মাগফিরাতের জন্য ঈমান বিশুদ্ধ করতে হবে
মাগফিরাত তো বটেই সব আমলের জন্যই ঈমান বিশুদ্ধ করা আবশ্যক। ঈমান অশুদ্ধ হলে বা ঈমানে সমস্যা থাকলে কোনো আমলই গ্রহণযোগ্য হবে না। সাধারণভাবে ঈমান বলতে বোঝায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা কিছু নিয়ে এসেছেন তার সবগুলোর ওপরে একত্রে ও সম্মিলিতভাবে ঈমান আনতে হবে। এটাকে ঈমানে মুজমাল বলা হয়।
‘আমি ঈমান আনলাম সর্বসুন্দর নামধারী ও সর্ববিদ গুণের অধিকারী আল্লাহ তাআলার প্রতি এবং মেনে নিলাম তাঁর সকল আদেশ ও বিধানাবলি।’
এই সামগ্রিক মেনে নেয়ার ঘোষণার পরে বিস্তারিতভাবে যতটুকু সম্ভব হয় ঈমানের বিভিন্ন দিক জানা ও মান্য করা আবশ্যক। একইসঙ্গে ঈমানের কিছু দাবি আছে। অর্থাৎ আমরা যে ঘোষণা দিলাম তার প্রতিফলন আমাদের কাজে ও কর্মে ঘটাতে হবে।
ঈমানের প্রধান বিষয় হলো মহান আল্লাহ তায়ালার একাত্ববাদের ওপরে বিশ্বাস করা। আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়। তিনিই এককভাবে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। সার্বভৌমত্ব এককভাবে তারই। তিনিই আইনদাতা, তিনিই পালনকর্তা, শাসনকর্তা এবং তিনিই সর্বোচ্চ ক্ষমতাশালী। মানুষ তার প্রতিনিধি হিসেবে দুনিয়াতে শাসন করে, প্রতিপালন করে এবং তাঁরই দেয়া সম্পদ সাময়িক ভোগ করে।
মহান আল্লাহ সম্পর্কে উপরিউক্ত বিবৃতির সঙ্গে কোনো মুসলমান দ্বিমত পোষণ করবেন না। করলে তার ঈমান থাকবে না। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় ঈমানের এই অংশের সঙ্গে এক ধরনের সাংঘর্ষিক অবস্থান দেখা যায়। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় আল্লাহ ব্যাতিত অন্যদের সার্বভৌমত্বের মালিক বলে দাবি করা হয়। যেমন গণতান্ত্রিক ধারণায় জনগণকে সার্বভৌম বলা হয়। জনতার ইচ্ছাকে পরম ও চূড়ান্ত বলা হয়।
একজন মুসলমান হিসেবে এই জায়গায় আমাদের বোঝাপড়া খুবই পরিষ্কার থাকতে হবে। কোনো মুসলমান যদি আল্লাহর বিপরীতে অন্য কাউকে বা অন্য কিছুকে সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস বলে মনে করে তাহলে তার ঈমান থাকবে না।
এখন প্রশ্ন তৈরি হবে যে, বাংলাদেশে আমরা যারা মুসলমান আছি তাদের ঈমানের কী অবস্থা? এই ক্ষেত্রে বোঝার হলো, দেশের প্রায় ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান। তারা মহান আল্লাহকে তাদের প্রতিপালক হিসেবে মেনেছে। এবং প্রতিদিন তাঁর সামনে মাথা নত করছে, তাঁর আদেশ মেনে দিনভর উপোষ থাকছে, তাঁর কাছে রোনাজারী করছে। এসব কিছু প্রমাণ করে যে, বাংলার মুসলমান মনেপ্রাণেই মহান আল্লাহকে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ও সার্বভৌম বলেই বিশ্বাস করে ও মান্য করে।
তাহলে গণতন্ত্রের দর্শনমতে ‘জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস’ এর পরিপ্রেক্ষিতে অবস্থান কী হবে? এই ক্ষেত্রে ব্যাখ্যা করা হবে যে, এখানে প্রতীকি অর্থে, আপেক্ষিকভাবে এবং দ্বিতীয় কর্তা হিসেবে জনগণকে ক্ষমতার উৎস বলা হয়েছে। এবং এখানে ‘সকল’ বলতে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বকে বা কারা পাবে তা নির্ধারণের ক্ষমতার কথা বলা হয়েছে; তাও দ্বিতীয় কর্তা হিসেবে। সামগ্রিক ক্ষমতার কথা না। এবং এখানে আল্লাহর ক্ষমতার বিপরীতে জনগণের ক্ষমতার কথা বলা হয়নি বরং কোনো অশুভ শক্তি বা কোনো রাজার বা কোনো বিদেশি শক্তির বিপরীতে জনগণের ক্ষমতার কথা বলা হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো, এই ধরনের ব্যাখ্যা কেন করা হবে? কারণ দুইটি পরস্পরবিরোধী বক্তব্যকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। দেশের কোটি কোটি মুসলমান নিজেদের ঘোষণায়, প্রতিদিনের কাজে কর্মে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের প্রতি স্বীকৃতি দিচ্ছে। আবার বাহ্যত আল্লাহ সার্বভৌমত্বের বিরোধী একটি বক্তব্যও পাওয়া যাচ্ছে। এখন একটি বাক্যকে কেন্দ্র করে কোটি কোটি মুসলিমকে তাকফির না করে এই ধরনের বাক্য ব্যাখ্যা করা শ্রেয় এবং সত্য হলো বাংলাদেশের মানুষ আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করে না।
এই ধরনের ব্যাখ্যার নজীর ইসলামী জ্ঞানতত্ত্বে আছে। যেমন কোনো মুসলমান যদি বলে, ‘বসন্ত ফুল ফুটিয়েছে’। তাহলে কোনো বিধানমতেই তাকে তাকফির করা যাবে না। কারণ এখানে অবধারিতভাবেই সে দ্বিতীয় কর্তা হিসেবেই বসন্তকে উল্লেখ করেছে। আমাদের জীবনেও আমরা হরহামেশা এমন বাক্য ব্যবহার করি। ‘বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর এসেছে’, ‘এই খাবারটা খেয়েই পেট খারাপ করেছে’। এখানে বৃষ্টি বা কোনো খাবারের ক্ষমতা নাই কিছু করার। আল্লাহই সকল ক্ষমতার উৎস। তারপরেও এমন বাক্যে কুফুরি হবে না। কারণ বৃষ্টি বা খাবারকে দ্বিতীয় কর্তা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
ঠিক তেমনি ‘জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস’ এই বাক্যেও জনগণকে দ্বিতীয় কর্তা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এই বিষয়ে মুসলমানদের ধারণা পরিষ্কার হতে হবে এবং এমন বাক্য থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখতে হবে যা বাহ্যত হলেও আল্লাহর সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধ বলে মনে হতে পারে। কারণ ঈমানে কোনো সমস্যা দেখা দিলে আমার আপনার কোনো আমলই গ্রহণযোগ্য হবে না।
মাগফিরাতের এই শেষ দিকে আসুন আমরা আমাদের ঈমান বিশুদ্ধ করি। সব ধরনের সন্দেহ ও ধোঁয়াশাপূর্ণ জায়গা থেকে বেঁচে থাকি।
শাহেদ//