ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

মানব ইতিহাসে রোজার ইতিবৃত্ত

প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:১৯, ১২ এপ্রিল ২০২১   আপডেট: ২১:২০, ১২ এপ্রিল ২০২১
মানব ইতিহাসে রোজার ইতিবৃত্ত

রোজা মানে নির্দিষ্ট কিছু সময়, কিছু বস্তু গ্রহণ এবং কিছু কিছু কাজ থেকে বিরত থাকা। রোজা ইসলামের চতুর্থ স্তম্ভ। ইসলামে রোজা তাই সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এবং তাঁর বান্দাদের মধ্যে একটি বিশেষ বিষয়। ইতিহাসে রোজা কখন থেকে শুরু হলো সে বিষয়ে এখানে আলোকপাত করতে চাই।

মানব সৃষ্টির শুরু থেকেই রোজা চলে আসছে। আদম আ. এবং তাঁর স্ত্রী হাওয়া আ.কে জান্নাতে বসবাস করার জন্য আল্লাহ নির্দেশ দেন। আল্লাহ বলেন, ‘হে আদম! তুমি এবং তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস করতে থাকো এবং সেখানে যা চাও, যেখান থেকে চাও, পরিতৃপ্তিসহ খেতে থাকো কিন্তু তোমরা এ গাছের কাছে যেও না, তাহলে জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।’ (সূরা বাকারা, আয়াত- ৩৫)

মুফাসসিরিনদের মতে এই যে নির্দিষ্ট একটি গাছের ফল নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে খেতে নিষেধ করা হয়েছিল, এটাই ছিল মানব ইতিহাসের প্রথম রোজা। সুনানু ইবন মাজাহ-এর আলোকে জানা যায় রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেছেন, নূহ আলাইহিস সালাম ১ শাওয়াল ও ১০ জিলহজ ব্যতীত সারা বছর রোজা রাখতেন। সেসময় রোজা রাখা আমাদের সময়ের মতো ছিল না। রোজার ধরন, কোন কোন বিষয় থেকে বিরত থাকতে হবে, কতক্ষণ সময় বিরত থাকতে হবে, এ বিষয়গুলো ভিন্ন ভিন্ন ছিল।

আফ্রিকার কঙ্গোতে বসবাসকারী কুতো উপজাতির লোকদের মধ্যে একটি প্রচলন রয়েছে, স্বামীর মৃত্যুর পর তিন মাস স্ত্রীকে শোক পালন করতে হতো। স্ত্রী চুল ছেটে ফেলত, সব পরিধেয় কাপড় ছেড়ে দিত, গাছের লতাপাতা দিয়ে লজ্জাস্থান আবৃত রাখত এবং প্রথম তিন মাস তাদের ঘরেই তারা চুপচাপ অবস্থান করত। এই যে চুপচাপ করে থাকা, এটিই ছিল তাদের জন্য রোজা। তাছাড়া মাদাগাসকারের সিহানাকান উপজাতির লোকেরাও বনী-ইসরাঈলের মতো যাতে কাজ করা হয়, সেজন্য বিধবারা রোজা রাখত অর্থাৎ চুপ থাকত। বিধবা শব্দের আরবি হচ্ছে ‘আরমালাহ’। আবার এই শব্দটি হিব্রু ভাষায় নিশ্চুপ অথবা নিশ্চুপ মহিলা অর্থে ব্যবহৃত হয়। আরমালাহ বা বিধবাদের শোক পালনের পদ্ধতি ছিল কথাবার্তা না বলে চুপ থেকে রোজা রাখা।

একই ধরনের বিষয় আমরা পবিত্র কুরআন কারীমে পেয়ে থাকি। যাকারিয়া আ.কে তাঁর পুত্র নবী ইয়াহইয়া আ. সম্পর্কে যখন সুসংবাদ দেয়া হয়, তখন যাকারিয়া আ. তাঁর সুসংবাদ দাতাকে ইয়াহইয়া আ. এর জন্মের ব্যাপারে তার করণীয় কী জানতে চেয়েছিলেন। বলা হয়েছিল, ‘আপনি তিন দিন যাবত কথা বলবেন না, ইশারা ছাড়া এবং এটাই ছিল যাকারিয়া আলাইহিস সালাম এর রোজা।

