ঢাকা     শনিবার   ১৭ মে ২০২৫ ||  জ্যৈষ্ঠ ৩ ১৪৩২

আশির দশকের বসতবাড়ি

এস এম জাহিদ হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:০৬, ৯ মে ২০২৫   আপডেট: ১২:৩৬, ১১ মে ২০২৫
আশির দশকের বসতবাড়ি

ছবি: সংগৃহীত

আশির দশকে কৃষিভিত্তিক সমাজে গ্রামের বাড়িগুলো ছিল বেইজ পয়েন্ট বা মূল ভূমি। বাড়িগুলো প্রতিবছর মাটি দিয়ে উঁচু করা হতো। দূর থেকে দেখে মনে হতো এক একটি বাড়ি যেন, এক একটি টিলা। বাড়ির নারীরা পরম যত্নে ঘর, বাড়ি, উঠান লেপে রাখতেন। সে সময় বাড়িগুলো ছিল ছোট-বড় গাছ দিয়ে ঘেরা। বেশিরভাগই ছিল দেশীয় ফলের গাছ, আরও দেখা যেত ওষুধী গাছ। বাড়ি থেকেই এতো ফলের জোগান আসতো যে বাজার থেকে ফল কেনার প্রয়োজন পড়তো না। ফল যে বাজার থেকে কিনতে হয়, সেটা জানতো না সে সময়ের শিশুরা। সৌখিন মানুষের বাড়িতে দেখা যেত ফুলের বাগান। সবাই চেষ্টা করতো বাড়িগুলো দক্ষিণমুখী করে তৈরি করার। যাতে গরমকালে বাতাস পাওয়া যায়। তবে স্বাভাবিক বর্ষায়ও বাড়ির চারপাশে এমনকি উঠানেও পানি উঠে যেত। ফসলি জমির খেত তিন চার মাস পানির নিচে ডুবে থাকতো। নিম্নাঞ্চলগুলো প্লাবিত হওয়ার ফলে মানুষের দৈনন্দিন কাজে, অভ্যাসে পরিবর্তন আসতো। মানুষেরা কখনও অখণ্ড অবসর উপভোগ করতেন, আবার কখনও এক মুঠো চাল জোগাড় করতে দিশাহারা হয়ে পড়তেন।

বাড়ির উঠানের কোণে কৃষাণীর হাতে বোনা সবজি উৎপাদিত হতো। বাড়িগুলো ছিলো এক একটি ছোট খামার। বড় বাড়িগুলোকে তিনভাগে ভাগ করা হতো। প্রথম অংশে বাংলা ঘর থাকতো। অপরিচিত কোনো লোক আসলে বাংলা ঘরে বসতে দেওয়া হতো। বাংলা ঘরে বসে হুকা টানতে দেখা যেত পুরুষদের। এমনকি গ্রামীণ বিচার বসতো ওই বাংলা ঘরে। সে সময় পারিবারিক, সামাজিক ছোট, বড় সমস্যা সমাধান হয়ে যেত বাংলা ঘরেই। গ্রামের গণ্য-মান্য ব্যাক্তিরা এক সাথে বসে যেকোন সমস্যার সমাধান করে ফেলতেন। খুব কম সংখ্যক সমস্যা আইন-আদালত পর্যন্ত পৌঁছাতো।

অবস্থাসম্পন্ন কৃষকের ঘরগুলো ছিল টিনের তৈরি। চৌচালা ঘরগুলো বাড়ির শোভা বাড়াতো। টিনের ঘর ছিল কৃষকের আভিজাত্যের প্রতীক। আরও ছিল টিনের ছাপরা ঘর ও শনের ছাউনি দেওয়া ঘর। রান্নাঘর আর গরুর ঘর তৈরি হতো শন দিয়ে। বেড়া হতো পাটকাঠি কিংবা বাঁশের। রান্না করার জন্য দুই রকম ব্যবস্থা ছিল। বৃষ্টি না থাকলে খোলা জায়গায় রান্না হতো। শুধুমাত্র একটি ছাউনি থাকতো। বিশেষ করে ধান সিদ্ধ করা হতো ওই খোলা জায়গায়। মাটির চুলায় রান্না হতো। গৃহীনিরা নিপূণ দক্ষতায় তৈরি করতেন সেই চুলা। বৃষ্টির দিনে রান্নার জন্য আলাদা ঘরও থাকতো। ঘরের একটা অংশ ব্যবহৃত হতো ঢেঁকিঘর হিসেবে। 

