ঢাকা     শনিবার   ২০ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৫ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

বিশ্বসাহিত্যে বিখ্যাত উক্তি (এক)

মুম রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৫৭, ২৬ আগস্ট ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বিশ্বসাহিত্যে বিখ্যাত উক্তি (এক)

উপরে বাম থেকে বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, শেক্সপিয়ার, নিচে বাম থেকে মানিক, শরৎ এবং মুনীর চৌধুরী

মুম রহমান

‘প্রণমিয়া পাটনী কহিল জোর হাতে
আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’

সন্তান বাৎসল্যের উদাহরণ টানতে গেলেই এই প্রাচীন উদ্ধৃতিটি মনে পড়ে। পাটনী’র মতো সব অভিভাবক সকল পরিস্থিতিতেই  দোয়া করেন, তার সন্তান যেন ‘দুধে-ভাতে’ থাকার মতো আনন্দে থাকে, ভালো থাকে। ভারতচন্দ্র রায় গুণাকরের ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্য প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম নিদর্শন। এই কাব্যে উল্লেখিত পঙ্ক্তি দু’টি শুধু বহুবার উদ্ধৃতই নয়, এখনও সুপ্রযুক্ত। অষ্টাদশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি ও মঙ্গলকাব্যের সর্বশেষ শক্তিমান কবি ভারতচন্দ্র। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যের জন্যই তাঁকে `রায়গুণাকর` উপাধিতে ভূষিত করেন। যাই হোক, এটি অন্যপ্রসঙ্গ। তবে এটা ঠিক যে, মহৎ সাহিত্য এ ভাবেই যুগে যুগে প্রাসঙ্গিক রয়ে যায়। সেই সাহিত্যের চরিত্রকে দিয়ে বলানো লেখকের উক্তি আমরা বারবার ব্যবহার করি নানা প্রসঙ্গে, এমনকি অপ্রাসঙ্গিক হলেও নানা অজুহাতে।

মুনীর চৌধুরীর নাটক ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’-এর একটি লাইন তো প্রায় ইতিহাস হয়ে গেছে। বিখ্যাত এই লাইনটি হলো: ‘মানুষ মরে গেলে পচে যায় বেঁচে থাকলে বদলায়।’ বেঁচে থাকার একটা অমোঘ চরিত্র যে বদলে যাওয়া, তা নাটকের এই একটি সংলাপেই প্রকট হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে শরৎচন্দ্রের ‘বিলাসী’ গল্পে বলা হয়েছে, ‘অতিকায় হস্তি লোপ পাইয়াছে কিন্ত তেলাপোকা টিকিয়া আছে’। প্রবাদতুল্য এই বাক্যে শুধু বেঁচে থাকাকেই প্রাধান্য দেয়া হয়নি, বেঁচে থাকার মাহত্ম্য তুলে ধরা হয়েছে। সত্যিই তো, আপোস করে তেলাপোকার মতো একটা জীবন দিয়ে মানুষ কী করবে? শরৎচন্দ্রের একাধিক উক্তি আজ বাণী চিরন্তনীতে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন প্রজন্মের মানুষের মধ্যে কথাগুলো এখনও চালু রয়েছে। এ ভাবেই তিনি ক্রমশ হয়ে উঠেছেন ধ্রুপদী এক সাহিত্যস্রষ্টা।

প্রেম ও বিচ্ছেদের সান্ত্বনায় এ সময়ের তরুণাও শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’র কাছেই আশ্রয় খুঁজে পায়। তারা বলে, ‘বড়‬‬ প্রেম শুধু কাছে টানে না, দূরেও ঠেলিয়া দেয়।’ প্রেমের ক্ষেত্রে বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে আয়কনিক উপন্যাসটিও শরৎচন্দ্রই লিখেছেন। তার ‘দেবদাস’-এর একাধিক উক্তি স্মরণযোগ্য। যেন জীবনের কোনো না কোনো সময় সেগুলো আমাদেরকেই উচ্চারণ করতে হয়ে। ১৯০১ সালে রচিত ‘দেবদাস’ উপন্যাসের দেবদাস ও পার্বতী আজকের প্রেমিক-প্রেমিকাকেও তাড়িত করে। মাঝ রাতে পাবর্তী দেবদাসের শোবার ঘরে এলে দেবদাস ভীত হয়ে বলে, ‘ভূতের ভয় না করুক, কিন্তু মানুষের ভয় ত করে! কেন এসেচ?’
নির্বিকার পারু জবাব দেয়, ‘দেবদা, নদীতে কত জল। অত জলেও কি আমার কলঙ্ক চাপা পড়বে না?’

