ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

সুরের পাখি সিঁদুরে-হলুদ মৌটুসী

শামীম আলী চৌধুরী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৫৪, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১   আপডেট: ১২:২৫, ২৫ জুন ২০২১
সুরের পাখি সিঁদুরে-হলুদ মৌটুসী

লেখক ছবিটি সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান থেকে তুলেছেন

জাপানি কাঠশালিকের ছবি তোলার জন্য খুব ভোরে সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের টাওয়ারে অপেক্ষা করছি। আমি ছাড়াও আরো কয়েকজন বার্ড ফটোগ্রাফার ছিলেন। ২০১৯ সালের ৩ থেকে ১০ মার্চ পর্যন্ত রোজ পাখিটিকে টাওয়ারসংলগ্ন মান্দার গাছে দেখা গেছে। সেসময় অনেকেই পাখিটির ছবি তুলেছেন।

অফিসে কাজের ব্যস্ততার কারণে তখন যেতে পারিনি। ১০ তারিখ যখন টাওয়ারে ছিলাম তখন বেলা ১০টায় এক ঝাঁক কাঠশালিকের সঙ্গে পাখিটি এসে মান্দার গাছের ডালে বসলো। মাত্র কয়েক মুহূর্তের ব্যাপার। ক্যামেরা তাক করার আগেই পাখিটি উড়ে গেল! মন খারাপ করে পাখিটির ফিরে আসার অপেক্ষায় রইলাম। এদিকে সারাদিন না খেয়ে টাওয়ারে দিন কাটালাম। সূর্যাস্তের পর টাওয়ার থেকে নেমে এলাম অনেকটা ব্যর্থ হৃদয়ে। কারণ পাখিটির দেখা আর পেলাম না।

পরের দিন ভোরে আবার টাওয়ারে উঠলাম। সকাল গড়িয়ে দুপুরের সময় হয়ে এলো। অথচ পাখিটি আর এলোই না! নিজের চোখে পাখিটিকে দেখতে পেরেছি এটাই ছিল বড় সান্ত্বনা। শুধু ছবিটা তুলতে পারিনি। তাই বলে ভাগ্য এতই খারাপ! অন্যরা পাখিটির ছবি তুলতে পারলো, আমি পারলাম না- এমন চিন্তা অবশ্য মাথায় আনিনি। তবে জাপানি কাঠশালিকের ছবি তুলতে না পারলেও সেদিন আরো দুই প্রজাতির পাখির ছবি তুলেছিলাম।

সেই ঘটনা ছিল আমার জীবনে সবচেয়ে বড় পাওয়া। প্রথম দেখাতেই অবাক হয়ে রইলাম! ভাবলাম সিঁদুরে মৌটুসী হবে। কিন্তু বুক ও পিঠ দেখে চমকে গেলাম- উত্তেজনা বেড়ে গেল! ক্যামেরা তাক করে অনেকগুলো ছবি নিলাম। তখন পর্যন্তও পাখিটির পরিচয় জানা ছিল না। পরে জানলাম পাখিটি ছিল- সিঁদুরে হলুদ মৌটুসী।

এটি প্রায় ১০ সে.মি. দৈর্ঘ্যের এবং মাত্র ৬ গ্রাম ওজনের বাদামী চোখওয়ালা গায়ক পাখি। মৌটুসী জাতের এই পাখি ‘টোনা’ বা ‘টুনি’ নামেও পরিচিত। বাহারি এই পাখির রঙের মেলা শুধু পুরুষ পাখি বা টোনার দেহেই দেখা যায়। এদের  ঠোঁটের আগা থেকে লেজের ডগা পর্যন্ত লম্বায় মাত্র ১৪-১৫ সেন্টিমিটার। যার মধ্যে লেজ চার ও ঠোঁট দুই সেন্টিমিটার। লেজ ছোট ও গোলাকার। পেট হালকা হলদে। মাথা ও মুখমণ্ডল ধূসর বা নীলচে ধূসর।

অন্যদিকে, বাহারি টোনার মাথার চাঁদি, মুখমণ্ডল, কান-ঢাকনি ও গলা ধাতব নীল থেকে বেগুনি। মাথার পেছন, ঘাড়, পিঠ ও দেহের ওপর সিঁদুরে লাল। ডানার ওপর জলপাই রঙ। বুক-পেট ও লেজের নিচের দিক হলুদ। লেজের পালক নীল। এদের চোখ বাদামি রঙের। ঠোঁট, পা ও নখ কালো। সিঁদুরে হলুদ মৌটুসী গানের পাখি। এরা চমৎকার জিট্-জিট্ স্বরে গান গায়। বেশ চঞ্চল, বেশিক্ষণ এক জায়গায় থাকে না। বাতাসে ঢেউ খেলিয়ে আলোর ঝিলিকের মতো একগাছ থেকে আরেক গাছে এবং ফুলে ফুলে উড়ে বেড়ায়।

সিঁদুরে-হলুদ মৌটুসীর মূল খাদ্য হলো মধু। তবে মধুর অভাবে ছোট ছোট পোকা ও মাকড়সাও খেয়ে থাকে। এই পাখি অন্যান্য মৌটুসীর মতো শূন্যে স্থির থেকে ডানা ঝাপটিয়ে ফুলের মধু পান করে। সাধারণত এপ্রিল থেকে আগস্টের মধ্যে প্রজনন করে। প্রজননকালে গাছের পাতায় মাকড়সার জাল ও শেওলা দিয়ে ছোট ঝুলন্ত বাসা বানায়। বাসার একদিকে থাকে প্রবেশ পথ। তাতে দু-তিনটি সাদা ডিম পাড়ে স্ত্রী পাখি, যার ওপর থাকে হালকা লালচে-বাদামি ছিট। ডিম ফোটে ১৪-১৫ দিনে। স্ত্রী ও পুরুষ পাখি একত্রে মিলে ছানাদের খাওয়ায়।

সিঁদুরে-হলুদ মৌটুসী বাংলাদেশের অনিয়মিত পাখি। চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের চিরসবুজ বনে পাওয়া যায়। এ ছাড়াও ভারত, নেপাল, ভুটান, চীন, তিব্বত, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও পাকিস্তানসহ দক্ষিণ, পূর্ব এশিয়ায় এর বৈশ্বিক বিস্তৃত রয়েছে। বাংলাদেশের বণ্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতি সংরক্ষিত।

বাংলা নাম: সিঁদুরে-হলুদ মৌটুসী
ইংরেজি নাম: Mrs. Gould's Sunbird
বৈজ্ঞানিক নাম: Cinûris Cinûris ((Vigors, 1831)

হাসনাত/তারা

ঘটনাপ্রবাহ

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়