ঢাকা     সোমবার   ০৬ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২৩ ১৪৩১

করোনায় বিপর্যস্ত ‘মুন্ডা’ সম্প্রদায়

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৩৩, ২৯ এপ্রিল ২০২১   আপডেট: ১৪:৩৪, ২৯ এপ্রিল ২০২১
করোনায় বিপর্যস্ত ‘মুন্ডা’ সম্প্রদায়

উঠান থেকে এখনও নামেনি সাইক্লোন আম্পানের পানি

মুন্ডা সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষ সবাই বাইরে কাজ করে। কঠোর শ্রমের মধ্য দিয়েই ভূমিহীন এই সম্প্রদায়ের মানুষের জীবিকা চলে। কাজ না পেলে খুব কষ্টে দিন যায়। সেই কষ্টের দিন অতিক্রম করছে তারা।

সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের দাতিনাখালী গ্রামে অনেকগুলো মুন্ডা পরিবারের বসবাস। সোমবারী মুন্ডা (২৮) বলছিলেন, কাঁকড়ার ঘেরে কাজ করলে মাসিক মজুরি মিলতো ৭ হাজার টাকা। এই টাকায় সংসার চলে যেত। কিন্তু করোনার কারণে সব বন্ধ হয়ে গেছে। এর ওপর সাইক্লোন আম্পান আরও ক্ষতি করে দিয়ে গেছে। এখন তিনবেলা খাবার যোগানো কঠিন! সোমবারী বাধ্য হয়েছেন ২০ হাজার টাকা ঋণ নিতে।

দাতিনাখালী গ্রামের নারায়ণ মুন্ডা (৫২) বলেন, পাঁচ মাস কাজকর্ম নাই। করোনার কারণে সব বন্ধ। কৃষিকাজে যেতে পারি না। সুন্দরবনে নিষেধাজ্ঞা আছে। কাঁকড়া ধরা, মাছ ধরা- সবই বন্ধ। ফলে রোজগারের অন্য কোনো পথ নাই। ৫ জনের সংসার তিনি কীভাবে চালাবেন জানেন না তিনি।

কোভিড-১৯ এবং সাইক্লোন আম্পানের প্রভাব

কয়রা উপজেলা সদরের নলপাড়া গ্রামে ৩৫টি মুন্ডা পরিবার অত্যন্ত মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। সাইক্লোন আম্পানে এই গ্রামের বহু পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখনও অনেক ঘর পানির তলায় ডুবে আছে। অনেক মাটির ঘর নষ্ট হয়ে গেছে। রামচন্দ্র মুন্ডা (৫৯) বলছিলেন, এখন কৃষিকাজের মৌসুম। কিন্তু ফসলের মাঠ পানিতে ডুবে আছে। নিষেধাজ্ঞার কারণে যেতে পারছি না সুন্দরবনে। দিন মজুরি করে কোনোমতে দিন কাটাচ্ছি। ১৫ হাজার টাকা ঋণ। কাজকর্ম না পেলে এই টাকা শোধ করবো কি দিয়ে?

সূত্র বলছে, কোভিড ১৯ এর কারণে বাংলাদেশে লকডাউন শুরু হয় গত বছর মার্চ মাসের মাঝামাঝি থেকে। সে সময় সুন্দরবনে কাজ ছিল। কিন্তু ২০ মে থেকে সমুদ্রে ৬৫ দিনের মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা শুরু হয়। এর আওতায় সুন্দরবন পড়েছে। ফলে সুন্দরবনে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এই নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত থাকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত। এরপর জুলাই-আগস্ট মাস সুন্দরবন এলাকায় মাছের প্রজননকাল। এই দুই মাস সুন্দরবনে মাছ, কাঁকড়া ধরা নিষিদ্ধ থাকে। এভাবেই একের পর এক সংকটে কাটে ওই অঞ্চলের মুন্ডা সম্প্রদায়ের মানুষের।

কয়রার জলবায়ু পরিষদের সদস্য নিরাপদ মুন্ডা বলেন, করোনাসৃষ্ট মহামারির কারণে প্রথমে সংকট তৈরি হয়। অনেকেই বাইরে কাজে যেতে পারেনি। বিভিন্ন এলাকায় কাজে থাকা মানুষেরাও লকডাউনের কারণে এলাকায় চলে এসেছে। এরপর ২০ মে সাইক্লোন আম্পান এসে আরও ক্ষতি করে। আম্পানের কারণে গত মৌসুমে অনেক স্থানে আমন আবাদ হয়নি।