পুরনো আমলের মিশরের রোজা তখন মানবজাতির মধ্যে ইহকালীন ও পরকালীন চিন্তা বেশি করে জেঁকে বসে। বিশেষ করে পুরনো ধর্মীয় গোষ্ঠীর লোকেরা রোজাকে ধর্মীয় দৃষ্টিতে ফরজ মনে করত। এর মাধ্যমে তারা মৃতদের রূহের নিকট পৌঁছত। তারা বিশ্বাস করতো যে, জীবিতদের রোজা মৃতদের সন্তুষ্ট করবে, কেননা তারা দুনিয়ার খাবার থেকে বঞ্চিত। পাদ্রীরা এই বিষয়গুলো তাদের অনুসারীদের মধ্যে প্রচার করেছিল এবং নির্দিষ্ট কিছু খাবার থেকে বিরত থাকাকেই রোজা হিসেবে আখ্যা দেয়া হতো। অন্যদিকে পাদ্রীদের রোজা এবং সাধারণের রোজাও ভিন্ন ভিন্ন ছিল।

পুরনো আমলে বেবিলনের বাসিন্দারা তারকারাজির আবর্তনের মাধ্যমে সময় নির্ধারণ করে রোজা রাখত। তখনকার জ্যোতিষ শাস্ত্রের মাধ্যমে তারা এ সময় নির্ধারণ করত। তাদের রোজা ‘শিতু’ নামে পরিচিত ছিল। এটা ছিল নফল বা অতিরিক্ত বিষয়। একান্ত কর্তব্য বা ফরয ছিল না। এরা বিচ্ছিন্নভাবে ৩০ দিন রোজা রাখত। সুবহে সাদিক থেকে শুরু করে সূর্যাস্তের পর অন্ধকার হয়ে আসা পর্যন্ত রোজা রাখত।

ভারতীয় হিন্দুদের পুরনো সমাজ রীতি অনুসারে জনগোষ্ঠী ছিল বিভিন্ন জাত ও স্তরে বিশ্বাসী। ব্রাহ্মণ নমঃশুদ্র ইত্যাদি। তারা পুনর্জন্মে বিশ্বাস করত। এ জন্য প্রথম জন্মে দান করা, রোজা রাখা, বলি দেয়া ইত্যাদি কাজ বেশি করত। যাতে দ্বিতীয় জন্মে তারা ভালো ফল পায়। প্রতিদিন সকালে একবার খেয়ে একাধারে তিনদিন রোজা রাখত। পরের তিন দিন প্রতি সন্ধ্যায় খাবার খেয়ে আবার একাধারে রোজা রাখত। এর পরের তিনদিন কেউ না চাইলেও দান করত। তার পরের তিনদিন আবার রোজা রাখত। এমনি আরও অনেক বর্ণনা অনেক জাতি ও উপজাতি সম্পর্কে পাওয়া যায়।

গ্রীক সভ্যতায় পাদ্রীরা সাধারণ মানুষ এবং তাদের নিজেদের রোজা নির্ধারণ করে দিতো। তারা এই রোজা রাখাকে এক ধরনের আধ্যাত্মিকতা মনে করত। আধ্যাত্ম বিষয়গুলোকে দু’টি ভাগে ভাগ করত। একটি ছোট আধ্যাত্ম ব্যাপার অপরটি বড় আধ্যাত্ম ব্যাপার। ছোট আধ্যাত্মিকতার জন্য তারা প্রথমত রোজা রাখত, গোসল করত, এরপর বড় আধ্যাত্মিকতার অনুসারীরা চার দিন রোজা রাখত, দেবতার জন্য পবিত্র যে খাবার, সে খাবার দিয়ে তারা ইফতার করত।

