ঢাকা     সোমবার   ০৬ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২৩ ১৪৩১

বাঘের সঙ্গে বসবাস

আঁখি সিদ্দিকা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:৫৮, ২৯ জুলাই ২০২৩   আপডেট: ১৯:৪৭, ২৯ জুলাই ২০২৩
বাঘের সঙ্গে বসবাস

ছ‌বি: সঞ্জয় ভট্টাচার্য

বৃষ্টিবহুল, উপমহাদেশের প্রধান নদীগুলোর মোহনা হওয়ায় বাংলা পৃথিবীর অন্যতম প্রধান ঊর্বর এলাকা। আকারে ছোট হলেও এখানে তিন ধরনের বন গজিয়ে উঠেছে। শালের জঙ্গল, মিশ্র বৃষ্টিপাতের জঙ্গল আর ম্যানগ্রোভ জঙ্গল। ফলে এ এলাকা পাখি, সরীসৃপ ও স্তন্যপায়ী প্রাণীর অভয়ারণ্য অনেক আগে থেকেই। ব্রিটিশ সিভিলিয়ানরা একবাক্যে বলেছেন, বাংলাদেশে এমন কোনো এলাকা ছিল না যেখানে বাঘ ছিল না (হাতিয়া, সন্দ্বীপ বাদে)। সমগ্র বাংলাদেশের কৃষককে বাঘের সঙ্গে দেশ ভাগ করে নিতে হয়েছে। সিভিলিয়ানদের বিবরণীতে পাওয়া যায়, ডোরাকাটা বাঘ সাধারণত ক্ষেত খোলা বা গ্রামীণ জঙ্গলে খুব একটা আসত না। এরা একটা নিরবচ্ছিন্ন বনভূমি পছন্দ করত।

২৪ জুলাই, ২০২৩-এ সুন্দরবনের ঢেংমারী গ্রামের শ্রীপতি বাছার দাদার সঙ্গে কথা হচ্ছিল বাঘের সঙ্গে তাদের বসবাস নিয়ে। তিনি বলছিলেন অভিজ্ঞতার কথা।   
‘আমরা এই বনে, এই গ্রামে তো বসবাস করছি, কিন্তু আমার দাদার বাবারা কিন্তু প্রথমে এইখানে ছিল না।  আমরা বেশির ভাগ ছিলাম ইন্ডিয়ার ওই দিকে- বর্ডার এলাকায়। কিন্তু ওখানে তখন একবার অজন্মা হলো (ফসল হচ্ছিল না)। ছেলেমেয়েদের কীভাবে বাঁচায়! তখন নৌকায় ভাসতে ভাসতে এখানে চলে আসলো।  নৌকা ধরে ডাঙ্গায় উঠে বন কাটা শুরু করলো। বন তো এমন ছিল না- সেইরকম বাঘ, কুমির সাপ সব ছিল ঘন বনে। তখন বন কেটে বসতি শুরু করলো। তবে এভাবে মাটিতে ঘর করা যেত না। টং করে থাকতে হতো। বন যে যতটা কাটবে তার ততটা জমি।’

‘আমার বয়স তখন ১২ বা ১৩। বাঘের ভয়ে বাইরে যেতে পারতাম না। সব কিছুর ভয়! বাঘ, কুমির, সাপ এমনকি নাম জানা কত প্রাণী! রাস্তা ছিল না। কয়েকটা পরিবার মিলে দল হয়ে থাকতে হতো। আমার ঠাকুরদা বাজুয়ার বাজার থেকে ফিরছিল সন্ধ্যা বেলায়। বাড়ির ঘাটে নৌকা ভেড়াল আর কোথা থেকে বাঘ এসে আক্রমণ করল, খেলো না। ফেলে গেল কিন্তু তাকে আর বাঁচানো গেল না। আমার ঠাকুমা এই দৃশ্য দেখে কাঁথা মুড়ি দিয়ে সেই শুলো। আসলো তার জ্বর। পরদিন সকালে মরা গেল। শুধু বাঘের ভয়েই সে মরে গেল।  আমার বাবার চাচীও বাঘের ভয়ে মারা গেছেন- বাঘ এলাকায় ঢুকেছে এই খবর পেয়ে।’

