বাইক্কা বিলের জলময়ূর
শামীম আলী চৌধুরী || রাইজিংবিডি.কম

লেখক ছবিটি শ্রীমঙ্গলের বাইক্কা বিল থেকে তুলেছেন
যাচ্ছিলাম শ্রীমঙ্গলের বাইক্কা বিলে। সময়টা ছিল জানুয়ারি মাসের কোনো একদিন। সঙ্গে ছিলেন বন্যপ্রাণী গবেষক ও ওয়াইল্ড ফটোগ্রাফার আদনান আজাদ আসিফ। তার সঙ্গে থাকার উদ্দেশ্য হলো, পাখি এবং বন্যপ্রাণী বিষয়ে নানা তথ্য আদান-প্রদান। এখানে অবশ্য তথ্যপ্রদান শব্দটা যুক্তিযুক্ত নয়। কারণ আদনানকে বন্যপ্রাণী সম্পর্কে তথ্য দেওয়ার মতো জ্ঞান আমার ভাণ্ডারে নেই। বরং তার ভাণ্ডার থেকেই আমি সমৃদ্ধ হই। প্রতিটি ভ্রমণেই এই ভাণ্ডার বাড়ে। এবারও তার অন্যথা হয়নি। পথজুড়ে পাখি নিয়েই আলোচনা হলো আদনানের সঙ্গে। বুঝতে পারলাম পাখির গড়ন, রং, আকার-আকৃতি এবং স্বভাব-চরিত্রের দিকটা খেয়াল রেখেই পাখির নামকরণ করা হয়।
ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে খুব ভোরে বাইক্কা বিলে পৌঁছালাম। তখনও বিলজুড়ে ঘন কুয়াশায় রাজত্ব চলছে। আমরা বিলের পরিচর্যাকারীদের সঙ্গে বসে গল্প করছিলাম। এমন সময় একিট পাখি আমাদের সামনে দিয়ে উড়ে গেল। আমি আদনানকে বললাম, এই পাখির নামের সঙ্গে দেহের গড়নের মিল নেই কেন? উত্তরে সে বলল, প্রজননকালে পাখিটিকে দেখলে বুঝতে পারবেন নামের সঙ্গে দেহের গড়নের কতটা মিল! যদি পাখিটির সৌন্দর্য ও দেহের পূর্ণাঙ্গ গড়ন দেখতে হয় তবে আপনাকে মে-জুন মাসে আসতে হবে।
আমি সেই বছরই মে মাসে পুনরায় বাইক্কা বিলে গিয়েছিলাম। পাখিটিকে দেখে দীর্ঘ সময় অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম! আর আদনানের কথার সঙ্গে মিল খুঁজে পেলাম। তার কথা হলো পাখিটির লেজ যদি লম্বা না-ই হয়, তবে নামের কোনো স্বার্থকতা নেই।
এতক্ষণ কথা বলছিলাম জলময়ূর বা নেউ-পিপি নিয়ে। পাখিটিকে দেখার পর বুঝতে পারলাম সত্যিই লেজ ছাড়া পাখিটির সৌন্দর্য পুরোটা ফুটে ওঠে না। সেদিন মনের মাধুরী মিশিয়ে জলময়ূরের ছবি তুলেছিলাম।
জলময়ূর Jacanidae পরিবারের অন্তর্গত আকারে ৩৯ থেকে ৫৮ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যের পাখি। পুরুষ পাখির ওজন ১১৩ থেকে ১৩৫ গ্রাম। স্ত্রী পাখির ওজন ২০৫ থেকে ২৬০ গ্রাম। প্রজননকালে জলময়ূর অত্যন্ত সুন্দর হয় দেখতে। তখন এই পাখির মাথা, গলা ও ডানার পালক সাদা থাকে। ঘাড় সোনালি-হলুদ, পিঠ গাঢ় বাদামি, বুক-পেট কালচে বাদামি ও লেজ কালো হয়। একটি কালচে-খয়েরি রেখা মাথা ও ঘাড়-গলার সাদা ও সোনালি-হলুদ রঙের মধ্যে বিভেদ রেখা টেনে দেয়। ঠোঁট নীলচে হয়। চোখ বাদামি ও পা নীলাভ-কালো। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। প্রজননকাল ছাড়া এদের পিঠের দিক হয় ফিকে বাদামি হয়। চোখ ও ঠোঁট হলুদ ও পায়ের পাতা সবুজাভ। তখন লেজ দেহ থেকে খসে যায়। পাখিটির আকার ছোট দেখায়।