বাড়িগুলোতে একটা পাতকূয়া থাকতো। পাত বা রিং দিয়ে তৈরি ওই কূয়া ছিল গেরহস্ত বাড়ির পানির উৎস। অল্প কিছু বাড়িতে নলকূপ দেখা যেত। বাড়ির শেষাংশকে বলা হতো ‘আড়াবাড়ি’ বা ‘পেছনবাড়ি’। ‘হাইচবাড়িও বলতেন কেউ কেউ। সেখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় বাঁশ, বেতের ছোটখাটো জঙ্গল থাকতো। পেছনবাড়িতের খোলা টয়লেট পাতা হতো। পেছন বাড়ির জঙ্গলে নির্ভয়ে বসবাস করতো নানা রকম পশুপাখি। যেমন- ঘুঘু, পেঁচা, কানাকুয়া, গুঁইসাপ, গিরগিটি, শিয়াল এবং আরও অনেক ছোট-খাটো মাংসাশী প্রাণী।

গরু-বাছুরকে খাওয়ানোর জন্য বাড়িগুলোতে থাকতে বড় বড় খড়ের গাদা, পালা বা স্তূপ। অনেক সময় গেরহস্থের আভিজাত্য এবং প্রতিপত্যির প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতো খড়ের স্তূপ। যদিও সব বাড়িতেই গরু থাকতো। সঙ্গত কারণে খড়ের পালাও থাকতো। দেখা যেত যে, দুই, তিনটা হাল থাকতো। গাভী, বাছুর মিলে প্রত্যেক বাড়িতে চারটা থেকে দশটা গরু থাকতো। 

বাড়ির উঠানে ধান থেকে শুরু করে যেকোনো ধরণের শস্য স্তূপ করা, মাড়াই করা, শুকানোর কাজ করা হতো। উঠানে যাতে ধূলাবালি না থাকে সেজন্য গোবর আর পানি দিয়ে লেপা হতো উঠান। 

প্রত্যেক বাড়িতে ছিল ছোট খাটো পুকুর। ওই যে বললাম, প্রতিবছর বাড়ির উঠান উঁচু করতে হতো, স্বাভাবিকভাবেই বাড়ি লাগোয়া একটা পুকুর থাকতো বা তৈরি করা হতো। বাড়ির চারপাশের নিচু জায়গাকে বলা হতো পালান। পালানে নানা রকম সবজি চাষ করা হতো। অনেক সময় বিভিন্ন ধরণের মসলা বিশেষ করে আদা, হলুদ, ধনিয়া, কালোজিরা চাষ হতো। 

আধুনিক জীবনের আহ্বানে কিংবা একান্ত প্রয়োজনে গ্রামের অনেক মানুষ শহরে কিংবা বিদেশে থাকেন। কৃষিব্যবস্থায়ও এসেছে আমূল পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের ধারায় বদলে গেছে পুরনো ঘরবাড়ির ঐতিহ্য। গ্রামের অধিকাংশ বড় বাড়িতে এখন কেউ থাকেন না। কোনো উৎসবকে কেন্দ্র করে অল্প কয়েকদিনের জন্য বাড়ির মানুষ ঘরে ফিরলে পুরনো কোলাহল কিছুটা ফিরে আসে। তারপর শুধুই নিরবতা, নির্জনতা নেমে আসে বাড়িগুলোতে।

বাড়িগুলো তবু ফেলে আসা দিনের বদলে যাওয়া মানুষের কথা বলে।

ঢাকা/লিপি


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়