সামাজিক বৈষম্যের শিকার

শ্যামনগর উপজেলার মুন্সীগঞ্জে ইউনিয়নের জেলেখালি গ্রামের আদিবাসী মুন্ডা পল্লীতে থাকেন রুমা মুন্ডা (৬০)। তিনি বলেন, সবাইকে দেয়ার পর কিছু থাকলে আমরা পাই। আমরা তো এই সমাজের মানুষ না। আমাদের খবর কে নেয়? জীবনের এত বড় মহামারি কখনো দেখিনি! সামান্য যা পেয়েছি, তা খাওয়া শেষ। এখন কী খাব?
শ্যামনগরের মতো অন্যান্য উপজেলার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী মানুষের একই সমস্যা। স্থানীয় সূত্রগুলোও বলছে, সুন্দরবন এলাকার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী মানুষ বহুমূখী সামাজিক বৈষম্যের শিকার। সরকারি-বেসরকারি সহায়তার সামান্য পরিমাণ এদের কাছে পৌঁছায়। সাহায্যের তালিকায় এদের নাম উঠানো খুবই কঠিন। করোনা মহামারিতে প্রথম দফায় সারাদেশে কাজ হারানো ৫০ লাখ হতদরিদ্র মানুষের জন্য সরকার সাহায্য বরাদ্দ করেছিল। শ্যমনগর উপজেলার বুড়িগোলিনী ইউনিয়নে এই সহায়তা গিয়েছিল ৭০০ পরিবারের জন্য। ওই ইউনিয়নে ১০০ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পরিবার আছে। এদের মধ্যে সাহায্যের তালিকায় নাম উঠেছে মাত্র ১০ জনের। অথচ এরা সকলেই হতদরিদ্র। 
বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ভবতোষ কুমার মন্ডল বলেন, আমরা পরিষদ থেকে যতটা সম্ভব তাদের সাহায্যের চেষ্টা করি। সরকারি সহায়তা যত বেশি পরিবারকে সম্ভব আমরা দেই। কয়রা সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হুমায়ূন কবিরও একই সুরে বলেছেন, আমরা সাধ্যমত তাদেরকে সহায়তা দেয়ার চেষ্টা করি। 

ঐতিহাসিক তথ্যসূত্র বলছে, ১৮০০ শতক থেকে সুন্দরবন এলাকায় বসবাস শুরু করে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়গুলো। এদের মধ্যে মুন্ডা সম্প্রদায়ের লোকসংখ্যা বেশি। এক সময় এদের ভূমি ছিল। বিভিন্ন কারণে তারা সে জমি হারিয়ে ফেলেছে। এখন তারা ভূমিহীন। অধিকাংশ পরিবার খাসজমিতে বসবাস করে। সুন্দরবন আদিবাসী মুন্ডা সংস্থার নির্বাহী পরিচালক কৃষ্ণপদ মুন্ডা বলেন, মুন্ডা সম্প্রদায় আদিকাল থেকেই অবহেলিত। এরা সব ধরনের সামাজিক বৈষম্যের শিকার। এই সম্প্রদায় শিক্ষায় অনেক পিছিয়ে আছে। লেখাপড়া না থাকায় ভালো কোনো কাজে এদের প্রবেশাধিকার নেই। এদের আর্থিক অবস্থা এতই খারাপ, একদিন কাজ না করলে পরের দিন ঘরে খাবার থাকে না। 

ইতালিয়ান নাগরিক ফাদার লুইজির চেষ্টা

তিনি ফাদার লুইজি পাজ্জি। বয়স যখন মাত্র ২৭, তখন থেকে তিনি বাংলাদেশে। এখন বয়স ৭২ অতিক্রম করেছে। পিছিয়ে পড়া মানুষদের এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন তিনি। বাংলাদেশের পশ্চিম উপকূলের শ্যামনগরের ঈশ্বরীপুরে ক্যাথলিক চার্চ পরিচালিত যিশু আশ্রমের পরিচালক তিনি। এখানে পিছিয়ে পড়া মুন্ডা সম্প্রদায়কে নিয়ে কাজ শুরু করেন ২০০২ সালে। এর আগে ছিলেন খুলনার চুকনগরে, আরেক প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সঙ্গে।

ফাদার লুইজি বলেন, পিছিয়ে পড়া এই জনগোষ্ঠীর খোঁজ পেয়ে প্রথমে জরিপ করি। ভয়ঙ্কর অবস্থা- কেউ লেখাপড়া জানে না। সেজন্যে ওদের লেখাপড়ার ওপর জোর দেওয়া হয়। প্রথম দিকে ওরা বিভিন্ন দাবি করতো সরকারের কাছে। কিন্তু ওদের জনসংখ্যা মাত্র ৪-৫ হাজার। তাই সরকারের দিক থেকে তেমন সাড়া মেলেনি। 
ইতালিয়ান নাগরিক ফাদার লুইজির উদ্যোগের পর থেকেই সুন্দবন এলাকার আদিবাসী সম্প্রদায় আলোর দেখা পায়। যে কারণে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। বাল্য বিয়ে কমেছে। কুসংস্কার কমেছে। ছেলেমেয়েরা এখন স্কুলমূখী। তবে কর্মসংস্থানের অভাব এবং আর্থিক সংকট এদের সামনে এগুতে দেয় না।

প্রয়োজন বিশেষ অর্থনৈতিক প্রকল্প

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, সাময়িক সহায়তা দিয়ে সুন্দরবন এলাকার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রা পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। এদের জন্য প্রয়োজন বিশেষ অর্থনৈতিক প্রকল্প। প্রথমত তাদেরকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে তুলতে হবে। দ্বিতীয়ত দক্ষতা অনুযায়ী কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে।

কৃষ্ণপদ মুন্ডা বলেন, বাংলাদেশের ভূমি আইনে উল্লেখ আছে, জেলা প্রশাসকের অনুমতি ছাড়া আদিবাসীদের জমি বিক্রি করা যাবে না। এই আইন প্রয়োগ হলেই আদিবাসীদের ভূমি রক্ষা হতে পারে। প্রশাসন আইন প্রয়োগে কঠোর হলে আদিবাসীরা জমি হারাবে না। জমি রক্ষার পাশাপাশি এদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।

ফাদার লুইজি পাজ্জি বলেন, আদিবাসী সম্প্রদায়ের জনগণের মাঝে শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে। এর পাশাপাশি টেকনিক্যাল শিক্ষা দিতে হবে। সম্মানজনক কাজের ব্যবস্থা করতে পারলে এদের অবস্থা বদলে যাবে।   

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়