লালচে কাঠঠোকরার লুকোচুরি
শামীম আলী চৌধুরী || রাইজিংবিডি.কম

বার্ড ফটোগ্রাফির শুরুর দিকের ঘটনা। তখন পর্যন্ত পরিযায়ী পাখির সংগ্রহ তেমন ছিল না। শখের বসে ছবি তোলার নেশা সেই সময় থেকেই পেয়ে বসেছিল। ঢাকার ভেতরেই অবসর সময়ে পাখির খোঁজে ঘুরে বেড়াতাম। বিশেষ করে ছুটির দিনগুলোতে কখনো বোটানিক্যাল গার্ডেন বা কখনো শেরে-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বা রমনা পার্ক ছাড়া দেশের অন্য কোথাও যাওয়া হতো না।
সময়টা ছিল ২০১০ সালের এপ্রিল মাস। শুক্রবার। ভোরবেলা কাঠবিড়ালির ছবি তোলার জন্য রমনা পার্কে গেলাম। মুড়ি বা বিস্কুট ছিটিয়ে দিলেই কাঠবিড়ালি গাছ থেকে নেমে মাটিতে ঘাসের উপর চলে আসতো। খুব মজা করে কাঠবিড়ালির ছবি তুলতাম। সেদিনও কাঠবিড়ালির ছবি তুলছিলাম। এমন সময় মাথার উপর নাম না জানা একটি গাছের ডালে পাখিটি উড়ে এসে বসলো। আমার সঙ্গে ছিল ভাগিনা শহিদুল আলম তিতু ও তার পরিবার। তিতুর ছেলে বলল, আপনার মাথার উপরের গাছের ডালে একটি পাখি বসেছে। আমি কিছুটা পিছিয়ে গাছের দিকে নজর দিলাম। দেখলাম, সুন্দর লালচে রঙের একটি পাখি বসে আছে। কাঠবিড়ালির ছবি তোলা বন্ধ রেখে পাখিটির ছবি তোলার জন্য ব্যস্ত হলাম।
কিন্তু মুহূর্তেই পাখিটি উড়ে চলে গেল। ছবি আর তোলা হলো না। পরদিন কর্মস্থলে না গিয়ে আবারও রমনা পার্কে গেলাম। যেখানে পাখিটির দেখা পেয়েছিলাম সেখানে বসে রইলাম। কিন্তু পাখিটির দেখা পেলাম না। মন খারাপ করে রমনা পার্কে হাঁটছি। আর পাখির খোঁজে গাছে গাছে চোখ রাখছি। হোটেল শেরাটনের কোণায় এসে দেখলাম একটি গাছের ডালে সেই লালচে পাখিটি বসে আছে। ছবি তোলার জন্য উত্তেজনা বেড়ে গেল। নিজেকে সামলে নিয়ে ক্যামেরা তাক করে পাখিটির বেশ কয়েকটি ছবি তুললাম। ছবি তোলার পর মনের ভেতর আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। দীর্ঘ আট বছর পর ২০১৮ সালে আবারো সাতছড়িতে পাখিটির ছবি তুললাম। এতক্ষণ লালচে কাঠঠোকরা পাখির কথা বলছিলাম।
লালচে কাঠঠোকরা Picidae পরিবারের অন্তর্গত পাখি। এদের দেহের পালক লালচে-খয়েরি, তার ওপর রয়েছে কালচে ডোরা। কাঁধ-ঢাকনি, ডানা লেজ ও বগলে আড়াআড়ি ডোরা রয়েছে। গলার পালক আঁইশের মতো দেখায়। পিঠ ও পেটে হালকা কালচে টান, ছিট ও ছোপ রয়েছে। চোখের রঙ বাদামি লাল। চোখের নিচে অর্ধচন্দ্রাকৃতির উজ্জ্বল লাল পট্টি আছে। ঠোঁট ও নখ কালো। পা ও পায়ের পাতা নীলচে-সবুজ। স্ত্রী পাখিটি আকারে কিছুটা ছোট এবং কান-ঢাকনি হালকা পীত রংয়ের। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির বুক ও তলপেটে স্পষ্ট আড়াআড়ি ডোরা ও অর্ধচন্দ্রাকৃতি দাগ থাকে।
