ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৪ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

শিল্প আছে নেই শিল্পী‍

মোসতাফা সতেজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:১০, ৯ জুলাই ২০১৪   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শিল্প আছে নেই শিল্পী‍

শোলার তৈরি জিনিস। ছবি : মোহাম্মদ আসাদ

মোসতাফা সতেজ : শোলা দিয়ে তৈরি টোপর ছাড়া সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিয়ের অনুষ্ঠান কল্পনা করা যায় না। এ সময় শোলার মালাও ব্যবহৃত হয়। শুধু তাই নয়, শোলার তৈরি বিভিন্ন জিনিস ধর্মাচারের অনুষঙ্গও বটে। শোলার এই টোপর নিয়ে প্রচলিত একটি গল্পও রয়েছে।

দেবতা শিব পার্বতীকে বিয়ে করার সময় শ্বেতমুকুট পরার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। দেবশিল্পী বিশ্বকর্মাকে দায়িত্ব দেয়া হলো মুকুট তৈরি করার। কিন্তু ওরকম মুকুট কীভাবে তৈরি করা যায়- বিশ্বকর্মা যখন এ কথা ভাবছিলেন তখন শিবের ইচ্ছায় জলাশয়ে এক ধরনের গাছ জন্মালো। সেই গাছটিই শোলা গাছ। গাছটির বৈজ্ঞানিক নাম Aeschymene aspera. কিন্তু নতুন করে সমস্যা দেখা দিল। এই গাছ তো অনেক নরম। এমন নরম গাছ দিয়ে মুকুট তৈরি হবে কীভাবে? এ সময় শিবের ইচ্ছায় সেই জলাশয় থেকে এক সুকুমার যুবক উঠে এলো। যুবক নরম শোলা গাছ ব্যবহার করে সুন্দর সাদা মুকুট ও মালা তৈরি করে দিল। সুন্দর মালা তৈরির জন্য সেই যুবক পরে ‘মালাকার’ নামে খ্যাত হয়ে যায়। সেই থেকে যারা শোলা শিল্পের সঙ্গে জড়িত তাদের ‘মালাকার’ বলা হয়।

পুরাণে বর্ণিত এই ঘটনা থেকেই বোঝা যায়, শোলা শিল্প বহু প্রাচীণ একটি শিল্প।  আমাদের দেশের বিভিন্ন জেলায় এক সময় এই পেশার মানুষ দেখা যেত। বর্তমানে এই পেশাজীবীর সংখ্যা অনেকটাই কমে এসেছে। অনেকেই পূর্বপুরুষের পেশা ছেড়ে জীবিকার প্রয়োজনে নতুন পেশা ধরেছেন। এর সরল অর্থ মালাকারদের সেই সুদিন আর নেই। কিন্তু আশার কথা এই যে, শোলা শিল্পের কদর কিন্তু কমেনি। কথায় বলে, আমাদের বারো মাসে তের পার্বণ। বিভিন্ন পার্বণে শোলার তৈরি জিনিসের কদর বেশ বোঝা যায়।  

এক সময় পাবনা সদরেও এই পেশাজীবীরা ছিলেন। কিন্তু বিশ শতকের শেষ দশকে এসে এখানকার শোলা শিল্পীরা কাজ বন্ধ করে দেন। অথচ পূজা-পার্বণ, পুতুল নাচ, বিয়ে থেকে শুরু করে লোকজ অনুষ্ঠানে শোলার কাজের বেশ চাহিদা ছিল। শুধু কী তাই, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মঞ্চ সজ্জায়, মহরমে তাজিয়া তৈরিতে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের শো-রুম থেকে শুরু করে অনেকে  ড্রয়িং রুম সাজাতেও শোলার কারুকাজ ব্যবহার করেন। অর্থাৎ শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠানেই নয়,  সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শোলার ব্যবহার ছিল এবং এখনও আছে। তবে এর ব্যবহার ধীরে ধীরে কমেছে। ফলে বর্তমানে অবস্থা এমন হয়েছে যে, শোলা শিল্পীদের  আর দেখাই যায় না। 

পাবনার শোলা শিল্পী শিবশঙ্কর মালাকারের সঙ্গে যখন আমার কথা হয় তখন তার বয়স ৯০ ছুঁইছুঁই। তার সঙ্গে কথা বলে জেনেছিলাম, তার যৌবনে এ কাজের চাহিদা ছিল। এমনও দিন গেছে চব্বিশ ঘণ্টা কাজ করতে হতো। কিন্তু এখন তার অফুরন্ত অবসর। এটা যে শুধু বয়সের কারণে এমন নয়। কাজ নেই, তাই তার ব্যবসাও প্রায় নেই বললেই চলে।

অন্যদিকে ছেলেমেয়েরাও লেখাপড়া শিখে অন্য কাজে মনোযোগী হয়েছে।

শিবশঙ্কর পাশাপাশি আতশবাজি তৈরির কাজ করতেন। আতশবাজি তৈরি নিষিদ্ধ হওয়ায় তারা আরো বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েন। ফলে বাধ্য হয়েই এক সময় পৈত্রিক এই পেশা ছেড়ে দিতে হয়। তার কাছ থেকেই জেনেছিলাম, পাবনায় শোলা শিল্প কোন মতে টিকে আছে বেড়া ও ফরিদপুর উপজেলায়। বেড়া হাটুরিয়া জগন্নাথপুরের ক্ষিতিশচন্দ্র মালাকার এবং ফরিদপুরের গোপালনগরের রামপদ মালাকার এখনও এই পেশা ধরে রেখেছেন।

