ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

আরপি সাহার ৫০তম অন্তর্ধান ও মির্জাপুর গণহত্যা দিবস আজ

কেএমএ হাসনাত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:১৭, ৭ মে ২০২১   আপডেট: ১১:০৩, ৭ মে ২০২১
আরপি সাহার ৫০তম অন্তর্ধান ও মির্জাপুর গণহত্যা দিবস আজ

দানবীর হিসাবে খ্যাত রণদাপ্রসাদ সাহার (আরপি সাহা) ৫০তম অন্তর্ধান ও মির্জাপুর গণহত্যা দিবস আজ। ১৯৭১ সালের ৭ মে  মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকহানাদার বাহিনী টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের সাধারণ মানুষের উপর আকস্মিক আক্রমন করে ব্যাপক গণহত্যা চালায় এবং গ্রামবাসীর বাড়িঘর লুটপাট করে। এইদিন রাতে আরপি সাহা ও তার একমাত্র ছেলে ভবানী প্রসাদ সাহা রবিকে নারায়ণগঞ্জ কুমুদিনী কমপ্লেক্স থেকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর আর তাদের কোন খবর পাওয়া যায়নি।

১৯৭১ সালের ৭ মে ছিলো শুক্রবার। মির্জাপুরে সাপ্তাহিক হাটবার। এদিন জুমা নামাজের পর স্থানীয় দালাল মওলানা ওয়াদুদের নির্দেশে ও তার দুই ছেলে মান্নান ও মাহবুবের নেতৃত্বে কিছু ধর্মান্ধ ব্যক্তি মির্জাপুর বাজারে ব্যাপক লুটপাট চালায়। একই সঙ্গে পাক হানাদার বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে মির্জাপুরের সাহা পাড়ায় হামলা চালিয়ে নিরাপরাধ গ্রামবাসীদের নির্মমভাবে হত্যা করে কিছু লাশ পাশের বংশাই নদীতে ভাসিয়ে দেয়। বাকিদের বংশাই নদীর পাশে পুঁতে রাখে।

আরপি সাহার প্রতি সাধারণ মানুষের আকাশ প্রমাণ ভালবাসায় সব সময় ঈর্ষার চোখে দেখেছেন মওলানা ওয়াদুদ। ভারতেশ্বরী হোমস প্রতিষ্ঠার পর কোন এক দুর্গা পূজার সময় বংশাই নদীতে এক নৌকা ডুবিতে হোমসের বেশ ক’জন ছাত্রীর করুণ মৃত্যু হয়। এরমধ্যে বেশ ক’জন মুসলমান ছাত্রীও ছিলেন। ভারতেশ্বরী হোমসের ছাত্রীদের আরপি সাহা নিজের সন্তানের মত স্নেহ করতেন। ওইসব ছাত্রীদের মৃত্যুর পর অভিভাবকদের সম্মতিতে কুমুদিনী কমপ্লেক্সেই তাদের দাফন করা হয়। এ ঘটনাকে মওলানা ওয়াদুদ ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেন। তিনি হিন্দুর জায়গায় মুসলমানদের দাফনের বিরোধীতা করে কুমুদিনী কমপ্লেক্সের যে জায়গায় কবরস্থান করা হয়েছে সে জায়গা মুসলমানদের কাছে হস্তান্তরের দাবি তোলেন। আর এ নিয়ে মওলানা ওয়াদুদ যে কোন ভাবেই হোক আরপি সাহার বিভিন্ন সমাজ সেবামূলক কাজে বিরোধীতা শুরু করেন। আর এসব বিষয়ে তৎকালীন ইসলামাবাদ সরকারের উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত দেনদরবার করেও কিছু করতে পারেননি। মওলানা ওয়াদুদের অভিযোগ পর্যালোচনা করতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা, আইযুব খানসহ অনেকেই মির্জাপুর সফরে আসেন এবং তাদের কাছে মওলানা ওয়াদুদের অভিযোগ মিথ্যা বলে প্রতীয়মান হয়।

