ঢাকা     সোমবার   ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ৩০ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

‘স্যার’ ও ‘ম্যাডাম’ বলা শুরু হয়েছিলো যেভাবে

সাতসতেরো ডেস্ক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৫৩, ১৫ জুলাই ২০২৫   আপডেট: ১১:০২, ১৫ জুলাই ২০২৫
‘স্যার’ ও ‘ম্যাডাম’ বলা শুরু হয়েছিলো যেভাবে

ছবি: বিবিসি থেকে নেওয়া

বাংলাদেশের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ধারায় 'স্যার' ও 'ম্যাডাম' সম্বোধনের প্রচলন ছিলো না। এই শব্দগুলো এসেছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি থেকে। অধুনা প্রশাসনিক কাঠামোতে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘স্যার’ ও ‘ম্যাডাম’ সম্বোধন এখন সামাজিক স্বীকৃতির সীমা ছাড়িয়ে ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

লেখক ও গবেষক মুনতাসীর মামুনের 'ঔপনিবেশিকোত্তর ঔপনিবেশিক মন' বই থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে অফিস-আদালত সবখানেই প্রতিদিন হাজারোবার উচ্চারিত হয় এই শব্দ দুটি: স্যার এবং ম্যাডাম।

আরো পড়ুন:

বাংলাদেশের সরকারি অফিসগুলোয় ১৬তম গ্রেডের (সাবেক চতুর্থ শ্রেণির) উপরে যেকোনো সরকারি কর্মচারিদের স্যার বা ম্যাডাম বলা হয়। যা এখন একটি সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। যদিও আজ থেকে ৩৫ বছর আগে ১৯৯০ সালেই বাংলাদেশে সরকারি চাকরিজীবীদের ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ হিসেবে সম্বোধন করা বাতিল হয়েছিল?

‘স্যার’, ‘ম্যাডাম’- এর ইতিহাস
অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজ অভিধানের তথ্য, ১২৯৭ সালে ইংরেজি ভাষায় ‘স্যার’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। ওই সময় ব্রিটিশ রাজতন্ত্রে বিশেষ ভূমিকা পালনের জন্য ‘নাইট’ উপাধি পাওয়া ব্যক্তিদের নামের আগে এই শব্দটি যোগ করা হতো।

তবে শব্দটির উৎপত্তি কিন্তু ফরাসি শব্দ ‘স্যায়ার’ (sire) থেকে। যার অর্থ ছিল প্রভু বা কর্তৃপক্ষ। শব্দটি সম্মানসূচক হলেও সেই সময় কর্তৃত্ব, প্রভুত্ব ও আনুগত্য বোঝানোর চিহ্ন হিসেবে ব্যবহার করা হতো।

ভারতীয় ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও লেখক উদয়লাল পাই এর লেখা ‘আর উই স্টিল স্লেভস’ বই অনুযায়ী, ফ্রান্সে সামন্তযুগে SIR শব্দ দ্বারা বুঝানো হত- Slave I Remain অর্থে। যার অর্থাৎ আমি দাসই থেকে গেলাম। এদিকে ইংল্যান্ডে SIR শব্দ দিয়ে বোঝানো হতো- Servant I Remain। যার অর্থাৎ আমি চাকরই থেকে গেলাম। সাধারণত কোন ভদ্রমহিলাকে সম্বোধনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় ম্যাডাম শব্দটি। ইংরেজি ম্যাডাম (Madam) শব্দটিও ফরাসি মাদাম (Madame) থেকে এসেছে।

ভারতীয় উপমহাদেশে ১৭শ শতকের দিকে ‘স্যার’, ‘ম্যাডাম’ শব্দের প্রচলন শুরু হয়। যখন ব্রিটিশরা এই অঞ্চলে উপনিবেশ স্থাপন করে। ব্রিটিশ শাসনের সময় ইংরেজি ভাষার প্রভাব বিস্তার লাভ করে এবং সরকারি প্রশাসন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আদালত সবখানে একটি নিয়ম তৈরি হয় যেটি ব্রিটিশ সভ্যতা ও মান্যতার প্রতিচ্ছবি বহন করত।

বাংলা দেশে এই শব্দের ব্যবহার ও বিকাশ লাভ করে মূলত ব্রিটিশ প্রশাসনের শ্বেতাঙ্গ কর্মকর্তাদের প্রতি স্থানীয় জনগণের আনুগত্য প্রকাশের উপায় হিসেবে। 

