি সভ্যতার উত্থানের এই অন্ধকার যুগের আলেকজান্দ্রিয়া ছিল ফ্যান্টাসিজমের ভাণ্ডার। উল্লেখ্য যে, হিব্রু ভাষায় লেখা বাইবেল গ্রিকে ভাষান্তর করা হয় আলেকজান্দ্রিয়ায়।

 

৬. রোম : রোম ছাড়া এই তালিকা অসমাপ্ত রয়ে যাবে। কারণ পশ্চিমা সংস্কৃতির উৎকর্ষতায় এই শহর বিরাট ভূমিকা রেখেছে। আমরা রোমান সভ্যতার শক্তিশালী প্রজাতন্ত্রের কথা জানি এবং ইউরোপ জয়ের কাহিনিও জানি। এও জানি যে অন্য সম্রাটদের কয়েক দফা আক্রমণে রোমান সাম্রাজ্য ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে যায়। বলা হয়ে থাকে জ্ঞানের এমন কোনো শাখা নেই যা রোমান চিন্তাবিদদের দ্বারা প্রভাবিত হয়নি। শিল্প, স্থাপত্য, আইন ও রাজনীতি সব জায়গায় রোমান সভ্যতার ভূমিকা আছে।

 

 

৭. এথেন্স : রোমের মতো এথেন্সও খুব গুরুত্বপূর্ণ শহর। তবে এই তালিকায় এথেন্স সবচেয়ে উপরের স্থান পাওয়ার যোগ্যতা রাখে। এমনকি রোমের চেয়েও। কারণ রোম শহরের বেশির ভাগ অর্জনই এথেন্সবাসী থেকে রোমানরা কি শিখেছেন তার উপর নির্ভর করে। পশ্চিমা শিল্প ও দর্শনে এথেন্সের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। যা অন্য কোনো শহরের নেই।

 

 

৪৮০ খ্রিষ্টাব্দে আপনি যদি এথেন্সের কোনো সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম নিতেন, তবে আপনার কৈশোরের সময়গুলো কাটত বিয়োগান্তক নাটকের জনক ইস্কাইলাসের নাটকের মঞ্চায়ন দেখে। যেখানে স্বয়ং ইস্কাইলাস অভিনয় করছেন। আর পরিণত বয়সে দেখা হতো তরুণ নাট্যলেখক সোফোক্লেস ও ইউরিপিডিসের সঙ্গে। আর কৌতুক অভিনেতা ও নাট্যলেখক অ্যারোস্টোফেন এবং ইতিহাসবিদ হেরোডেটাস ও থুসিডাইডিস আপনার মদের পার্টিতে উপস্থিত হতো। নগর রাস্তায় সক্রেটিস আপনাকে জ্বালাতন করতেন।

 

পরিশেষে আপনার বৃদ্ধ বয়সে আপনি দেখতেন স্পার্টা এবং তার মিত্রদের দ্বারা এথেন্সের পতন ঘটেছে। আর সক্রেটিসকে এথেন্সের নাগরিকরা মৃত্যুদণ্ড দিল। এক জীবনে আপনি সাক্ষী হতেন একটি শহরের সমগ্র স্বর্ণযুগের এবং পশ্চিমা সভ্যতার উন্নয়ন যা আমরা জানি।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২১ অক্টোবর ২০১৬/রুহুল/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়