মওলানা ওয়াদুদ কোনো ভাবেই কিছু করতে পারছিলেন না। অবশেষে পুঞ্জিভূত ক্ষোভ প্রকাশের সুযোগ আসে ১৯৭১ সালে।  ২৫ মার্চের কালোরাতের পর পাক হানাদার বাহিনী ৩ এপ্রিল ঢাকা থেকে টাঙ্গাইলের দিকে রওয়ানা হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল বাধার মুখে তারা টাঙ্গাইল পৌঁছে। এরপরই মওলানা ওয়াদুদ মির্জাপুরে শান্তিকমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠন করে। তার দুই ছেলে মান্নান ও মাহবুবের নেতৃত্বে শান্তিকমিটি স্থানীয় হিন্দুদের উপর অত্যাচার শুরু করে। আর অন্যদিকে মওলানা ওয়াদুদ পাকহানাদার বাহিনীর সঙ্গে যোগসাজস করে আরপি সাহাকে দমন করার কাজে মনোনিবেশ করেন। দালাল ওয়াদুদের প্ররোচনায় এপ্রিলের শেষ দিকে পাকহানাদার বাহিনী নারায়ণগঞ্জ থেকে আরপি সাহাকে ধরে নিয়ে যায়। তবে অনেক চেষ্টার পর সে দফায় তিনি ছাড়া পান।

’৭১ এর নরখাদক হিসেবে খ্যাত জেনারেল টিক্কা খান ৮ মে মির্জাপুরে কুমুদিনি হাসপাতাল পরিদর্শন করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। টিক্কা খানের মির্জাপুর সফর নিয়ে আরপি সাহা ব্যস্ত ছিলেন। ওয়াদুদ ও তার দোসররা জানতো টিক্কাখান একবার কুমুদিনী কমপ্লেক্সে আসতে পারলে আরপি সাহাকে আর শায়েস্তা করা যাবে না। আর এ কারণে ৭ মে দিনের বেলায় মির্জাপুরে লুটতরাজ চালায় আর রাতে নারায়ণগঞ্জ থেকে একমাত্র ছেলে ভবানী প্রসাদ সাহা রবি ও আরপি সাহাকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর তারা আর ফিরে আসেননি।

কুমুদিনী হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা রনদা প্রসাদ সাহা গ্রামের এক সাধারণ বাঙালী থেকে নিজের চেষ্টা ও পরিশ্রমে বিত্তশালী হয়েছিলেন। বিত্তবৈভবের সবকিছু অকাতরে দান করেছিলেন মানুষের কল্যাণে। তিনি বাংলাদেশে হাসপাতাল, একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং গরীবদের কল্যাণে ট্রাস্ট গঠন করেন। মানবতাধর্মী কাজে সম্পৃক্ত থাকায় তৎকালীন বৃটিশ সরকার রণদা প্রসাদ সাহাকে রায় বাহাদুর খেতাব দেন। পরবর্তীতে ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ সরকার মানবসেবায় অসামান্য অবদান রাখায় ও তার কাজের যথাযথ স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে স্বাধীনতা পুরস্কারে (মরণোত্তর) ভূষিত করে।

১৮৯৬ সালের ৯ নভেম্বর সাভারের কাছে কাছৈড় গ্রামের নানাবাড়িতে রণদাপ্রসাদ সাহার জন্ম । তার পৈত্রিক বাড়ি টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুরে। বাবা দেবেন্দ্রনাথ সাহা ও মা কুমুদিনী সাহার চার সন্তানের মধ্যে রণদা ছিলেন দ্বিতীয়। বাবা ছিলেন দলিল লেখক আর মা ছিলেন গৃহিণী। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে গ্রামবাংলার আর দশজন শিশুর মতোই রণদার হাতেখড়ি হলেও লেখাপড়া বেশীদূর এগোয়নি। কারণ তার ৭ বছর বয়সে সন্তান প্রসবকালে ধনুষ্টংকারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন মা কুমুদিনী দেবী। তাই প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যা তার অর্জন করা হয়নি। তবে তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত। গ্রামের নদী, নিসর্গ ও মানুষ, কলকাতা শহরের নাগরিক বাস্তবতা, তৎকালীন পরিস্থিতি- এসবের কাছ থেকে ভালোই শিক্ষা পেয়েছিলেন তিনি। নিজস্ব আদর্শ ও চিন্তাধারাও তৈরি হয়েছিল সেসব শিক্ষার গুণেই।

