অনেক অপেক্ষার পর দেখা পেলাম নীল ফক্কির
শামীম আলী চৌধুরী || রাইজিংবিডি.কম

লেখক ছবি সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান থেকে তুলেছেন
পাঁচ বছর অপেক্ষার পর অপ্রত্যাশিত কোনো পাওয়ার আনন্দ বর্ণনা করা কঠিন। বার্ড ফটোগ্রাফির শুরু থেকে অনেক পাখির নাম শুনেছি। আর মনের ভেতর অদেখা পাখির প্রতি দুর্বলতা জাগবে এটাই স্বাভাবিক। সব পাখিই যে একই এলাকায় বা অঞ্চলে দেখা যাবে তা নয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন প্রজাতি পাখির আবাসস্থল। বিষয়টি নির্ভর করে পাখির জীবন যাপনের প্রয়োজনীয় পরিবেশের উপর। তার উপর ভিত্তি করে ফটোগ্রাফররা ছুটে বেড়ান দেশের একপ্রাপ্ত থেকে অপর প্রান্তে।
প্রতিটি ছবির পেছনে একটি গল্প থাকে। আজ যে পাখিটির কথা বলবো সেই পাখির ছবি তোলার পেছনেও একটি গল্প আছে। কারণ গত পাঁচ বছর এ জন্য অপেক্ষা করছিলাম। অবশেষে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে পাখিটির দেখা পাই।
২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে বণ্যপ্রাণী গবেষক ও আলোকচিত্রী আদনান আজাদ আসিফের সঙ্গে সাতছড়ি যাওয়ার পথে গাড়িতে বসে পাখিটি নিয়ে আলোচনা হয়। আদনানের কাছে পাখিটির চরিত্র ও বর্ণনা শোনার পর মুগ্ধ হলাম। তারপর থেকেই চলতে থাকে আমার অনুসন্ধান। সেবার ওই পাখির জন্যই সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে চষে বেড়াই। গহীন বনের ভেতর সারাদিন খোঁজার পরও শূন্য হাতে ঢাকা ফিরতে হয়েছিল।
তবে পরের বছরই সাতছড়ি বনে পাখিটির প্রথম দেখা মেলে। এবার দেখলাম ঠিকই কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও ছবি তুলতে পারিনি। এরপর যতবারই সাতছড়ি যাওয়া হয়েছে পাখিটির দেখা আর পাইনি। চলতি বছরও পাখিটির অপেক্ষায় ছিলাম। প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম সাতছড়ি যাওয়ার জন্য। কিন্ত করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সবকিছু ওলট-পালট করে দেয়। সব পরিকল্পনা স্থবির হয়ে পড়ে। ফলে ভেবেছিলাম এ বারও বোধহয় দেখা হবে না। কারণ এরা গ্রীষ্মকালীন পরিযায়ী পাখি। এপ্রিল মাসের শেষের দিকে আমাদের দেশে দেখা যায়। এরা এখানে জুন মাস পর্যন্ত অবস্থান করে। একমাত্র এই প্রজাতির পরিযায়ী পাখি আমাদের দেশে প্রজনন করে। ছানা বড় করে নিজ দেশে ফিরে যায়।
এর মাঝে হঠাৎ একদিন সাতছড়ির হারিস মামা ও রাসেল দেববর্মনের ফোনে আশার আলো দেখতে পাই। তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ চলতে থাকে। তারা পরপর তিনদিন পাখিটি সাতছড়ির যে অঞ্চলে অবস্থান করছিল তার অবস্থান ও গতিবিধি লক্ষ্য রাখে ও ছবি তুলে পাঠায়। তাদের কাছ থেকে সবুজ সংকেত পাওয়ার পর আমার ফটোগ্রাফির সঙ্গী কিসমত খোন্দকারকে সঙ্গে নিয়ে পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই চলে যাই সাতছড়ি।
সকালে সূর্যের আলো ফুটে ওঠার আগেই আমরা দুভাগ হয়ে বনের গভীরে ঢুকে পড়ি। প্রচণ্ড গরম অনেকটা দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছি। হঠাৎ অগ্রবর্তী দলের রাসেলের কাছ থেকে বিশেষ ধরনের সিগন্যাল শুনে হারিস মামা বলে ওঠেন পাওয়া গেছে, অপেক্ষা করেন, আবার আসবে। ৩০ মিনিটের মতো অপেক্ষার পর তার দেখা পেলাম। অনেক কষ্ট করে পাখিটির কয়েকটি ছবি তুললাম। কারণ তখন আলো ভালো পাচ্ছিলাম না। এই পাখিটি যোগ হওয়ায় আমার পাখি সংগ্রহের সংখ্যা ৪৫০-এ দাঁড়ালো।