একসঙ্গে বসে বাঘের গল্প শোনা

‘এ বছরও তো  বাঘ দেখা গেছে। আমার ভাইরা মৌয়াল। ওরা মধু কাটতে কেবল বনে উঠবে, ওই কানুর খালে তখনই গায়ের ওপর এসে পড়েছে। পড়তে গিয়ে নিজেই আরেক গাছের গায়ে বাড়ি খেয়ে নিচে পড়ে গেছে। ওরা তখন দৌড়ে নৌকায় উঠে পালিয়েছে। এখনও আমার ভাই কানে শোনে না। বাঘের হুংকারে কানে তালা ধরে রইছে।’

‘এই ঢেংমারী গ্রামে সর্বশেষ আক্রান্ত ব্যক্তি দেবেন। ওর একটা কান নেই। ওরা তিনচারজন কাঠ কাটতে গিয়ে শিকার হয়েছে। ওরা শুকনো একটা গাছ পেয়ে কাটতেছিল, এর মধ্যে আক্রমণ করেছে। ওদের মধ্যে তিনজন গাছে উঠে গেছে, দেবেন আর উঠতে পারেনি। দেবেনরে উঁচু করে ধরে শূন্যে যখন তুলেছে তখন গাছের ওপর থেকে একজন বাঘের পিঠের ওপর কুড়োল মেরেছে। তখন বাঘ দেবেনরে ছেড়ে বনের দিকে পালিয়েছে। দেবেন বেঁচেছে। দেবেন এখন গান গেয়ে পয়সা রোজগাড় করে, আর বনে যায় না।’

‘ক্ষুর্ধাত না হলে বাঘ আক্রমণ করে না। বাঘ কিছুটা বেখেয়ালী। আপনি পাশ থেকে হেঁটে যাচ্ছেন ও দেখবেও না। কিন্ত ১০ জনের মধ্যে আপনাকে দূর থেকে টার্গেট করলে ও ঠিক আপনাকে ধরে ফেলবে। এই তো ৫-৬ বছর আগের কথা- এক বাঘ নিয়মিত এই গ্রামে আসতে লাগল। বাঘটা লোকালয়ে ১১ মাস আমাদের বিরক্ত করেছে। প্রতিরাতে এই জঙ্গল থেকে নদীপার হয়ে গ্রামে ঢুকতো। তার আধার ছিল কুকুর, ছাগল, ভেড়া। কোনোদিন মানসের (মানুষ) দিকে তাকায়নি, এমনকি গরুও নেয়নি। সে খুঁজে নিতো কুকুর, ছাগল। তখন আমরা আতঙ্কে ঘরে দরজা দিয়ে থাকতাম। সাধারণত রাত ৮ থেকে ৯টার মধ্যে ও ঢুকতো নিয়ম করে। খাবার একটা পেলে সাথে সাথে মুখে করে আবার নদী পার হয়ে এই জঙ্গলে বসেই খেতো। আবার পরদিন একই কায়দায় ও গ্রামে ঢুকতো। এভাবে ১১মাস চলেছে। ও সুস্থ বাঘ। ও দাবড়ে ধরে হরিণ খেতো। ও মারা পড়লো খুব ইন্টারেস্টিংভাবে। সে আমরাও অবাক হই! ও করেছে কি, কুকুর একটা খেয়ে, সেদিন গ্রামেই এক লিচির পাড়ে (খাল) বসে খেয়েছে, খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ও বুঝতে পারেনি যে রাত পোহায়ে প্রভাত হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে লিচির পাড় ধরে একজন যেতে গিয়ে দেখে যে কুকুরের হাড়গোর ছড়ানো। তখন সে কয়েকজন ডেকে এনে দেখে বাঘ ঘুমাচ্ছে। তখন ওখানে কিছু ঝাকালো ঝাকালো কুল গাছ ছিল। কুল গাছের ঝোঁপের মধ্যে ও ছিল। ওই সময় আমন ধানের সময় ছিল। আমন ধানের ক্ষেত জোড়া পানি আর পানি। ওই ধানক্ষেতের মধ্যে ছিল কারেন্ট জাল পাতা। ওই জালে মাগুর, শিং বাধে। ও তো তা জানে না। তখন পালিয়ে যাওয়ার সময় ওই জালে আটকা পরে। কিন্তু রাস্তায় লোকও অনেক জমেছে। সবাই বাঘ খুঁজছে। হঠাৎ বাঘ ওই জালের ভেতর থেকে লাফ দিয়ে এসে একটা  ছেলের হাত কামড়ে ধরেছে। তখন সব লোকজন ওকে পিটিয়ে মেরেছে। ছেলেটাকে বাঁচাতে হবে তো! কোস্টর্গাডে কিন্তু খবর দেয়া হয়েছিল, আসছিলও তারা। কিন্তু তার আগেই এই ঘটনা।’