এই দু’টি সংলাপে তখনকার সামাজিক চিত্র ফুটে ওঠে। সামাজিক চেতনা ও অন্তজ মানুষের প্রতি দরদ উঠে আসে শরৎচন্দ্রের লেখনিতে। যখন সমাজের নিচু শ্রেণীর কারো মৃতদেহ সৎকার করতে যায় শ্রীকান্ত তখন সমাজের জাত-পাতের ভেদাভেদের বিরুদ্ধে আমরা তাকেই কথা বলতে দেখি। তিনি করেন অকপট ও সাহসী উচ্চারণ: ‘‎মড়ার‬‬ কোনো জাত নেই।’ এই উক্তি কি এখনও প্রসঙ্গিক নয়? প্রাসঙ্গিক বলেই উক্তিটি আজো পাঠকের মননে শেলের মতো বিঁধে আছে।

‘‘পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ?’ এ ধ্বনি নবকুমারের কর্ণে প্রবেশ করিল। কি অর্থ, কি উত্তর করিতে হইবে, কিছুই মনে হইল না। ধ্বনি যেন হর্ষ বিকম্পিত হইয়া বেড়াইতে লাগিল; যেন পবনে সেই ধ্বনি বহিল; বৃক্ষপত্রে মর্মারিত হইতে লাগিল; সাগর নাদে যেন মন্দীভূত হইতে লাগিল। সাগর বসনা পৃথিবী সুন্দরী; রমণী সুন্দরী; ধ্বনিও সুন্দর; হৃদয়তন্ত্রী মধ্যে সৌন্দর্যের লয় মিলিতে লাগিল।’’ বাংলা রোমান্টিক ধারার ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নবকুমারের কাছেই শুধু নয়, পাঠকের কাছেও আজও ‘পথিক তুমি পথ হারাইয়াছ’ এক দার্শনিক প্রশ্ন, আত্ম-আবিষ্কারের দিশা। বঙ্কিমের এই উক্তিটি অধিক ব্যবহৃত।  

এক সময় পরিবহন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থানে লেখা থাকতো, ‘শুনো হে মানুষভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’ বাংলা নাটক বা চলচ্চিত্রে এ উক্তিটি ব্যাপক ব্যবহৃত হয়েছে। হয়তো অনেকেই জানেন না, বহুল প্রচারিত এই উক্তিটি চতুর্দশ শতকের বৈষ্ণব কবি চণ্ডীদাসের।

রবীন্দ্রসাহিত্য থেকে উক্তির কথা বলতে গেলে আলাদা আরেকটি লেখা তৈরি করতে হবে। হুমায়ূন আহমেদ তো অকাতরে রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য গান, কবিতার পঙ্ক্তি দিয়ে বইয়ের শিরোনাম করেছেন। রবীন্দ্রনাথের কবিতা, গানের পাশাপাশি তার ছোটগল্পের একাধিক উক্তি বহুল ব্যবহৃত। ‘হৈমন্তী’, ‘সমাপ্তি’, ‘ছুটি’ ইত্যাদি ছোটগল্পের বহু উক্তি আমাদের মুখস্থ। তার ছড়া, কবিতার অনেক পঙ্ক্তি সমাজের বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় মনে পড়ে যায়। নদ-নদীর পানিশূন্যতা দেখে যেমন মনে পড়ে ‘আমাদের ছোট নদী’র কথা, তেমনি এই শহরে চলন্ত বাসে ঝুলে থাকা যাত্রীদের দেখে মনে পড়ে ‘ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই ছোট সে তরী’র কথা। এমন অজস্র উক্তির কথা উল্লেখ করে শেষ করা যাবে না।