প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পর ছেলেমেয়েদের দেখাশুনার জন্য দেবেন্দ্রনাথ সাহা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। কিন্তু সৎ মায়ের অনাদর ও নিষ্ঠুরতা রণদাকে একরোখা ও বেপরোয়া করে তোলে। অবস্থা দেখে বাবা রণদাকে পাঠিয়ে দিলেন মামাবাড়ি সাভারের শিমুলিয়ায়। মা হারা রণদার মন বাবা ও সৎ মায়ের অনাদরে এতটাই বিষিয়ে উঠেছিল যে মামা বাড়িতেও আর তার মন বসল না। সেখান থেকে তিনি পালিয়ে গেলেন কলকাতায়। অপরিচিত কলকাতায় তার কোনো আশ্রয় নেই। জীবন ধারণের জন্য তখন কুলিগিরি, রিকশা চালানো, ফেরি করা, খবরের কাগজ বিক্রির মতো বিচিত্র কাজ করেছেন রণদা। কলকাতায় তখন কাজের সন্ধানে ছুটে আসা ভুখানাঙ্গা মানুষের ভিড়, গ্রামের পর গ্রাম উজাড় করে দেয় ম্যালেরিয়া- এসবই তাকে স্বদেশি আন্দোলনের দিকে নিয়ে যায়। মানুষের দুর্দশা লাঘবের জন্য বিপ্লবের দীক্ষা নেন তিনি। এজন্য তাকে কারাভোগও করতে হয়।

১৯১৪ সালে সারা বিশ্বে মহাযুদ্ধের দামামা বেজে উঠল। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের নেতা সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বিপ্লবীদের আহ্বান জানালেন ইংরেজদের হয়ে বিশ্বযুদ্ধে লড়াই করার জন্য। স্বেচ্ছাসেবী বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোরের হয়ে যুদ্ধে নামলেন রণদা প্রসাদ সাহা। ব্রিটিশ সেনাদের তখন দারুণ খাদ্যাভাব, নানা রোগে আক্রান্ত তারা। রণদা আহত সৈনিকদের সেবায় একেবারে ডুবে গেলেন। তিনি শক্রদের চোখ এড়িয়ে সবার জন্য খাদ্য সংগ্রহ করতেন। ব্রিটিশ সেনাবাহিনী যখন বাগদাদে বন্দি তখন সেখানে ছিল অ্যাম্বুলেন্স কোরও। একদিন হঠাৎ সামরিক হাসপাতালে আগুন লেগে যায়। আগুনের ভয়ে সবাই জীবন নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। তখন রণদা প্রসাদ দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা হাসপাতালের ভেতরে ঢুকে একজন রোগীকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। তাকে দেখে আরও তিনজন উদ্ধার কাজে যোগ দিলেন। শেষ রোগীটিকে বের করে এনে অজ্ঞান হয়ে গেলেন রণদা। সুস্থ হয়ে দেশে ফেরার পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও রণদাকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। বেঙ্গল রেজিমেন্টে ভর্তি হয়ে রণদা যখন ইরাক যান তখন তার সাথে দেখা হয় লম্বা চুল, বড় বড় চোখ আর প্রাণবন্ত এক যুবকের। তিনি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। রণদা তখন অস্থায়ী সুবেদার মেজর। রণদা প্রসাদ সাহা কাজী নজরুল ইসলামকে সংগীত বিভাগে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কাজী নজরুল ইসলামও নিজের পছন্দের কাজটি পেয়ে খুশি হয়েছিলেন।

বৃটিশ সরকার প্রথম মহাযুদ্ধ থেকে ফিরে আসা ভারতীয়দের সবাইকে যোগ্যতা অনুসারে চাকরি দিয়েছিল। লেখাপড়া সামান্য হলেও যুদ্ধে তার অবদানের কথা বিবেচনা করে রেলওয়ের কালেক্টরেটের চাকরি দেওয়া হয়েছিল রণদা প্রসাদকে। কর্মস্থল ছিল সিরাজগঞ্জ থেকে শিলাইদহ। মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে পড়ার কারণে ১৯৩২ সালে এই চাকরিতে ইস্তফা দেন তিনি। ক্ষতিপূরণ হিসেবে যে টাকাটা পান তা দিয়ে শুরু করেন কয়লার ব্যবসা। প্রথমে বাড়ি বাড়ি কয়লা সরবরাহ, পরে বড় বড় প্রতিষ্ঠানে কয়লা সরবরাহের কাজ করেন রণদা প্রসাদ। ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার জমিদার সতীশ চৌধুরীর পরামর্শ ও আর্থিক সহযোগিতায় মাত্র ছয় বছরে কলকাতার একজন প্রতিষ্ঠিত কয়লা-ব্যবসায়ী হয়ে উঠলেন তিনি। কয়লার ব্যবসার সূত্রে রণদা নৌযানের ব্যবসা শুরু করলেন। অন্য ব্যবসায়ীরা যখন ব্যবসায় ব্যর্থ হয়ে কোনোকিছু জলের দামে বেচে দিত, রণদা তা কিনে নিয়ে নতুন করে দাঁড় করাতেন। কোনো ব্যবসার সমস্যাগুলো দ্রুত খুঁজে বের করে সেটিকে আবার পুনর্জীবিত করে তুলতেন তিনি। এ সময়ে দ্য বেঙ্গল রিভার সার্ভিস কোম্পানি নামে নৌ-পরিবহন সংস্থা এবং নৌ-পরিবহন বীমা কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। এই কোম্পানির মাধ্যমেই তিনি নিজেকে একজন সফল নৌপরিবহন ব্যবসায়ী করে তোলেন। নৌপথে মালামাল আনা-নেওয়ার কাজে নিয়োজিত বেঙ্গল রিভার সার্ভিস প্রথমে যৌথ মালিকানায় থাকলেও পরে সব অংশীদারের অংশ কিনে নেন রণদা। ১৯৪২-১৯৪৩ সালে সরকারের খাদ্যশস্য ক্রয়ের এজেন্ট নিযুক্ত হন রণদা। ১৯৪৪ সালে নারায়ণগঞ্জে পাটের ব্যবসায় নামেন এবং জর্জ অ্যান্ডারসনের কাছ থেকে ‘জুট  প্রসেসিং বিজনেস’ এবং ‘গোডাউন ফর জুট স্টোরিং’ কিনে নেন। এরপরে নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও কুমিল্লায় ইংরেজদের মালিকানাধীন তিনটি পাওয়ার হাউস কিনেন। চামড়ার ব্যবসাও শুরু করেন এই সময়। এভাবেই নিজ মেধা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে অঢেল সম্পদের মালিক হন তিনি।

