ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

নেতাজি ছিলেন শক্তিরই প্রতিভূ

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৩২, ২৩ জানুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নেতাজি ছিলেন শক্তিরই প্রতিভূ

শাহ মতিন টিপু: ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে ভারতবর্ষ থেকে বিতাড়ণ আন্দোলনে যে সকল মহান ব্যক্তি ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু তাদের মধ্যে অন্যতম।

এই মহান বিপ্লবী নেতার ১২২তম জন্মবার্ষিকী আজ। ১৮৯৭ সালের ২৩ জানুয়ারি তিনি উড়িষ্যার কটক শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈত্রিক নিবাস ছিল পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার কোদালিয়া গ্রাম। তার পিতা আইনজীবী জানকীনাথ বসুর কর্মক্ষেত্র ছিল কটক।

অহিংসায় নয়, উদারতায় নয়, শক্তি প্রয়োগ করেই ব্রিটিশকে ভারত থেকে তাড়াতে হবে- এই মন্ত্রকে ধারণ করে সুভাষ চন্দ্র বসু আমৃত্যু লড়াই-সংগ্রাম চালিয়েছেন।

নেতাজি সুভাষ ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের সবচেয়ে বর্ণময় ব্যক্তিত্ব। দেশের বাইরে গিয়ে বিদেশি শক্তির সাহায্যে এক বিরাট সেনাবাহিনী গড়ে তুলে তিনি সরাসরি ভারতের ব্রিটিশ সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করেছিলেন।

সুভাষ চন্দ্র পরপর দু-বার ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু মহাত্মা গান্ধির সঙ্গে আদর্শগত সংঘাত এবং কংগ্রেসের বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ নীতির প্রকাশ্য সমালোচনার জন্য তাকে পদত্যাগ করতে হয়। সুভাষ মনে করতেন গান্ধিজির অহিংসার নীতি ভারতের স্বাধীনতা আনার ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। সুভাষ ফরওয়ার্ড ব্লক নামে রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করে যান। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তাকে এগারো বার কারারুদ্ধ করেছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘোষিত হওয়ার পর এই যুদ্ধকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সুবিধা আদায়ের একটি সুযোগ হিসেবে দেখেন। যুদ্ধের সূচনালগ্নে তিনি লুকিয়ে ভারত ত্যাগ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন, জার্মানি ও জাপান ভ্রমণ করেন। জাপানিদের সহযোগিতায় তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজ পুনর্গঠন করেন এবং পরে তার নেতৃত্ব দেন। জাপানের আর্থিক, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও সামরিক সহায়তায় তিনি আজাদ হিন্দ সরকার প্রতিষ্ঠা করেন এবং ব্রিটিশ মিত্রবাহিনীর বিরুদ্ধে ইম্ফল ও ব্রহ্মদেশে (বর্তমান মিয়ানমার) যুদ্ধ পরিচালনা করেন।

সুভাষচন্দ্রই প্রথম ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে মত দেন। জওহরলাল নেহরু সহ অন্যান্য যুবনেতারা তাকে সমর্থন করেন। জাতীয় কংগ্রেসের ঐতিহাসিক লাহোর অধিবেশনে কংগ্রেস পূর্ণ স্বরাজ মতবাদ গ্রহণে বাধ্য হয়।

ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনী (ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি) মূলত গড়ে উঠেছিল জাতীয়তাবাদী নেতা রাসবিহারী বসুর হাতে। ১৯৪৩ সালে রাসবিহারী বসু এই সেনাবাহিনীর দায়িত্ব সুভাষ চন্দ্র বসুকে হস্তান্তর করেন । একটি আলাদা নারী বাহিনী (রাণী লক্ষ্মীবাঈ কমব্যাট) সহ এতে প্রায় ৮৫,০০০ (পঁচাশি হাজার) সৈন্য ছিল। এই বাহিনীর কর্তৃত্ব ছিল প্রাদেশিক সরকারের হাতে, যার নাম দেওয়া হয় ‘মুক্ত ভারতের প্রাদেশিক সরকার’ (আর্জি হুকুমত-এ-আজাদ হিন্দ)। এই সরকারের নিজস্ব মুদ্রা, আদালত ও আইন ছিল। অক্ষ শক্তির ৯টি দেশ এই সরকারকে স্বীকৃতি দান করে।