জলময়ূর হাওর, বিল, হ্রদ এবং মিঠাপানির জলাভূমিতে বাস করে। দেশের প্রায় সব বিভাগেই দেখা যায়। গ্রীষ্মকালে একা বা জোড়ায় ও শীতকালে ঝাঁক বেঁধে বিচরণ করে। ভাসমান পাতার ওপর হেঁটে জলজ উদ্ভিদ থেকে খাবার খুঁজে খায়। এদের খাদ্য তালিকায় পোকা-মাকড় ও অমেরুদণ্ডী প্রাণী, জলজ উদ্ভিদের কঁচি পাতা, অঙ্কুর ও বীজ রয়েছে। এরা ওড়ার সময় নে-উ-ইউ শব্দে ডাকে। মে থেকে সেপ্টেম্বর মাস এদের প্রজননকাল। সবচেয়ে অবাক কাণ্ড হলো অন্যান্য পাখির মতো মেয়ে পাখি বাসা বানায় না। প্রজননকালে পুরুষ পাখি শাপলা ও পদ্মপাতা বা এ জাতীয় ভাসমান কোনো উদ্ভিদের পাতার ওপর একাই বাসা বানায়। স্ত্রী পাখি এতে চারটি জলপাই-বাদামি চকচকে ডিম পেড়ে চলে যায়। মেয়ে পাখিটি তখন অন্য কোনো পুরুষ পাখির সঙ্গে জোড়া বেঁধে আবারও ডিম পাড়ে। পুরুষ একাই ২৩ থেকে ২৬দিন ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা ফোটায়। ডিম থেকে বাচ্চা ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই ছানাগুলো হাঁটতে, সাঁতরাতে বা পানিতে ডুব দিতে পারে। প্রায় দুই মাস পর্যন্ত বাবার তত্ত্বাবধানে থাকে তারা। একমাত্র বাবা জলময়ূর ছানাগুলোকে আগলে রেখে পরিচর্যা করে ও পাহারা দিয়ে রাখে।
জলময়ূর বাংলাদেশের সুলভ আবাসিক পাখি। দেশের সব বিল ও হাওড়ে দেখা যায়। এ ছাড়াও পাকিস্তান, ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, চীনসহ দক্ষিণ পূর্ব ও পূর্ব এশিয়ায় এদের বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে। এরা বিপদমুক্ত পাখি বলে বিবেচিত। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এরা সংরক্ষিত।
বাংলা নাম: জলময়ূর, নেউ পিপি, পদ্মপিপি বা নেওয়া
ইংরেজি নাম: Pheasant-tailed Jacana
বৈজ্ঞানিক নাম: Hydrophasianus chirurgus (Scopoli, 1786)
হাসনাত/তারা
- ৭ মাস আগে বন্য হাতির ধাওয়া খেয়ে পেলাম বুনো টুনির দেখা
- ৮ মাস আগে পাখির নাম ‘রঙিলা দোয়েল’
- ৮ মাস আগে বাচ্চা হারিয়ে মা দুধরাজ পাখির হাহাকার
- ৮ মাস আগে পুকুর পাড়ে পেলাম ‘কালোবুক দামা’র দেখা
- ৮ মাস আগে যেভাবে খুঁজে পেলাম ‘কালো বাজ’ পাখি
- ৯ মাস আগে অনেক অপেক্ষার পর দেখা পেলাম নীল ফক্কির
- ৯ মাস আগে সীমানা নির্ধারণ করে বাস করে জল মোরগ
- ৯ মাস আগে হঠাৎ দেখি সুরেলা কণ্ঠের সাদা লেজ রবিন!
- ৯ মাস আগে প্রজননকালে গান গায় ‘লালডানা কোকিল’
- ৯ মাস আগে উড়ন্ত পোকা ধরায় পটু নীলগলা চুটকি
- ১১ মাস আগে ডুপ্লেক্স বাসা বানায় ছোট নীলচটক পাখি
- ১১ মাস আগে মহাবিপন্ন পাখি ‘বন বাচকো’
- ২ বছর আগে ‘নীল শিসদামা’র কণ্ঠে বাঁশির সুর
- ২ বছর আগে গৃহপালিত হাঁসের পূর্বপুরুষ নীলশির হাঁস
- ২ বছর আগে বিপদ দেখলেই শুয়ে পড়ে শাবাজ ট্রিটি
- ২ বছর আগে টুপি মাথায় ‘মৌলবি হাঁস’
- ২ বছর আগে সুরের পাখি সিঁদুরে-হলুদ মৌটুসী
- ২ বছর আগে দেখতে সবুজ বাঁশ ঘুঘু
- ২ বছর আগে নগরে পাকড়া খঞ্জন
- ২ বছর আগে পাখির নাম হট্টিমা
- ২ বছর আগে লালচে কাঠঠোকরার লুকোচুরি
- ২ বছর আগে প্রথম দেখাতেই পাপিয়ার প্রেমে পড়েছিলাম
- ২ বছর আগে অনেক কষ্টে পেলাম সাদা-কোমর মুনিয়ার দেখা
- ২ বছর আগে হঠাৎ পেলাম নীলপরির দেখা
আরো পড়ুন