লালচে কাঠঠোকরা আদ্র পাতাঝরা বন, চিরসবুজ বনসহ বন-বাগান, এমনকি লোকালয়েও বাস করে। এরা একাকী বা জোড়ায় ঘুরে বেড়ায়। ছোট পোকামাকড়, পিঁপড়া, লার্ভা, উইপোকা, বুনো ডুমুর ও ডুমুরের রস এদের প্রিয় খাবার। এরা চমৎকার ভঙ্গিমায় গাছে ঝুলে থেকে পিঁপড়া ও পোকামাকড়ের বাসায় ঠোঁট দিয়ে খুটিয়ে খাবার বের করে নিয়ে আসে। টসটসে উইপোকা খাওয়ার জন্য ঢিবিতে আক্রমণ চালাতেও পিছপা হয় না। এপ্রিল-মে এদের প্রজননকাল। এ সময় গাছের গর্তে বাসা বানায়। কখনো কখনো গেছো পিঁপড়ার বাসার ভেতরে বা ওপরেও বাসা করতে পারে। ডিম পাড়ে ২-৩টি। ডিমের রঙ সাদা। ১৪-১৮ দিন তা দেওয়ার পর ডিম থেকে ছানা বের হয়। ছানারা প্রায় ২৫-২৭ দিনে উড়তে পারে। লালচে কাঠঠোকরা প্রায় পাঁচ বছর বাঁচে।
এই পাখি আইইউসিএন-এর লাল তালিকার ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত প্রজাতি। এরা বাংলাদেশের আবাসিক পাখি। বাংলাদেশ ছাড়াও দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে পাখিটির বিস্তৃতি রয়েছে। বাংলাদেশের বণ্যপ্রাণী আইনে এরা সংরক্ষিত।
বাংলা নাম: লালচে কাঠঠোকরা
ইংরেজি নাম: Rofous Woodpeckeer
বৈজ্ঞানিক নাম: celeus brachyurua
লেখক ছবিটি ঢাকার রমনা পার্ক থেকে তুলেছেন।
হাসনাত/তারা
- ৭ মাস আগে বন্য হাতির ধাওয়া খেয়ে পেলাম বুনো টুনির দেখা
- ৮ মাস আগে পাখির নাম ‘রঙিলা দোয়েল’
- ৮ মাস আগে বাচ্চা হারিয়ে মা দুধরাজ পাখির হাহাকার
- ৮ মাস আগে পুকুর পাড়ে পেলাম ‘কালোবুক দামা’র দেখা
- ৮ মাস আগে যেভাবে খুঁজে পেলাম ‘কালো বাজ’ পাখি
- ৯ মাস আগে অনেক অপেক্ষার পর দেখা পেলাম নীল ফক্কির
- ৯ মাস আগে সীমানা নির্ধারণ করে বাস করে জল মোরগ
- ৯ মাস আগে হঠাৎ দেখি সুরেলা কণ্ঠের সাদা লেজ রবিন!
- ৯ মাস আগে প্রজননকালে গান গায় ‘লালডানা কোকিল’
- ৯ মাস আগে উড়ন্ত পোকা ধরায় পটু নীলগলা চুটকি
- ১১ মাস আগে ডুপ্লেক্স বাসা বানায় ছোট নীলচটক পাখি
- ১১ মাস আগে মহাবিপন্ন পাখি ‘বন বাচকো’
- ২ বছর আগে ‘নীল শিসদামা’র কণ্ঠে বাঁশির সুর
- ২ বছর আগে গৃহপালিত হাঁসের পূর্বপুরুষ নীলশির হাঁস
- ২ বছর আগে বিপদ দেখলেই শুয়ে পড়ে শাবাজ ট্রিটি
- ২ বছর আগে টুপি মাথায় ‘মৌলবি হাঁস’
- ২ বছর আগে সুরের পাখি সিঁদুরে-হলুদ মৌটুসী
- ২ বছর আগে দেখতে সবুজ বাঁশ ঘুঘু
- ২ বছর আগে বাইক্কা বিলের জলময়ূর
- ২ বছর আগে নগরে পাকড়া খঞ্জন
- ২ বছর আগে পাখির নাম হট্টিমা
- ২ বছর আগে প্রথম দেখাতেই পাপিয়ার প্রেমে পড়েছিলাম
- ২ বছর আগে অনেক কষ্টে পেলাম সাদা-কোমর মুনিয়ার দেখা
- ২ বছর আগে হঠাৎ পেলাম নীলপরির দেখা
আরো পড়ুন