সুভাষ চন্দ্র বসু আশা করেছিলেন, ব্রিটিশদের উপর আইএনএ-র হামলার খবর শুনে বিপুল সংখ্যক সৈন্য ভারতীয় সেনাবাহিনী থেকে হতাশ হয়ে আইএনএ-তে যোগ দেবে। কিন্তু এই ব্যাপারটি তেমন ব্যাপকভাবে ঘটলনা। বিপরীতদিকে, যুদ্ধ পরিস্থিতির অবনতির সঙ্গে সঙ্গে জাপান তার সৈন্যদের আইএনএ থেকে সরিয়ে নিতে থাকে। একই সময় জাপান থেকে অর্থের সরবরাহ কমে যায়। অবশেষে, জাপানের আত্মসমর্পণের সঙ্গে সঙ্গে আইএনএ আত্মসমর্পণ করে।

১৯৩৪ সালে বার্মার (বর্তমান মিয়ানমার) মান্দালয়ের জেলে বন্দি থাকা অবস্থায় সুভাষ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। ব্রিটিশ সরকার তাকে এক শর্তে মুক্তি দিতে রাজি হন যে, ভারতের কোনো ভূখণ্ড না-ছুঁয়ে তিনি যদি বিদেশে কোথাও পাড়ি দেন তবে মুক্তি পাওয়া যাবে। সুভাষ ইউরোপে যাওয়া মনস্থ করেন ও ভিয়েনা পৌঁছান। দু-বছর চিকিৎসাধীন থাকার সময়ে অবসরে তিনি দুটি বই লেখার সিদ্ধান্ত নেন, তাঁর আত্মজীবনী 'Indian Pilgrim' আর 'India's Struggle for Freedom'। সেই সময়ে তার পাণ্ডুলিপি টাইপ করার জন্যে এক অস্ট্রিয়ান মহিলা এমিলি শেংকেল তাকে সাহায্য করেন, যিনি পরবর্তীকালে তার সচিবও হন। এই এমিলি শেংকেলের সঙ্গেই পরবর্তীকালে তার প্রণয় ও পরিণয়। তাদের এক কন্যাসন্তান অনিতা বসু পাফ। এমিলি শেংকেল কখনো ভারতে আসেননি, কিন্তু বৃহত্তর বসু পরিবার ও নেতাজির সহযোগীদের সঙ্গে তাঁর চিরকাল যোগাযোগ ও সুসম্পর্ক ছিল । ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রয়াত হন। অনিতা বসু পাফ তার পিতার দেশ ভারতে বহুবার এসেছেন। তিনি পেশায় অর্থনীতিবিদ, তার স্বামী মার্টিন পাফ জার্মান পার্লামেন্টের প্রাক্তন সদস্য। তাদের দুই পুত্র ও এক কন্যা।

সুভাষচন্দ্র বসুর সবচেয়ে বিখ্যাত উক্তি হল, তুম মুঝে খুন দো, ম্যায় তুমহে আজাদি দুঙ্গা। ১৯৪৪ সালের ৪ জুলাই বার্মায় এক র‌্যালিতে তিনি এই উক্তি করেন। তার আর একটি বিখ্যাত উক্তি-'জয় হিন্দ'।

নেতাজির অন্তর্ধান আজো রহস্যাবৃত। ভারতের স্বাধীনতার এতগুলো দশক পরেও তার মৃত্যু নিয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে আসা যায়নি। পঞ্চাশের দশকে শাহনওয়াজ কমিশন জানিয়েছিল ১৯৪৫ সালে তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনাতেই নেতাজির মৃত্যু হয়েছে। সেই প্রতিবেদন সরকার মেনে নিয়েছিল। তারপরে আবার যাটের দশকে নতুন করে তদন্তে খোসলা কমিশন গঠন করায় নেতাজির মৃত্যু ফের সন্দেহতে গড়ায়।

অন্যদিকে বিচারপতি মনোজ মুখার্জীর নেতৃত্বাধীন কমিশন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঘুরে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করেছিল। তাইহোকু বিমানবন্দরের সব নথি খতিয়ে দেখে তারা মতামত দেয় যে ১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট সেখানে কোনও বিমান দুর্ঘটনাই ঘটেনি। এই তদন্ত রিপোর্ট বাতিল করে দেয় সরকার। (বিবিসি) ।