এতক্ষণ যে পাখিটি নিয়ে কথা বললাম সেটি অনেকগুলো নামে পরিচিত- সবুজ-হৃদয় বনসুন্দরী, সবুজাভ সুমচা, নীলফক্কি, হালতি প্রভৃতি। অঞ্চল ভেদে বিভিন্ন নামে পরিচিত। বাগেরহাট অঞ্চলে এদের নাম ছোট হালতি।
দৃষ্টিনন্দন এই পাখি ১৯ সে.মি. দৈর্ঘ্য ও ৬৫ গ্রাম ওজনের এক প্রজাতির ছোট বনচর পাখি। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির কালচে ডানা ও কাঁধ নীলপট্টি। ডানার বাইরের কালচে অংশে সাদা পট্টি থাকে। বুক বগল ও পালক উজ্জ্বল সবুজ-নীল বর্ণের। লেজতল উজ্জ্বল লাল। মাথার চাঁদি তামা রঙের। মাথাসহ ঘাড়ের পেছন অংশ কালো। চোখ কালচে-বাদামী। ঠোঁট কালো। পা ও পায়ের পাতা কালচে। ছেলে ও মেয়েপাখির চেহারা অভিন্ন।
সবুজাভ সুমচা চিরসুবজ বন, আদ্র ঝরাপাতা বন ও ঘন ঝোপ-জঙ্গলে বিচরণ করে। সচারচর একা বা জোড়ায় থাকে। পরিযায়নের সময় দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ভেজা বা আদ্র বনতলে ঝরাপাতা উল্টিয়ে এরা খাদ্য খুঁজে বেড়ায়। খাদ্যতালিকায় রয়েছে নানা জাতের কীট। খাবারের সন্ধানে এরা মাটিতে নামে। অন্য সময় গাছের ডালেই থাকে। মেয়েপাখির দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ছেলেপাখিদের ডাকের প্রতিযোগিতা হয়। আর সেই সময় পাখিটি সহজেই নজরে পড়ে।
এপ্রিল থেকে আগস্ট এদের প্রজননকাল। এই পাখির বাসা বানানোর পদ্ধতি বনসুন্দরীর মতো নয়। বনসুন্দরী শাল বা গজারী গাছের উঁচুতে কাঠি ও সরু ডাল দিয়ে বাসায় বানায়। অথচ এরা ঝোপের নিচে বা বাঁশ ঝাড়ের গোড়ায় মাটিতে ঘাস ও পাতা দিয়ে আলগা বলের মতো বাসা বানায়। নিজেদের বানানো বাসায় মেয়েপাখিটি ৪-৫টি ডিম পাড়ে। উভয়ে ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা ফোঁটায়। বাবা-মা দুজনেই সংসারের কাজ করে।
ইংরেজি নাম: Green-breasted Pitta/Hooded Pitaa.
বৈজ্ঞানিক নাম: Pitta sordida (Müller, 1776)
হাসনাত/তারা
- ৭ মাস আগে বন্য হাতির ধাওয়া খেয়ে পেলাম বুনো টুনির দেখা
- ৮ মাস আগে পাখির নাম ‘রঙিলা দোয়েল’
- ৮ মাস আগে বাচ্চা হারিয়ে মা দুধরাজ পাখির হাহাকার
- ৮ মাস আগে পুকুর পাড়ে পেলাম ‘কালোবুক দামা’র দেখা
- ৯ মাস আগে যেভাবে খুঁজে পেলাম ‘কালো বাজ’ পাখি
- ৯ মাস আগে সীমানা নির্ধারণ করে বাস করে জল মোরগ
- ৯ মাস আগে হঠাৎ দেখি সুরেলা কণ্ঠের সাদা লেজ রবিন!
- ৯ মাস আগে প্রজননকালে গান গায় ‘লালডানা কোকিল’
- ৯ মাস আগে উড়ন্ত পোকা ধরায় পটু নীলগলা চুটকি
- ১১ মাস আগে ডুপ্লেক্স বাসা বানায় ছোট নীলচটক পাখি
- ১ বছর আগে মহাবিপন্ন পাখি ‘বন বাচকো’
- ২ বছর আগে ‘নীল শিসদামা’র কণ্ঠে বাঁশির সুর
- ২ বছর আগে গৃহপালিত হাঁসের পূর্বপুরুষ নীলশির হাঁস
- ২ বছর আগে বিপদ দেখলেই শুয়ে পড়ে শাবাজ ট্রিটি
- ২ বছর আগে টুপি মাথায় ‘মৌলবি হাঁস’
- ২ বছর আগে সুরের পাখি সিঁদুরে-হলুদ মৌটুসী
- ২ বছর আগে দেখতে সবুজ বাঁশ ঘুঘু
- ২ বছর আগে বাইক্কা বিলের জলময়ূর
- ২ বছর আগে নগরে পাকড়া খঞ্জন
- ২ বছর আগে পাখির নাম হট্টিমা
- ২ বছর আগে লালচে কাঠঠোকরার লুকোচুরি
- ২ বছর আগে প্রথম দেখাতেই পাপিয়ার প্রেমে পড়েছিলাম
- ২ বছর আগে অনেক কষ্টে পেলাম সাদা-কোমর মুনিয়ার দেখা
- ২ বছর আগে হঠাৎ পেলাম নীলপরির দেখা
আরো পড়ুন