শিবশঙ্কর মালাকার কথাপ্রসঙ্গে আরো জানিয়েছিলেন, তার বাবা মাখন লাল ব্রিটিশ আমলে কলকাতায় ইংরেজদের জন্য শোলার তৈরি হ্যাট সরবরাহ করতেন। উনিশ শতকের চল্লিশের দশকে শোলার তৈরি হ্যাট ইংরেজদের কাছে জনপ্রিয়তা লাভ করে। কারণ আগে তারা কাপড় এবং মোটা কাগজের তৈরি হ্যাট ব্যবহার করত। শোলার হ্যাট ওজনে হাল্কা হওয়ায় দ্রুত সমাদৃত হয়। কিন্তু স্বদেশী আন্দোলনের সময় শোলা শিল্প প্রথম ধ্বংসোন্মুখ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। বিদেশি দ্রব্য বর্জনের কারণে রাংতা এবং জরি আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। এগুলো তখন বেলজিয়াম, ফ্রান্স, জার্মানি থেকে আমদানি করা হতো।

১৯৪৮ এর পর শোলা শিল্পের ইতিহাসে যোগ হয় নতুন মাত্রা। মুকুট, কপালী, কৃষ্ণচূড়া, কদমফুল, প্রজাপতি, চাঁদমালা, চক্র, প্রতিমার সাজসজ্জা, লক্ষ্মীপূজার মুখোশ প্রভৃতি শোলা দিয়ে বানানো শুরু হয়। তখন এই শিল্পের নতুন বাজার গড়ে ওঠে। মালাকারদের আয়ও বেশ বাড়তে থাকে। দেখা যেত পুরুষরা তো বটেই বাড়ির মেয়েরাও ঘরের কাজের অবসরে পুরুষদের সাহায্য করতেন। অগ্রহায়ণ থেকে শুরু হতো বিয়ের মৌসুম। ফলে এ সময় কর্মব্যস্ততা বেড়ে যেত। কিন্তু এখন সে সব ইতিহাস।

শোলা দু’রকম। কাঠ শোলা ও ফুল শোলা। কাঠ শোলা বেশ শক্ত।  এই শোলা জেলেরা মাছ ধরার কাজে ব্যবহার করে। অনেক সময় শক্ত ছিপি তৈরির কাজেও কাঠ শোলা ব্যবহৃত হয়। আর ফুল শোলা বেশ নরম। সাধারণত ধান ক্ষেত, পাট ক্ষেত, খাল, বিল, মজা পুকুর এবং জলাশয়ের তলদেশে পরগাছার মতো শোলা উৎপন্ন হয়। পানির উপরিভাগে কেবলমাত্র শোলা গাছের পাতা ভেসে থাকে। পাতা দেখতে অনেকটা তেঁতুল পাতার মতো। শোলাগাছ উচ্চতায় চার-পাঁচ ফুট এবং প্রস্থে আড়াই ইঞ্চির বেশি হয় না। ক্ষেত থেকে পাট কাটার মতো পানির তলা থেকে গোড়া থেকে শোলা কেটে নিয়ে রোদে শুকিয়ে নেয়া হয়। তারপর খুব ধারালো ছুরি দিয়ে ওপরের ছাল তুলে ফেলে কোমল হাতে খুব যত্ন নিয়ে ভেতরের সাদা শাঁস প্রয়োজন অনুযায়ী কেটে কাজে লাগানো হয়।

ধারালো ছুরি দিয়ে শোলা থেকে পাতলা কাপড়ের মতো যে অংশ কেটে নেয়া হয় তার নাম ‘কাপ’। কুম্ভকারের তৈরি পোড়া মাটির ছাঁচের ওপর কাপ বসিয়ে চাপ দিয়ে নানা ধরনের এবং আকারের কলস, ফুল, লতাপাতা, পশুপাখির নকশা তৈরি করা হয়।

শোলা শিল্প যে প্রাচীণ এতে দ্বিমত নেই। শোলার গাছ পাওয়া যেত জেলার দাশুড়িয়া, মাহামুদপুর, পুস্তিগাছা, মতিগাছা এবং চরগোবিন্দপুর এলাকার বিলাঞ্চলে। সেখান থেকে মালাকাররা শোলা কেটে আনাতেন। ইরি ধান আবাদের কারণে ফুল শোলা উৎপাদন কমতে কমতে এখন নেই বললেই চলে।

দুঃখের বিষয় এই যে, শোলা শিল্প বাঁচিয়ে রাখতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। নতুন করে একে উপস্থাপনের দলগত কোনো চেষ্টাও চোখে পড়ে না। অথচ শোলা পরিবেশ বান্ধব এবং শোলার তৈরি জিনিস দৃষ্টিনন্দন। শোলার তৈরি জিনিস নতুন করে সৌখিন মানুষের নজর কাড়ছে। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে এর কদর ধীরে হলেও বাড়ছে। কিন্তু ভালো মানের শিল্পী না থাকায় চাহিদা মেটানো যাচ্ছে না। ঢাকার শাঁখারীবাজারের শোলা শিল্পী গণেশ মালাকারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল এই তথ্য। অনেকে এখন শুধু মুকুট বা মালা নয়, বিয়ের মণ্ডব সাজাতেও শোলার নকশা ব্যবহার করতে চান। অথচ এ কাজের জন্য লোক পাওয়া যায় না। তাছাড়া যেহেতু এটি  সৃজনশীল কাজ সেহেতু চর্চা ছাড়া এটা সম্ভব নয়।

হারিয়ে যাওয়া মালাকারদের হয়তো আর খুঁজে পাওয়া যাবে না, কিন্তু তারপরও এই শিল্পের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে এখনও যারা এ পেশায় আছেন তাদেরকেই উদ্যোগ নিতে হবে।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৯ জুলাই ২০১৪/তাপস রায়

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়