ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ৫৪ বছর

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৪৬, ৩ জানুয়ারি ২০২২   আপডেট: ১৩:০৭, ৩ জানুয়ারি ২০২২
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ৫৪ বছর

শেখ মুজিব আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জেলখানা থেকে ট্রাইব্যুনালে যাচ্ছেন

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়েরের ৫৪তম বার্ষিকী আজ। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানে দায়ের করা একটি রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা। এই মামলাকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে ঊনসত্তরের গণ-অভ্যূত্থান। স্লোগান ওঠে ‘কারার প্রাচীর ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব’। 

এই মামলা ও মামলা থেকে সৃষ্ট গণ-আন্দোলন বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণাকে জাগ্রত করেছিলো। 
 
মামলাটি দায়ের করা হয়েছিলো ১৯৬৮ সালের ৩ জানুয়ারি। মামলায় অভিযোগ করা হয়, শেখ মুজিব ও অন্যরা ভারতের সঙ্গে মিলে পাকিস্তানের অখণ্ডতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন। কথিত ষড়যন্ত্রটির শুরু ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায়।

মামলাটি দায়ের করার আগে ১৯৬৭ সালের ৯ ডিসেম্বর থেকে ১৯৬৮ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত সেনা, নৌ, বিমান বাহিনী, রাজনৈতিক এবং সরকারি কর্মকর্তা মিলিয়ে প্রায় দেড় হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়। এদের মধ্য থেকে ৩৫ জনকে আসামি করে তাদের বিরুদ্ধে ১০০টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উল্লেখ করে মামলা দায়ের করে তৎকালীন সরকার।  শেখ মুজিবুর রহমানকে করা হয় ১ নম্বর আসামি। বাকি ৩৪ আসামির সবাই ছিল সামরিক বাহিনীর সদস্য।

৬৮'র ৬ জানুয়ারি ২৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। একই অভিযোগে আগে থেকেই জেলে আটক থাকা শেখ মুজিবকে মুক্তি দিয়ে ১৭ জানুয়ারি পুনরায় গ্রেপ্তার করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে সামরিক হেফাজতে নিয়ে যাওয়া হয়।

বঙ্গবন্ধু তার জবানিতে বলেছিলেন- প্রায় ২১ মাস আটক রাখিবার পর ১৯৬৮ সালের ১৭/১৮ তারিখে রাত ১টার সময় আমাকে তথাকথিত মুক্তি দেওয়া হয় এবং কেন্দ্রীয় কারাগারের ফটক হইতে কতিপয় সামরিক ব্যক্তি দৈহিক বল প্রয়োগ করিয়া আমাকে ঢাকা সেনানিবাসে লইয়া আসে এবং একটি রুদ্ধ কক্ষে আটক রাখে। আমাকে বহির্জগৎ হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া নির্জনে রাখা হয় এবং কাহারো সহিত সাক্ষাৎ নিষিদ্ধ করা হয়।  আমাকে খবরের কাগজ পর্যন্ত পড়িতে দেওয়া হইত না, বিশ্ব হইতে সকল যোগাযোগবিহীন অবস্থায় এইভাবে আমাকে দীর্ঘ পাঁচ মাসকাল আটক থাকিতে হয়। এই সময় আমাকে অমানুষিক-মানসিক নির্যাতন সহ্য করিতে হয় এবং আমাকে সকল প্রকার দৈহিক সুযোগ-সুবিধা হইতে বঞ্চিত রাখা হয়।

১৯ জুন মামলাটির শুনানি কার্যক্রম শুরু হয়। 

বীরত্বপূর্ণ সশস্ত্র বিদ্রোহের ১৭নং অভিযুক্ত সার্জেন্ট জহুরুল হক এবং ১১নং অভিযুক্ত ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হককে কারাগারের ভেতরে গুলি করা হয়। পরে তাদের সিএমএইচ-এ নিয়ে যাওয়া হয়। সেসময় সেখানে কর্মরত ডা. এম. এম আলীর বর্ণনা ছিল এমন- ‘দুজনের অবস্থাই ছিল সঙ্কটাপন্ন। তাই জরুরিভিত্তিতে তাদের অপারেশন করানোর প্রয়োজন ছিল কিন্তু তার একার পক্ষে দুটি অপারেশন একসাথে করা সম্ভব ছিল না। তাছাড়া সেখানে প্রয়োজনীয় সুবিধাও ছিল না। তাই তিনি কর্তৃপক্ষকে একজনকে অন্য কোথাও অপারেশনের ব্যবস্থা করতে বলেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তাকে জানিয়ে দেয় এটা সম্ভব নয়, যা করতে হয় এখানেই করতে হবে। তিনি প্রথমে ফজলুল হকের কাছে গেলে সে সার্জেন্ট জহুরুল হককে প্রথমে অপারেশনের কথা বলেন। জহুরুল হকের কাছে গেলে সে ফজলুল হককে প্রথমে অপারেশনের করতে বলেন।’

বিদ্রোহীদের মনোবল এতই দৃঢ় ছিল যে, মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও তারা বন্ধুত্ব অক্ষুন্ন রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ফজলুল হক ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেও সার্জেন্ট জহুরুল হকের মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে বিক্ষুব্ধ জনতা রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন ও অন্যান্য ভবনে অগ্নিসংযোগ করে। অতিথি ভবনে অবস্থানরত ট্রাইব্যুনালের প্রধান বিচারপতি এস.এ. রহমান এবং সরকারের প্রধান কৌসুলী মঞ্জুর কাদের পালিয়ে গিয়ে জীবন রক্ষা করেন। 

এরপর ২০ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে আসাদ, ২৪ জানুয়ারি মতিউর এবং ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহা শহীদ হন। এই অভ্যূত্থানে সমগ্র বাংলাদেশে প্রায় ৫৮ জন দেশপ্রেমিক বাঙালি শহীদ এবং শত শত মানুষ আহত হন। পাকিস্তান সরকার জনরোষ থেকে বাঁচতে মামলার ১নং অভিযুক্ত বঙ্গবন্ধুসহ বাকি ৩৩ অভিযুক্তকে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।  প্রেসিডেন্ট আয়ুব খান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।  ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ তৎকালীন রের্সকোর্স ময়দান বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশাল জনসভায় সমবেত জনতার পক্ষ থেকে শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন।

ঢাকা/টিপু

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়