সুইস ব্যাংকে কারা টাকা রাখতে পারে?
![সুইস ব্যাংকে কারা টাকা রাখতে পারে? সুইস ব্যাংকে কারা টাকা রাখতে পারে?](https://cdn.risingbd.com/media/imgAll/2024December/bank-pro-2501010407.jpg)
ছবি: সংগৃহীত
সুইস ব্যাংকের নাম শোনেননি এমন মানুষ খুব কমই পাওয়া যাবে। দুর্নীতির নাম শুনলেই কিংবা মোটা অংকের অর্থ পাচার করার খবর এলেই শোনা যায় সুইস ব্যাংকের নাম। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দুর্নীতিবাজ ও কালো টাকার মালিকরা এখানে টাকা রাখেন এমন কথাই সর্বত্র প্রচলিত। আসলেই কি দুর্নীতিবাজদের জন্য এই ব্যাংক? সুইস ব্যাংকে কারা অ্যাকাউন্ট খুলতে পারে এসব প্রশ্ন সবার মনেই।
সুইস ব্যাংক আসলে কী: সুইস শব্দটি এসেছে সুইজারল্যান্ড নাম থেকে। সুইস ব্যাংক আসলে কোনো একটি ব্যাংকের নাম নয় এটি একটি ব্যাংকিং নেটওয়ার্ক। সহজ কথায়, সুইজারল্যান্ডের যে কোন ব্যাংককেই আসলে সুইস ব্যাংক বলা হয়। যেমন আমাদের বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোকে আপনি বাংলাদেশি ব্যাংক বলতে পারেন। সুইস ব্যাংকের প্রতি মানুষের আগ্রহের অন্যতম কারণ হলো এর গোপনীয়তা। এরা গ্রাহকদের তথ্য ফাঁস করে দেয় না। এই ব্যাংকে টাকা রাখলে আপনাকে কোনো সুদ দেওয়া হবে না বরং খরচা যাবে আপনারই। এই ব্যাংকগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে সুইস ফেডারেল ব্যাংকিং নেটওয়ার্ক। সুইস ব্যাংকের ইতিহাস বেশ পুরনো। ৩০০ বছর আগে ইউরোপের ধনীশ্রণির লোকেদের সম্পদ রক্ষা করার জন্য এই ব্যাংক চালু হয়।
সুইস ব্যাংকের ইতিহাস: সুইস ব্যাংক ব্যবস্থায় গোপনীয়তার ইতিহাস ৩০০ বছরেরও পুরোনো। সপ্তদশ শতকের প্রথম ভাগে ইউরোপের অভিজাত শ্রেণির লোকদের সম্পদ রক্ষা করার লক্ষ্য থেকে এর যাত্রা শুরু। দ্য গ্র্যান্ড কাউন্সিল অব জেনেভা ১৭১৩ সালে প্রথম ব্যাংক গোপনীয়তার আইন প্রণয়ন করেছিল। সুইজারল্যান্ডের পাশের দেশ ফ্রান্সের ব্যাংকগুলো ছিলো খ্রিষ্টধর্মের প্রোটেস্ট্যান্টদের দখলে তাই ক্যাথলিকরা অর্থ সম্পত্তি সুইস ব্যাংক গুলোতে রাখতে শুরু করেন। সুইস ব্যাংকে রাখা অর্থ বিমার আওতায় আনা হয় ১৭৮০ সালে। মূলত সুইজারল্যান্ড যখন আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে ১৮১৫ সালে মর্যাদা পায় তখন এই ব্যাংকগুলোর চাহিদা বাড়তে থাকে। সুইস ব্যাংকের ব্যবসা সবচেয়ে ভালো জমে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর। যুদ্ধে আর্থিক সংকট দেখা দেওয়াতে ইউরোপের নানান দেশ জনগণের ওপরে যুদ্ধকর চাপাতে থাকে এ সময় ধনী ব্যক্তিরা নিজেদের অর্থ লুকিয়ে রাখতে সুইস ব্যাংকের ব্যবহার শুরু করেন।
সুইস ব্যাংকে কারা অ্যাকাউন্ট খুলতে পারে: অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে কারা এই ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলতে পারে। সত্য এই যে, নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমা দিয়ে যে কেউই খুলতে পারবেন সুইস ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট। তবে এর জন্য মানতে হবে বেশ কয়েকটি নির্দেশনা।
যুক্তরাষ্ট্র ও ওইসিডির কড়া নজরদারি আছে এইসব বিষয়ে। পাসপোর্ট ও বিভিন্ন সার্টিফিকেটসহ নানা প্রয়োজনীয় কাগজ লাগবে এই অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য। সুইস ব্যাংকে যারা টাকা রাখেন এরা যে কেউই আগে সেখানে টাকা রেখেছেন এমন ব্যক্তি কিংবা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে থাকেন। সুইস ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলতে গেলে স্বশরীরের সেখানে উপস্থিত হতে হয় তবে অনেকক্ষেত্রে অনলাইনেও মেলে সেবা। এইজন্য লাগবে সম্পত্তির হিসাবসহ নানা স্টেটমেন্ট। যে কেউ যদি ভাবেন সুইজারল্যান্ড যাবেন আর অ্যাকাউন্ট খুলে ফেলবেন, তবে ভাবনাটি ভুল। সুইস ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলতে সর্বনিম্ন ১০ হাজার সুইস ফ্রা ব্যাংকে রাখতে হয় বাংলাদেশের টাকায় যার মান প্রায় ৯ লক্ষ টাকা। বিভিন্ন ব্যাংকে বিভিন্ন নিয়মেও অর্থ নিয়ে থাকে। ইউবিএস গ্রুপে একটি অ্যাকাউন্ট খুলতে প্রয়োজন হবে ৫০ হাজার ডলার। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোতে টাকা রাখলে যেমন লভ্যাংশ পাওয়া যায় সুইস ব্যাংক সেরকম নয়। উল্টো আপনাকেই দিতে হবে মাসিক লাভ। এছাড়াও দিতে হবে হিসাব রক্ষণাবেক্ষণের খরচা। সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক ২০১৫ সালে আমানতে ঋণাত্মক সুদহার (-)০.৭৫ নির্ধারণ করেছে।
