ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

বাচ্চা হারিয়ে মা দুধরাজ পাখির হাহাকার

শামীম আলী চৌধুরী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:৪৩, ৩ জুলাই ২০২১   আপডেট: ২০:০১, ৩১ জুলাই ২০২১
বাচ্চা হারিয়ে মা দুধরাজ পাখির হাহাকার

হাঁড়িচাচা বাচ্চা নিয়ে গেলে মা দুধরাজ পাখির হাহাকার

চোখে সুন্দর লাগলেই আমরা ‘সুন্দর’ বলি। কিন্তু সেই সুন্দরের অন্তঃপ্রাণে যে কোনো বেদনা থাকতে পারে, বেশির ভাগ সময়ই আমাদের চোখে পড়ে না। মানুষ যেমন মানুষের শক্র হয়, একইভাবে অন্যান্য জীব-জানোয়ার বা পাখির শত্রুও স্বগোত্রিয়রা। আজ বলবো দৃষ্টিনন্দন দুধরাজ পাখির সংগ্রামী জীবন নিয়ে।

অনেক দিন আগের কথা, পাখিটির ছবি দেখার পর পাখি বিশেষজ্ঞ এবং অভিজ্ঞ বার্ড ফটোগ্রাফার বন্ধুরা মন্তব্য করেন- ওয়াও, দারুণ, আউটস্ট্যান্ডিং, চমৎকার, ফ্রেমটা আরো সুন্দর হতে পারতো ইত্যাদি। যে কারো গঠনমূলক মন্তব্য কাজের প্রতি আমাকে আরো বেশি মনোযোগী হতে প্রেরণা দেয়। আগ্রহ বাড়িয়ে তোলে দেখানো ভুলগুলো শোধরানোর জন্য। যা হোক এবার আসি মূল বিষয়ে।

২০১৬ সালে প্রথম এই পাখির দেখা মেলে। তারপর থেকেই পাখিটি নিয়ে জানার আগ্রহ বেড়ে যায়। পাখিটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য লেখাপড়া শুরু করি। বিভিন্ন গবেষকের লেখা থেকে জানলাম এদের জীবনচক্র। অবাক হলাম এই ভেবে যে, প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে এরা বেঁচে আছে। এরপরই  পাখিটিকে নিয়ে কাজ করার আগ্রহ বেড়ে যায়।

২০১৭ সালে পাখিটি নিয়ে কাজ শুরু করি। এদের বাসা বানানো, খাবার, চারিত্রিক বৈশিষ্ট, প্রজনন কাল, প্রজনন শেষে অবস্থান, ডিমে তা’ দেয়ার পদ্ধতি, ছানাদের পরিচর্যা এবং প্রকৃতির বিরূপ আচরণ থেকে নিজেদের রক্ষা করার কৌশল সবই জানা হলো। অবাক হলাম এই ভেবে যে, আমাদের সৃষ্টিকর্তা ভালোই জানেন তার সৃষ্টিকে কীভাবে তিনি রক্ষা করবেন।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেনে প্রথম বছর কাজ করলাম। পরের বছর আবার সেখানে কাজ করি। তার সঙ্গে যোগ হলো রাজশাহীর বায়া। দুই জায়গায় পাখিটির মোট ১৬টি বাসার সন্ধান পাই। ১৬টি বাসায় গড়ে ৩টি করে ছানা জন্ম নিলে মোট ৪৮টি ছানা প্রকৃতিতে বসবাসের ঠিকানা পায়। অথচ মাত্র দুটি বাসা থেকে মোট ৮টি ছানার প্রকৃতিতে বসবাসের ভাগ্য হয়। একটি ময়মনসিংহে অপরটি রাজশাহীর বায়ায়।

২০১৮ সালের মে মাসের ২৭ তারিখে দুধরাজ নিয়ে কাজ করার জন্য বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পুনরায় যাই। যে জায়গায় পাখির বাসা, সেখানে পৌঁছার আগে একটি হাঁড়িচাচা পাখির দেখা পেলাম। জানা ছিল যে, হাঁড়িচাচা পাখি দুধরাজের ছানার জন্য হুমকি। এই পাখিটি দুধরাজের বাসায় হানা দিয়ে বাচ্চা চুরি করে নিয়ে যায়। তাই হাঁড়িচাচা পাখিটিকে ঢিল দিয়ে তাড়িয়ে দেই। মাত্র ৫ দিনের ব্যবধানে বাসায় একটি ছানার দেখা পেলাম। এই দৃশ্য দেখে চমকে উঠলাম! সন্দেহের তীর হাঁড়িচাচার উপর। 

হঠাৎ নজর পড়লো বাবা দুধরাজের উপর। অন্য একটি গাছের ডালে তিনটি ছানাকে বেঁচে থাকার কৌশল শেখাচ্ছে। বাবা দুধরাজ ছানাদের সঙ্গে নিয়েও উড়ছে। দেখার পর আনন্দে মনটা ভরে গেল। আমি ছানাদের ছবি তুলছিলাম। এমন সময় মা দুধরাজের কর্কশ চেঁচামেচির আওয়াজ শুনতে পেলাম। সঙ্গে সঙ্গে বাবা দুধরাজও উড়ে এলো। ব্যাপারটা বোঝার আগেই দেখলাম হাঁড়িচাচা বাসায় থাকা ছানাটিকে মুখে নিয়ে উড়ে গেল। মা-বাবার আর্তনাদ এবং চিৎকারে গোটা এলাকায় একটি হৃদয়-বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হলো। আমিও নির্বাক হয়ে মা-বাবার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। ওদের সন্তান হারানোর কষ্ট সহ্য করতে না-পেরে ছবি তোলার কথাও ভুলে গেলাম। মন এতোটাই খারাপ হলো রাতেই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
 

হাসনাত/তারা

ঘটনাপ্রবাহ

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়