অর্থ বিত্তে বড় হলেও অর্থভাবে মায়ের মৃত্যুকে ভুলেননি রণদা। মায়ের সেই স্মৃতি তাকে তাড়িয়ে ফিরেছে সব সময়। তাই পরিণত জীবনে দুস্থ মানুষের সেবা দিতে গড়ে তুলেছেন মায়ের নামে দাতব্য প্রতিষ্ঠান কুমুদিনি ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর রণদা প্রসাদ বাংলাদেশে চলে আসেন। এ কারণে দুই দেশের ব্যবসা দুভাগ হয়ে যায়। ভারতে থাকা কুমুদিনী ওয়েলফেরার ট্রাস্টের টাকায় পরিচালিত হতে থাকে কলকাতা, কালিম্পং ও মধুপুরের কিছু দাতব্য প্রতিষ্ঠান। এদেশে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো আলাদা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। এই বছরই রণদাপ্রসাদের সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কুমুদিনী ওয়েলফেরার ট্রাস্ট অব বেঙ্গলের আওতাভুক্ত হয়। নিজের স্বার্থ নয়, মানুষের কল্যাণকে বড় করে দেখার মানসিকতা থেকেই তার ব্যবসা পরিচালিত হতে থাকে।’৭১সালে হানাদার বাহিনী ধরে নেওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এই ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

কোনো ব্যক্তি স্বার্থের আশা নয়, কর্মকেই জীবনের ব্রত হিসেবে নিয়েছিলেন। নিম্নবিত্তের সন্তান হয়েও জীবনে কঠোর পরিশ্রম করে যে বিশাল সম্পদ তিনি অর্জন করেছিলেন তার সবটুকুই অকাতরে বিলিয়ে গেছেন। সম্পদ তিনি নিজের জন্য অর্জন করেননি, করেছেন মানুষের কল্যাণে ব্যয় করার জন্য। জীবনে ব্যক্তি থেকে প্রতিষ্ঠানে এবং প্রতিষ্ঠান থেকে এক নির্মোহ মহৎ মানুষে পরিণত হয়েছিলেন তিনি।

সংস্কারমুক্ত সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখতেন রণদা প্রসাদ সাহা। এ কারণেই শহর থেকে দূরে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরকে কর্মস্থল হিসেবে বেছে নেন। অতঃপর মির্জাপুর গ্রামের প্রভাবশালী তালুকদার সতীশ চন্দ্র পোদ্দারের মেয়ে কিরণবালা দেবীকে বিয়ে করে করেন। কিরণবালা দেবী ছিলেন রণদা প্রসাদের সুযোগ্য সহধর্মিণী। মানুষের কল্যাণে নিবেদিত ছিলেন তিনিও। ১৯৩৮ সালে কুমুদিনী হাসপাতালের শোভা সুন্দরী ডিসপেন্সারির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের সময় কিরণবালা ২০০ ছাত্রীর জন্য একটি আবাসিক বালিকা বিদ্যালয় ভারতেশ্বরী হোমসের ভিত্তিপ্রস্তরও স্থাপন করেন।