হিমাংশু দাদা 

‘এই ঘটনা আমাদের গ্রামের না, পাশের ঘাগড়ামারী গ্রামের। ওরা চারজন। দুজন পুরুষ দুইজন মহিলা। মাছ ধরছিল জাল ফেলে। পানিতে তিন-চারঘণ্টা থেকে ক্লান্ত হয়ে ওরা ভাবলো পান বিড়ি খেয়ে নেবে। এ জন্য ওরা বনের দিকেই বসে খাচ্ছিল। ওদের ভেতর একজন পুরুষ মানুষ একটু সাইডে চলে গেছে, এই দশ বারো হাত দূরে। তখন বাঘ এট্যাক করেছে। তখন একটা পুরুষ ও একটা মহিলা ভয়ে পানিতে লাফ দিয়েছে। কিন্তু বাঘ এদিকে যাকে ধরেছে তাকে মুখে জুতসুই বসিয়ে দৌড় দেবে সেই চেষ্টা করতেছে। তখন একটা মহিলা গরানের ডাল এনে বাঘের পিঠে এমন বাড়ি দিয়েছে যে বাঘ ওকে ছেড়ে দিয়ে দৌড়।’

‘আসলে বাঘ আমাদেরই প্রতিবেশী। ওদের সঙ্গে সখ্যতা করে, বুঝেশুনেই থাকতে হয়। এই জঙ্গলটাই ওদের বাড়ি। ওদের বাড়ি ওরা কোথায় থাকবে তাতো বলে থাকবে না। ওদের বাড়ির পাশে আমরা ঘর করেছি, তাই আমাদেরই বুঝে থাকতে হবে।’ 

বাঘ প্রধানত প্রকৃতি নির্ভর প্রাণী হলেও বেড়ে ওঠার অনেক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয় বলে তাকে যথেষ্ট বুদ্ধিমান হতে হয়। একই জঙ্গলে বাস করা বাঘের চেয়ে প্রখর ইন্দ্রিয়ের, কখনো কখনো দ্রুতগামী প্রাণী বাঘ শিকার করে শুধু দাঁত-নখ দিয়ে। বাঘ বন্দুক দিয়ে শিকার করে না, দৌড়ে ধরার মতো দূরপাল্লার দৌড়বিদের মতো তার দেহের গড়নও নয়। তার গন্ধ নেওয়ার ক্ষমতা খারাপ। এই অবস্থায় গড়ে প্রায় ২০ বার শিকারের পিছু নিয়ে মাত্র একবার সে সফল হয়। সফল হতে হলে শিকারের খুব কাছে গিয়ে তাকে চমকে দিতে হয়। শিকার চমক কাটিয়ে ওঠার আগেই বাঘকে শিকার ধরে ফেলতে হয়। সময়ের সামান্য হেরফেরে বাঘকে উপোস থাকতে হয়।