আপনি চাইলে যেকোন সময় আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিতে পারবেন। এতে বিশেষ কোনো বিধিনিষেধ ও খরচাপাতি নেই।
সারাবিশ্বে এই ব্যাংক যে কারণে জনপ্রিয়: সারাবিশ্বে সুইস ব্যাংকগুলোর ব্যাপক জনপ্রিয়তার কারণ এদের গোপনীয়তা। এই গোপনীয়তা রক্ষা করা তাদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। এই সম্পর্কিত নানা আইন রয়েছে সুইস ফেডারেল অ্যাসেম্বলির। এই আইন আসার পেছনের অন্যতম কারণ হলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর নানা দেশে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়। সবচেয়ে বেশি বিপাকে ছিলো জার্মানরা। এ সময় ফ্রান্স ও জার্মানি সুইস ব্যাংকে রাখা তাদের দেশের অর্থের হিসাব খুঁজতে থাকে এবং চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসে। ১৯৩২ সালে ফ্রান্সেরর পুলিশ সুইস ব্যাংকের দুই কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করে এবং তাদের কাছে বিভিন্ন তথ্য হাতিয়ে নেয়। অনেক ধনকুবের, শিল্পপতি সহ অনেকের নাম উঠে আসে। এরপর ১৯৩৪ সালে গোপনীয়তার নতুন আইন প্রচলন করে তারা। তথ্য কিংবা গোপনীয়তা ফাঁসকে গণ্য করা হয় ফৌজধারি অপরাধ হিসেবে যা আগে ছিলো দেওয়ানি অপরাদ। তথ্য ফাঁস করলে যে কারো ৫ বছরের জেল এবং অর্থদণ্ড হতে পারে যা আগে ছিলো মাত্র ৬ মাস। সুইস ব্যাংকের এই ধারাটি সর্বত্র ‘আর্টিকেল ৪৭’ নামে পরিচিত। কোন সাংবাদিক এই তথ্য ফাঁস করলেও এই আইনে দন্ডিত হবেন। সুইজারল্যান্ডের অধিবাসীদের কাছে এই আইন বেশ গর্বের। ১৯৮৪ সালে এই আইন সংশোধন করা হবে কি না এমন গণভোটে এই আইন সংশোধনের বিপক্ষে ৭৩% ভোট পড়েছিলো।
২০২২ সালের মে মাসেও এই আইনকে সমর্থন দিয়েছে সুইজারল্যান্ডের অর্থনীতি ও করসংক্রান্ত সংসদীয় সাবকমিটি। সুইজারল্যান্ড স্থিতিশীল গনতন্ত্রের কারণে তাদের ব্যাংকিং খাত বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে সারা বিশ্বে। এই ব্যাংকের টাকা আদান-প্রদান সহজ এবং মুদ্রা সহজে অন্য মুদ্রায় রূপান্তর করা যায় দেখেই এর চাহিদা সর্বত্র।
বার্ক এনফিল্ড ডিসক্লোজার কী: সুইস ব্যাংকের ইউবিএসে কর্মরত ছিলেন মার্কিন নাগরিক ব্র্যাডলি বার্কেনফিল্ড। সম্পদ ব্যবস্থাপক হিসেবে যোগ দেয় জেনেভার ইউবিএসে এরপর ২০০৫ সালে পদত্যাগ করেন। তার দায়িত্ব ছিলো মূলত মার্কিন নাগরিকদের অর্থ ও তথ্য হিসাবের। তবে ২০০৭ সালে এক কান্ড ঘটিয়ে বসেন তিনি। মার্কিন বিচার বিভাগকে তিনি ব্লেয়ার আইনের আওতায় তথ্য দেন। যদি কেউ কর ফাঁকি দিতে সুইস ব্যাংকে টাকা রাখেন এবং সেই তথ্য কেউ বিচার বিভাগকে দেয় তবে মোট টাকার ৩০% পাবেন তথ্য সরবরাহকারী। এরপর তদন্ত শুরু করে ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন বা এফবিআই। ইতিহাসে যা বার্ক এনফিল্ড ডিসক্লোজার নামে পরিচিত।
এডলফ হিটলার টাকা রেখেছিলেন সুইস ব্যাংকে: জানা যায়, সুইস ব্যাংকে টাকা রেখেছিলেন এডলফ হিটলার। হিটলার ইউনিয়ন ব্যাংক অব সুইজারল্যান্ডে ১১০ কোটি রেইচমার্ক (পূর্বের জার্মান মুদ্রা পরবর্তীতে যা ভয়েসমার্ক নামে পরিচিত ছিলো) রেখেছিলেন।
২০২৪ সালের ২২ জুন প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক (এসএনবি) বিশ্বের সব দেশের সঙ্গে ২০২২ সালে তাদের ব্যাংকগুলোর দায় ও সম্পদের পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, সুইস ব্যাংকে চলতি বাংলাদেশীদের টাকার পরিমাণ কমেছে এর অন্যতম কারণ ডলার সংকট। মাত্র এক বছরেই সুইস ব্যাংকগুলো থেকে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা সরিয়ে নিয়েছে বাংলাদেশি নাগরিক এবং এ দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো।
ঢাকা/লিপি