একটি সমাজের উন্নতির জন্য পুরুষের পাশাপাশি নারীদেরও এগিয়ে নেওয়ার জন্য ১৯৪৪ সালে মির্জাপুরের মতো গ্রামেও পাশ্চাত্য ভাবধারায় গড়ে তুলেছিলেন ভারতেশ্বরী হোমসকে, যা ছিলো বিরাট চ্যালেঞ্জ। যোগেন্দ্র চন্দ্র পোদ্দারের (সম্পর্কে রণদার কাকা) বাড়ির আঙিনায় শুরু হয়েছিল এ স্কুল। তারপর ধীরে ধীরে এ স্কুল আদর্শ এক বিদ্যাপীঠে পরিণত হয়েছে। প্রথা ও কুসংস্কারের জালে বন্দি নারীদের শিক্ষিত করার চ্যালেঞ্জ নিয়ে এবং সমাজপতিদের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে টাঙ্গাইলে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কুমুদিনী মহিলা কলেজ। এটিই দেশের প্রথম আবাসিক মহিলা ডিগ্রি কলেজ। নারী সমাজের উন্নয়নেই যে তিনি কেবল মনোযোগী ছিলেন তা নয়, নারীশিক্ষার পাশাপাশি পুরুষদের জন্য তিনি মানিকগঞ্জে তার বাবার নামে প্রতিষ্ঠ করেন দেবেন্দ্র কলেজ।

রণদা প্রসাদ অনুভব করেছিলেন শিক্ষার অভাবের মতো চিকিৎসার অভাব গ্রামের মানুষের জীবনে প্রবল। চিকিৎসার অভাবে অনেককেই মরতে দেখেছেন তিনি। মায়ের মতো অনেক নারীর অকাল মৃত্যু তার মনে স্থায়ী প্রভাব ফেলেছিলো। তাই গ্রামের মানুষের সুচিকিৎসার জন্য তিনি মায়ের নামে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কুমুদিনী হাসপাতাল। তৎকালীন সময়েই এটি ছিল দেশের হাতেগোনা উন্নত চিকিৎসার সুযোগ সমৃদ্ধ হাসপাতালগুলোর একটি। মাত্র ২০ শয্যা নিয়ে ১৯৪৪ সালে যাত্রা শুরু হয় এই হাসপাতালের। পরবর্তীতে ৭৫০ শয্যার হাসপাতালে উন্নীত হয়। দেশের দূর-দূরান্তের গরিব রোগীরা চিকিৎসা পাওয়ার আশায় আসে এ হাসপাতালে। একসময় এখানে সম্পূর্ণ বিনা খরচে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হতো। বর্তমানে বিশেষ ক্ষেত্রে চিকিৎসার জন্য সামান্য অর্থ নেওয়া হয়।

রণদা প্রসাদ সাহা ছিলেন সংস্কৃতি প্রাণ একজন মানুষ। অন্যের মধ্যে শিল্প ও সংস্কৃতির গুণ দেখলে তিনি যেমন তা উস্কে দিতেন, তেমনি নিজেও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন। শুরু থেকেই ভারতেশ্বরী হোমসে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন তিনি। ১৯৪৮ সালে মির্জাপুরে বিপুল উৎসাহ নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন সৌখিন নাট্যসংঘ ও মঞ্চ। এমন আধুনিক মঞ্চ তখন পূর্ববাংলার রাজধানী ঢাকায়ও ছিল না। তিনি নিজেও অভিনয় করতেন।

১৯৭১ সালে ৭ মে রণদা প্রসাদ সাহা ও তার পুত্র ভবানী প্রসাদ সাহা রবিকে ধরে নেয়ার পর থেকেই শোকে শয্যাশায়ী হন তার স্ত্রী কিরণবালা দেবী। শেষ জীবনে তিনি নির্বাক হয়ে যান। দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী থাকার পর ১৯৮৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পরলোকগমন করেন তিনি।

উল্লেখ্য,দানবীর রণদা প্রসাদ সাহার হত্যাকারী মওলানা ওয়াদুদ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই স্থানীয় লোকদের হাতে প্রকাশ্যে নিহত হয়। তার এক ছেলে রাজাকার মান্নান অস্বাভাবিকভাবে মারা যায়। অপর রাজাকার ছেলে মাহবুব যুদ্ধাপরাধী হিসেবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার আগেই জেলে মারা যায়।

ঢাকা/টিপু

সর্বশেষ