প্রেম নিয়ে সম্ভবত বাংলা ও বিশ্বসাহিত্যে অসংখ্য বিখ্যাত উক্তি আছে। এরিক সাগালের বেস্টসেলার উপন্যাস ‘লাভ স্টোরি’র এই উক্তি ‘ভালোবাসায় দুঃখিত ও ধন্যবাদ বলতে নেই’ প্রবাদের মর্যাদা পেয়ে গেছে। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা ছোটগল্প নরেন্দ্র নাথ মিত্রের ‘রস’। বাংলা, হিন্দিতে এই গল্প নিয়ে একাধিক চলচ্চিত্র, নাটক হয়েছে। এই গল্পের গুড় বিক্রেতা নায়ক যখন স্ত্রীকে বলে, ‘তোমার কথা আলাদা। তুমি হইলা নেশার কালে তাড়ি আর নাস্তার কালে গুড়’ তখন পাঠক সাহিত্যরসের অন্য ইঙ্গিত পেয়ে যান। ঠিক তেমনি ভাবে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র কপিলা যখন কুবেরকে বলে, ‘মাঝি আমারে লইবা?’ তখনও প্রেমের ভিন্ন মাত্রা তৈরি হয়। আমাদের রসসাহিত্যের যাদুকর সৈয়দ মুজতবা আলী ‘বেঁচে থাকো সর্দিকাশি’তে প্রেমকে অবশ্য দেখেন তার স্বভাবসুলভ চাপল্যে। তিনি তখন লেখেন সেই বিখ্যাত উক্তি: ‘প্রেমে পড়লে নাকি মানুষের পাখা গজায়।’ এরপরেই তিনি ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, ‘হবেওবা, কিন্তু এ কথা নিশ্চয় জানি মানুষ তখন চোখেমুখে এমন সব নতুন ভাষা পড়তে পারে যার জন্য কোনো শব্দরূপ ধাতুরূপ মুখস্থ করতে হয় না। তবে সে পড়াতে ভুল থাকে বিস্তর, কাকতালীয় এন্তার।’

বিশ্বসাহিত্যের সেরা নাট্যকার বলে স্বীকৃত উইলিয়াম শেক্সপিয়ার তার ‘টুয়েলভ নাইট’-এ বলেই দেন, ‘প্রেমিকের মিলনেই যাত্রার সমাপ্তি ঘটে।’ তার রোমিও জুলিয়েট পুরোটাই প্রেমের উক্তিতে ভরপুর। অস্কার ওয়াইল্ড আরেক ধাপ এগিয়ে ‘দ্য পিকচার্স অব ডোরিয়ান গ্রে’তে বলেন, ‘তোমার ঠোঁটের বাঁক ইতিহাস নতুন করে লেখায়।’

কিশোরী আনা ফ্রাঙ্কের কথা আমরা সবাই জানি। দীর্ঘকাল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে এই মেয়েটি ডায়েরি লিখেছে। যুদ্ধের হাত থেকে সে বাঁচতে পারেনি, কিন্তু তার দিনলিপি তাকে অমর করেছে। সেই ডায়েরির একটি উক্তি আজও বহু মানুষের অনুপ্রেরণা হয়ে আছে:  ‘সবকিছুর পর আমি এখনও বিশ্বাস করি মানুষ আসলেই অন্তরের দিক থেকে ভালো।’

অন্ধকার জগতের জীব রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ার ড্রাকুলা। ব্রাম স্টোকারের অন্যতম সৃষ্টি এই ড্রাকুলার একটি উক্তিও কিন্তু বিশ্বসাহিত্যে বিশেষ স্থান দখল করে আছে। সেটি হলো: ‘জীবনে অন্ধকার আছে এবং আলোও আছে। আর তুমি সেই সব আলোর একটি যা সকল আলোর আলো।’ এমনই আশার কথা শোনা যায় মার্গারেট মিচেলের ঢাউস উপন্যাস ‘গন উইথ দি উইন্ড’-এ। সেখানে মিচেল লিখেছেন, ‘সবচেয়ে বড় কথা আগামীকাল একটি ভিন্ন দিন।’

বিশ্বসাহিত্যে এমন অসংখ্য উল্লেখযোগ্য উক্তি আছে যা আজো স্মরণযোগ্য। এ প্রসঙ্গে ইতালো কালভিনোর একটি উক্তি দিয়ে লেখাটি শেষ করছি। তিনি বলেছেন, ‘একটি ধ্রুপদী বই হলো সেই বই, যা কখনোই এর যা বলার তা বলে শেষ করেনি।’ এমনিভাবে যথার্থ সাহিত্যিক উক্তিও যেন যুগ যুগ ধরে বলা হচ্ছে তবু তার অর্থ, মূল্য শেষ হচ্ছে না। হবেও না কোনো দিন।



 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ আগস্ট ২০১৫/তাপস রায়

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়