বাঘের মনস্তত্ত্ব এখনো মানুষ আবিষ্কার করতে পারেনি। তবে কিছু আচরণের খোঁজ পেয়েছে। মানুষখেকো বাঘ যদি জঙ্গলের আড়ালের মানুষের সাড়া পায় তাহলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানুষটি মারা পড়ে। বাঘটি মানুষখেকো না হলে এবং লোকালয়ের আশপাশে চলাচলে কিছুটা অভিজ্ঞ হলে গাছপালার আড়াল নিয়ে কিছুটা এগিয়ে এসে স্বাভাবিক ঔৎসুক্যে দেখতে চায়- কে এলো? কিন্তু জঙ্গলের পথে মানুষ ও বাঘের সামনাসামনি দেখা হয়ে গেলে পরিস্থিতি অন্য রকম হয়। বাঘ কিছুতেই পিছু হটবে না। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবে। অপছন্দ হলে লেজ নাড়বে। ধমকানো হাঁক দেবে। বাচ্চা সঙ্গে থাকলে কিছুটা এগিয়ে আসবে, আবার পেছাবে। বাঘ মরা জীবজন্তু পাহারায় থাকলেও একই কাজ করবে। 

রাজলক্ষ্মী মাসী ও বিজন কাকা 

মনে পড়ে ২০০৬ সালের কথা। একটা রির্সাচের কাজে কয়রার বানিয়াখালী এলাকায় তিনমাস ছিলাম। হড্ডা নদীর পাড়ে বিজন কাকু ও রাজলক্ষী মাসী থাকতেন তাদের জ্ঞাতি নিয়ে। তাদের ঘরগুলো মাটি থেকে ফুট চারেক উঁচু গেউয়ার বল্লির ওপর তোলা মাচাঘর। ঘরের সামনের দিকটায় খোলা মাচা। পেছনের ঘরটি এত ছোট যে সেখানে দু-তিনজনের বেশি মানুষের স্থানসংকুলান হওয়ার কথা নয়। বিজনকাকু রাতে ঘুমান ওখানে আর বাইরের খোলা মাচায় ঘুমান অন্য মৌয়ালরা। অন্য মাচাটিতে পরিতোষ কাকু থাকেন। তিনি আবার মাছ ধরেন। 

বনের বিভিন্ন এলাকা থেকে মাছ ধরে এই বানিয়াখালীর লঞ্চ জেটির ওপর সবাই রাখতো। আর দাদনদাররা এসে খুলনায় লঞ্চে মাছ নিয়ে যেতো। দাঁড়কাক, পাতিকাক, শঙ্খচিল, ভুবনচিল ফাঁক পেলেই এই মাছের স্তূপের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। আমি দেখতাম আর গা ছমছম করতো, এই মাছের গন্ধে আবার বাঘ বেরিয়ে আসবে না তো!
প্রায়ই দেখতাম বিজন কাকুর সেই ঘরের পাশে বাঘের পায়ের তাজা ছাপ। বাঘ রাতে এ পথে হেঁটেছে, বিজন কাকুর ঘর থেকে মাত্র চার-পাঁচ ফুট তফাত দিয়ে। এদিকটায় বাঘ আসে শিকারের খোঁজে। কাকুর বাড়ির সামনে যে ফাঁকা মাঠের মতো এলাকা, সেখানে রাতে হরিণের দল আশ্রয় নেয়। আর এখানকার গেউয়াবনের আড়ে আড়ে বাঘ ঘোরে হরিণের আশায়। বাঘ ইচ্ছা করলেই বিজনকাকুর বারান্দায় যারা ঘুমান, তাদের যে কাউকে তুলে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু কখনো তা করেনি। যারা প্রতিদিন কাজ করে তাদের বাঘ দেখে কিন্তু কিছু বলে না। আমি একটি খালের নাম দিয়েছিলাম মায়া খাল। অসম্ভব সুন্দর! সেই খালে জেলেরা সেখানে ছোট ছোট নৌকায় রাত কাটান। বাঘ তাদেরও কখনো ধরার চেষ্টা করেনি।