নেতাজি সাংগঠনিক কাজে কয়েকবার বাংলাদেশে এসেছিলেন। আর এর সূত্র ছিল নেতাজির একান্ত সহযোগী নারায়ণগঞ্জের কৃতিসন্তান শান্তিময় গাঙ্গুলী। শান্তিময় ছিলেন শীতলক্ষার তামাকপট্টি মহল্লার বিমলা মোহন গাঙ্গুলীর ছেলে। সেকালে শান্তিময় নারায়ণগঞ্জ হাইস্কুলের বিশিষ্ট ছাত্রনেতা হিসেবে ব্যাপক পরিচিত ছিলেন।

নারায়ণগঞ্জে নেতাজির প্রথমবার আগমন ঘটে ১৯২৮ সালের ২১ জানুয়ারি একটি সমাবেশে যোগদান উপলক্ষে। দ্বিতীয়বার এসেছিলেন ১৯৩১ সালের ৭ নভেম্বর। সেবার তিনি স্টিমারযোগে নারায়ণগঞ্জে পৌঁছেছিলেন। তখন হাজার হাজার কংগ্রেস কর্মী তাকে সাদর সংবর্ধনা জানাতে স্টিমার ঘাটে জমায়েত হয়। স্টিমারে বসেই তিনি শুনলেন যে, সরকার তার জন্য ঢাকা জেলায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে। সেদিন পুলিশ নেতাজিকে আটক করে নারায়ণগঞ্জ থানায় নিয়ে যায়। কয়েক ঘণ্টা রেখে পরে চাঁদপুর পাঠিয়ে দেয়। সেখান থেকে নেতাজি কুমিল্লা হয়ে ঢাকায় যান। পুনরায় তিনি ঢাকায় গ্রেফতার হন। এরপর অবশ্য তিনি কোর্টের মাধ্যমে জামিন লাভ করেছিলেন।

সংবাদটি ৮ নভেম্বর কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। সংবাদটি ছিল- ‘নারায়ণগঞ্জ, ৭ নভেম্বর। শ্রীযুক্ত সুভাষ চন্দ্র বসুকে নারায়ণগঞ্জে গ্রেফতার করা হইয়াছে। জে.সি গুপ্ত ও তদন্ত কমিটির অন্যান্য সভ্যগণ ঢাকা রওনা হইয়াছেন। অদ্য অপরাহ্নকালে কলকাতা স্টিমার নারায়ণগঞ্জে পৌঁছিলে ফৌজদারী কার্যবিধির ১৪৪ ধারা অনুসারে শ্রীযুক্ত সুভাষ বসুকে ঢাকা জেলার মধ্যে প্রবেশ করিতে নিষেধ করিয়া একটি নোটিশ জারি করা হয়---"

নেতাজি ১৯৩৯ সালের জানুয়ারি মাসে কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। সভাপতি নির্বাচিত হওয়ায় নারায়ণগঞ্জ কংগ্রেস কমিটির পক্ষ থেকে সংবর্ধনা উপলক্ষ্যে তৃতীয়বার তিনি ১৯৩৯ সালেই এখানে এসেছিলেন। বর্তমান টানবাজার পার্কটি ছিল তখন খোলা ময়দান। সে ময়দানে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হয়। কংগ্রেস কমিটির পক্ষ থেকে সেদিন তাকে বিপুলভাবে সংবর্ধিত করা হয়েছিল। সুসজ্জিত একটি টমটমে উঠিয়ে তাঁকে সমগ্র শহর প্রদক্ষিণ করানো হয়। টমটমের পিছনে ছিল বিরাট মিছিল। হাজার হাজার লোক সে মিছিলে শরিক হয়েছিল।

শেষবার তিনি ১৯৪০ সালের এপ্রিল মাসে নারায়ণগঞ্জ এসেছিলেন। নারায়ণগঞ্জ হাইস্কুল মাঠে এক জনসভায় ভাষণ দিয়েছিলেন। সেদিন নারায়ণগঞ্জের কংগ্রেস নেতা পৌর কমিশনার উকিল বিনয়কৃষ্ণ রায়ের বাসায় রাত্রিযাপন করে পরের দিন ঢাকেশ্বরী মিল স্কুল উদ্বোধন শেষে ঢাকা চলে যান এবং সেখানের করনেশন পার্কে একটি জনসভায় ভাষণ দিয়েছিলেন।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ জানুয়ারি ২০১৯/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়