এক সময় সাধারণ মানুষ ব্রিটিশ কর্তাদের 'স্যার', ব্রিটিশ নারীদের 'ম্যাডাম' বলে ডাকতো, এই সম্বোধন ছিল কর্তৃত্ব ও আনুগত্যের প্রকাশ।

১৮৩৫ সালে লর্ড ম্যাকলে তার ‘মিনিটস অব ইন্ডিয়ান এডুকেশন’ বইয়ে লিখেছেন, ‘উপনিবেশে এমন একটি শ্রেণি গড়ে তুলতে হবে যারা ‘রঙে ভারতীয়, কিন্তু রুচিতে, বুদ্ধিতে এবং ভাবনায় ব্রিটিশ।’


এই নীতির অধীনে ভারতে গড়ে ওঠে ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা এবং তার সঙ্গে আসে ব্রিটিশ সামাজিক রীতি যার একটি ছিল কর্তৃপক্ষকে ‘স্যার’ বলা। শিক্ষক, ম্যাজিস্ট্রেট বা কর্মকর্তা, যারা শাসনের প্রতিনিধিত্ব করেন, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সে সময় এই সম্বোধন বাধ্যতামূলক হয়ে ওঠে।

এই সম্বোধন এখন শুধু আর শ্রদ্ধার প্রতীক নয়, বরং কর্মক্ষেত্রে নিজের অবস্থান নিশ্চিত করার জন্য ব্যবহৃত হয়। যা এক ধরনের 'কৌশলগত ভাষা'।

‘সাহেব’ থেকে 'স্যার, ম্যাডাম'
মুনতাসীর মামুনের মতে, ‘‘বাংলার মধ্যযুগ বা মুঘল আমলের সংস্কৃতিতে রাজা বাদশাহদের জাঁহাপনা, হুজুর এমন নামে সম্বোধন করা হতো। ব্রিটিশ আমলে যখন ইংরেজি ভাষা চালু হলো, তখন অন্যান্য সম্বোধনগুলো হারিয়ে হয়ে গেল। সেই জিনিসটাই এখন হয়েছে ‘অনারেবল প্রাইম মিনিস্টার’, ‘মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়’, ‘ভিসি মহোদয়’ ইত্যাদি।

বাংলায় এক স ময় কর্মকর্তাদের সাহেব বলে সম্বোধন করার প্রচলন ছিলো। সাহেব শব্দটি আরবি সাহাবী শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ সঙ্গি, সাথী, সহচর কিংবা বন্ধু। ব্রিটিশ ও শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয় নারীদের কেসম্বোধন করা হতো ‘মেমসাহেব’ বলে। বাঙালি বিবাহিত নারীদের বলা হতো বেগম সাহেব। পরে সেই জায়গা ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ দখল করে নেয়।

‘ঔপনিবেশিকোত্তর ঔপনিবেশিক মন’ গ্রন্থে লেখা হয়েছে— ‘‘এই সাহেব, মেমসাহেব বা বেগম সাহেব শব্দসমূহ ইংরেজ আমল হতে কর্তৃত্ব অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে অথচ ১৮৬৯ সালের আগে কর্তৃত্ব প্রকাশক সম্বোধন অর্থে এই শব্দের ব্যবহার আমাদের দেশে ছিল না।’’

এ কথা সত্য যে 'স্যার' ও 'ম্যাডাম' সম্বোধনের প্রচলন বাংলাদেশের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ধারা থেকে নয়, বরং তা এসেছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি থেকে।

বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতিতে আগে শিক্ষককে বলা হতো 'মাস্টারমশাই', 'পণ্ডিতমশাই'। কিন্তু সেগুলোর ব্যবহার এখন প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। 'স্যার' এবং 'ম্যাডাম' সম্বোধনের রেওয়াজ তৈরি হয়েছে। যা মূলত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন ও শিক্ষাব্যবস্থার অংশ হিসেবে বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে প্রোথিত হয়েছে। কখনও প্রভুত্ব বুঝানোর ক্ষেত্রে আবার কখনও সম্মানার্থে।

ব্রিটিশ শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষককে পুরুষ হলে ‘স্যার’ এবং নারী হলে ‘মিস’ বা ‘ম্যাডাম’ বলা হতো। এই চর্চাই বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনেও প্রচলিত হয়েছে।

সূত্র: বিবিসি

ঢাকা/লিপি

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়