স্বাভাবিকভাবেই রোমান সভ্যতায় রোজা রাখার বিষয়টি গ্রীক সভ্যতায় রোজা রাখার বিষয় দ্বারা প্রভাবিত ছিল। অর্থাৎ এরা গ্রিকদের মতোই রোজা রাখত। পাদ্রীরা এদের রোজা ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বিশেষে বিভিন্ন ধরনের করে দিত। ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীর জন্য এক ধরনের রোজা ছিল। আর পাদ্রীদের জন্য অন্য রকম রোজা ছিল। তারা নির্ধারণ করে দিতো কার রোজায় কী কী থেকে বিরত থাকতে হবে, আবার কী কী বিষয় থেকে তাকে দূরে রাখা হবে।

পারস্যের ‘জারাদাশত’ ধর্মাবলম্বীরা ছিল পুরনো ধর্মগোষ্ঠী। তারা রোজাকে নিরুৎসাহিত করত; কিন্তু ‘মান’ ধর্মের অনুসারীরা রোজা রাখত। এটা তাদের প্রধান ধর্মীয় ভিত্তিও ছিল। তারা রোজার তারিখ নির্ধারণে জ্যোতিষ শাস্ত্র ব্যবহার করত। পূর্ণচন্দ্রের সময় দু’দিন চাঁদ উঠার পর দু’দিন-  এভাবে তারা রোজা রাখত। তারা সূর্যাস্তের সময় ইফতার করত।

নবী ইসহাক আ. এর পুত্র নবী ইয়াকুব আ. কে ইসরাইল বলা হতো। তার বংশধরদেরকেই বনি ইসরাইল বলা হয়। এ সময় রোজার দু’টি ধরন পরিলক্ষিত হয়। একটি ধরন নবী-রাসূলদের জন্য বিশেষায়িত ছিল, আর দ্বিতীয় ধরন সাধারণ মানুষের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। নবী-রাসূলদের রোজা এক রকম ছিল, সাধারণ মানুষের রোজা বিচ্ছিন্ন কিছু দিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এছাড়াও বিভিন্ন আনন্দ, দুঃখ, বিপদ থেকে পরিত্রাণ, ইত্যাদি উপলক্ষে তারা রোজা রাখত।

ইয়াহুদীরা ব্যাবিলনিয় যুগে শোক এবং দুশ্চিন্তার প্রতীক হিসেবে রোজা রাখত। তারা সাময়িকভাবে রোজা রাখত; যখন ধারণা করত যে স্রষ্টা তাদের উপর কঠোরভাবে ক্ষেপে আছেন, তখন তারা রোজা রাখত। মহামারির সময় তারা রোজা রাখত। তারা বাদশাহ কর্তৃক নতুন প্রকল্প গ্রহণ উপলক্ষে রোজা রাখত। দুঃখজনক ঘটনা ঘটলেও রোজা রাখত, তবে এসব দিনের রোজা বাধ্যতামূলক ছিল। আর যদি সুখে থাকা অবস্থায় কোনো রোজা রাখতে হতো, সেটার বাধ্যবাধকতা ছিল না। প্রথম দিকে ইয়াহুদিদের রোজা বছরে ২৫ দিন রাখা হতো। আবার এলাকা ভেদে এ রোজার দিনের পরিমাণ এবং অবস্থার ভিন্নতা ছিল। তবে ইয়াহুদীদের কাছে প্রচলিত বছরের প্রথমদিন সকলেই রোজা রাখত। তারা দেরিতে বৃষ্টি হলে রোজা রাখত। দুর্ভিক্ষের সময় রোজা রাখত। এভাবে ইয়াহুদীদের রোজার পরিচয় পাওয়া যায়। ব্যক্তিগত সমস্যা, দুর্ঘটনা, পাপ ও পঙ্কিলতা থেকে মুক্তির জন্য তারা রোজা রাখত। এমনকি খারাপ স্বপ্ন দেখেও তারা রোজা রাখত। ইয়াহুদীদের কাছে পবিত্র গ্রন্থ ‘তালমুদ’ অনুযায়ী, তাদের ঈদের দিন কোন রোজা পড়ে গেলে, তা পরে সাধারণ দিনে রাখার নির্দেশ ছিল। তারা সূর্যোদয় থেকে রাতের প্রথম তারা দৃষ্টিগোচর হওয়া পর্যন্ত রোজা রাখত। আবার কাফফারার দিনের রোজা সন্ধ্যা থেকে পরের দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত রাখা হতো।