কচিখালীতে সুপতি নদীর মোহনার পশ্চিম পাড়ে ১২৫টি ঘর তুলে হাজারখানেক জেলে বাস করতেন। তাদের একজন শুধু রাতের বেলা বন অফিসের পুকুর থেকে জল আনতে গিয়ে বাঘের থাবড়া খেয়েছিলেন। কিন্তু বাঘ কাউকে কোনো দিন ধরেছে বলে শুনিনি। কটকা মাঠে, কচিখালীর মাঠে প্রায় সারা বছর জঙ্গলের ভেতর ঘর তুলে শ দুয়েক ঘাসুড়ে ঘাস কাটেন। নিত্যদিন বাঘ তাদের দেখে, কিন্তু কখনো ধরার চেষ্টা করেনি।

১৯৯৫ সালের এই ঘটনাটি হিমাংশু দাদুর মুখে শোনা: বাঘের আক্রমণে মুখের অর্ধেক অংশ বিশ্রীভাবে নষ্ট হয়ে যায় হাসমতের। চেহারা এত ভয়ংকর ছিল যে, বিয়ে করা তো দূরে থাক ভয়ে তার সামনে কেউ আসত না। তবে না, হাসমতের বিয়ে হলো। হাসমতের স্ত্রী নিজের ভাষায় জানালেন এমন ভয়ঙ্কর চেহারার কাউকে বিয়ে করার পর তার অনুভূতির কথা।

ছ‌বি: সঞ্জয় ভট্টাচার্য

‘আমাদের বিবাহিত জীবনের প্রথম দিকে আমি মেনে নিতে পারিনি যে আমার স্বামীর অর্ধেক চেহারা নেই। বিয়ের প্রথম রাতে আমি তাকে আমার থেকে দূরে থাকতে বলি। সে আমার সিদ্ধান্তকে সম্মান জানিয়ে আমার থেকে দূরে থাকতো। কারণ আমি তাকে ভয় পেতাম। তারপর দিন দিন সে আমার প্রতি তার ভালোবাসা প্রকাশ করতে থাকে। এত বছরে সে একবারও আমাকে ছাড়া রাতের খাবার খায়নি। তার ভালোবাসা, শ্রদ্ধা এবং সমবেদনায় তার প্রতি আমার অনুভূতি পাল্টে যায়। আমি দেখতে পাই সে মন থেকে কত সুন্দর! আমি এই অর্ধ চেহারার মানুষটাকে ভালোবাসি।’

এই সুন্দর মনের নারীর নাম জিজ্ঞেস করা হলে তিনি নিজের নাম বলতে রাজি হননি। লাজুক হাসিতে গর্বের সঙ্গে তার ভালোবাসার পরিচয়ই তুলে ধরলেন। বললেন- আমার পরিচয়, আমি বাঘে কামড়ে রেখে যাওয়া হাসমতের বউ।

পরিতোষ কাকার কথা বলছিলাম। সুন্দরবনের গ্রাম ঘাগড়ামারি। সেখানেই চারজন নিয়ে সংসার তার। এখনও ধানা কাটা, মাড়াই করা, নিজের বাড়ির সকল কাজ পরিতোষ কাকা নিজ হাতে করেন। ছেলেকে পড়াচ্ছেন। বিএল কলেজে। এক ছেলে মধু কাটতে গিয়ে ফেরেনি। তার ভাষায়: ‘বাঘ তারে রাইখে দিয়েছে। বনবিবি তারে ফেরালো না।’ (বনবিবি তাদের বনদেবি) একসময় বাঘ আর নানারকম বিপদ উপেক্ষা করে তিনিও যেতেন মধু কাটতে, মাছ ধরতে, কাকড়া মারতে। প্রাণের ধনরে যখন তিনি (বাঘ) টেনে নিলেন তখন থেকে ওই বনে তিনি ঢোকেন না। 