আল্লাহর প্রেরিত নবী ও রাসূল ঈসা আ. থেকেই খ্রিষ্টধর্মের শুরু হয়। ঈসা আ. তার নবুয়ত প্রাপ্তির আগে ৪০ দিন রোজা রেখেছিলেন। তিনি কাফফারার দিনেরও রোজা রেখেছিলেন। খ্রিস্টানদের মধ্যে যারা বনি ইসরাইলের অন্তর্ভুক্ত তারা আজও কাফফারার দিনের রোজা রাখেন। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের শেষদিকে, ‘পল’ এর মৃত্যুর অর্ধশতাব্দী পরেও এভাবে রোজা রাখা হতো। খ্রিস্টান পাদ্রী এরিনিসের মতে এই রোজা এক দিনের, দুই দিনের, কয়েকদিনের আবার চল্লিশ ঘণ্টারও ছিল। খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে প্রতি সপ্তাহে বুধবার এবং শুক্রবারে রোজা রাখা হতো। এরপর দ্বিতীয় থেকে পঞ্চম শতাব্দি পর্যন্ত তাদের নানারকম নিয়মকানুন আরোপ করে রোজা রাখার বিধান দেয়া হয়। কখনো কখনো রোজা মধ্যরাতে শেষ হতো, আবার কখনো কখনো মোরগ ডাকার আগ পর্যন্ত রোজা রাখতে হতো। খ্রিস্টীয় বিভিন্ন দিবসে রোজা রাখা হতো। কখনো কখনো তিন ঘণ্টা, চার ঘণ্টা অথবা নির্দিষ্ট কিছু সময় পানাহার থেকে বিরত থাকাকেই তারা রোজা হিসেবে গ্রহণ করত। ইংল্যান্ডের গির্জা থেকে শেষের দিকে রোজার নিয়মাবলি এবং বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়। ষষ্ঠ এডওয়ার্ড এবং প্রথম জেমস এর আমলে রোজার সময় গোশত থেকে বিরত থাকার বিধান চালু হয়।

ইসলাম-পূর্ব জাহেলী যুগে, বিভিন্ন উপলক্ষে রোজা রাখা হতো। রাসূল সা. মদিনায় আশুরার রোজা নিয়ে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদেরকে রোজা রাখতে দেখে জিজ্ঞেস করেন, তারা আশুরার রোজার কথা বলে। রাসূল সা. তাদের অনুসরণ যাতে না হয় এবং তাদের চেয়ে একটু ভিন্ন হয়, সেজন্য আশুরা এবং তার আগের দিন অথবা তার পরের দিন, কমপক্ষে দু’দিন দু’দিন করে মুসলমানদের রোজা রাখার নির্দেশ দেন।

মহান আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনের সুরা বাকারার ১৮৩ নম্বর আয়াত অবতীর্ণের মাধ্যমে মুসলিম জাতির উপর রোজা ফরজ করেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা পরহেযগারী অর্জন করতে পারো।’ হিজরী শাবান মাসের ১০ তারিখে এই আয়াতটি আল্লাহ তা'আলা তাঁর প্রিয় রাসূল সা. এর উপর নাযিল করেন এবং মুসলমানদের উপর রোজা ফরজ হয়। মহানবীর নির্দেশ মতে ইসলামের এই ফরজ রোজা, রমজান মাসে পালিত হয়ে থাকে।

মানব ইতিহাসে রোজা- এই বিষয়ে আরো দীর্ঘ আলোচনা হতে পারত। এখানে পাঠক-এর যাতে বিরক্তি না আসে সেজন্য সংক্ষেপে উপরোক্ত কথাগুলো উপস্থাপন করা হল। মহান স্রষ্টা আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সকলকে রোজাব্রত পালন করার তাওফিক দিন। আমিন!

ঢাকা/তারা

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়