সুন্দরবন এলাকার আদিবাসীদের সঙ্গে জীবজন্তুর অবস্থান মোটেই সুখের নয়। জঙ্গলের ধার ঘেঁষে এমন কোনো পরিবার পাওয়া যাবে না, যার কোনো সদস্য কখনো না কখনো বাঘের হাতে বা সাপের হাতে প্রাণ হারায়নি। সাপের কামড়ে প্রাণ হারানোকে স্থানীয় লোকজন নিছক দৈব-দুর্বিপাক মনে করে। বাঘের হাতে প্রাণ হারানোকে মনে করে অত্যন্ত গুরুতর ঘটনা। এটা সহজে কেউ মেনে নিতে পারে না। কারণ, বাঘ শুধু মারেই না, মানুষ খেয়ে ফেলে। একটি সাপ দৈবক্রমে কাউকে কামড় দিয়েছে, সে সাপটি আর কাউকে কামড়াতে হন্যে হয়ে চেষ্টা করবে না। কিন্তু যে বাঘ একবার মানুষের মাংসের স্বাদ পেয়েছে, সে তারপর থেকে মানুষ মারার চেষ্টা করেই চলবে; প্রতি সপ্তাহে একজন না একজন মানুষ মারবে। ফলে মানুষ লোকালয়ে সাপকে স্থান দিতে রাজি আছে, বাঘকে নয়।

সুন্দরবন নিয়ে মাঠ পর্যায়ে কাজ করছি বিগত ১৫ বছর। সুন্দরবন রক্ষা নিয়ে বিভিন্ন সাংগঠনিক কাজ, মৌয়ালদের জীবন, পরিবেশ ও প্রকৃতি ছাড়াও সুন্দরবনের শরণার্থীদের নিয়ে। বারবার সুন্দরবন গিয়ে যেটা মনে হয়েছে যে- যার বাড়ি তার খবর নাই পাড়া-পড়শীর ঘুম নাই। সুন্দরবন আসলে বাঘের বাড়ি। সেই বাঘের বাড়ির বাঘ হারাতে বসেছে। তাদেরই অনিশ্চিত জীবন শুরু হয়ে গেছে। একশ বছর আগে পৃথিবীতে বাঘ ছিল এক লাখেরও বেশি। তবে বর্তমানে সে সংখ্যা ৯৫ শতাংশ কমে ৩ হাজার ৯০০টিতে দাঁড়িয়েছে।  বাংলাদেশ বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালের জরিপ মোতাবেক সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ছিল ১০৬টি। তিন বছর পর ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের মাধ্যমে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী সুন্দরবনে ১১৪টি বাঘের অস্তিত্ব চিহ্নিত হয়েছে। 

বাঘের শিকার হাসমত

বাঘ বিশেষজ্ঞদের মতে, বাঘের সংখ্যা দ্রুত কমে যাওয়ার এই প্রবণতা চলমান থাকলে আগামী কয়েক দশকে পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশে বাঘ নিধন ও হরিণ শিকার বন্ধের জন্য ২০১২ সালে অধিকতর শাস্তির বিধান নিশ্চিত করতে বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন প্রণয়ন করা হয়। এই আইনের ধারা ৩৬ অনুযায়ী, বাঘ শিকার বা হত্যা জামিন অযোগ্য অপরাধ। চূড়ান্ত বিচারে বাঘ শিকারী বা হত্যাকারী সর্বোচ্চ ৭ বছর সর্বনিম্ন ২ বছর কারাদণ্ড এবং জরিমানা ১ লক্ষ থেকে ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত অর্থ দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

আজ ২৯ জুলাই, বাঘ রক্ষার শপথ নিয়ে সারা বিশ্বে পালিত হচ্ছে বিশ্ব বাঘ দিবস। প্রতি বছরের মতো এবারও বাংলাদেশও আনুষ্ঠানিকভাবে বাঘ দিবস পালিত হবে। সেই দিনে আমরা শপথ করতেই পারি- ‘সুন্দরবন রক্ষা করি, যত্ন করি আর প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করতে বাঘ বাঁচাই!’

 

তারা//

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়