ট্রাম্পময় বছর
বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের খবর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে থাকবে এটাই স্বাভাবিক বিষয়। তবে ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে হোয়াইট হাউসে দ্বিতীয় মেয়াদে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রবেশের পর তার খবর সংবাদমাধ্যমে ছিল চোখে পড়ার মতো। এক কথায় বলতে গেলে ২০২৫ সাল ছিল ট্রাম্পময় বছর।
২০ জানুয়ারি দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য শপথ নেন ট্রাম্প। ওই দিনই তিনি প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেন। বিষয়টি পরিবেশবাদীদের জন্য ছিল বড় আঘাত। একই দিন তিনি মেক্সিকো উপসাগরের নাম পরিবর্তন করে রাখেন আমেরিকা উপসাগর। এছাড়া কেন্দ্রীয় সরকারে লোক নিয়োগ বন্ধের ঘোষণা দেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নেওয়া অভিবাসী সন্তানদের সাংবিধানিক অধিকার বাতিল ঘোষণা করে নির্বাহি আদেশ জারি করে দেন। ২৫ জানুয়ারি ট্রাম্প গ্রিনল্যান্ডকে ডেনমার্কের কাছ থেকে নিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দেন।
ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহটা শুরু হয়েছিল প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করার মাধ্যমে। পহেলা ফেব্রুয়ারি ট্রাম্প কানাডা ও মেক্সিকোর বিরুদ্ধে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের হুমকি দেন। ৩ ফেব্রুয়ারি তিনি জানান, তিনি কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রের ৫১তম অঙ্গরাজ্য হিসেবে দেখতে চান। পরের দিনই ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সুরে সুর মিলিয়ে তিনি গাজাকে মার্কিন অধিকারে এনে পুরো উপত্যকাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে নতুন করে অবকাশযাপন কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনার কথা জানান।
ফেব্রুয়ারির শেষ দিনটা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক ইতিহাসে লজ্জার একটি দিন। ওই দিন হোয়াইট হাউসে আসা ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে রীতিমতো অপমান করেন ট্রাম্প ও তার ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স।
এপ্রিল মাসটা ট্রাম্প শুরু করেছিলেন বাণিজ্য যুদ্ধ দিয়ে। ২ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করা বিশ্বের অধিকাংশ দেশের পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেন। কিছু কিছু দেশের ওপর এই শুল্ক হার ছিল আরো বেশি।
৭ মে পাকিস্তানে আক্রমণ শুরু করে ভারত। এর পরিপ্রেক্ষিতে পাল্টা আক্রমণ শুরু করে পাকিস্তান। শেষ পর্যন্ত ১০ মার্কিন মধ্যস্থতায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি হয়। এর পুরো কৃতিত্ব দাবি করেন ট্রাম্প।
ক্ষমতাধর নয়, এমন দেশগুলোর রাষ্ট্রপ্রধানদের হোয়াইট হাউসে ডেকে এনে অপদস্থ করাটা যেন ট্রাম্প প্রশাসনের একটি নিয়মিত বিষয় হয়ে উঠেছিল। ২১ মে ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্টকে অপদস্থ করেন। মে মাসে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে মধ্যস্থতা করার ঘোষণা
জুন মাসটা ছিল যুদ্ধের মাস। মার্কিন শক্তিতে বলিয়ান ইসরায়েল আকস্মিকভাবে ইরানের ওপর হামলা চালায়। ইসরায়েলের সঙ্গে যোগ দিয়ে ট্রাম্প ২১ জুন ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর বিমান হামলা চালানোর নির্দেশ দেন। ১৮ জুন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরের সঙ্গে হোয়াইট হাউসে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন ট্রাম্প। মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই কর্মকাণ্ড রীতিমতো চটিয়ে তোলে ভারতীয়দের। জুন মাসের শেষ দিনটি অর্থাৎ ৩০ জুন ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএইড বন্ধের নির্দেশ দেন।
জুলাই মাসটা ট্রাম্পের নিজের দেশ সামাল দিতেই পার হয়ে গেছে। ৪ জুলাই তিনি ওয়ান বিগ বিউটিফুল বিল অ্যাক্টে স্বাক্ষর করেন। এটি একটি বৃহৎ ব্যয় প্যাকেজ যা কর্পোরেশন এবং ধনীদের উপর কর হ্রাস করে।
আগস্টে ডোনাল্ড ট্রাম্প কয়েক ডজন দেশ এবং বিদেশী স্থান থেকে মার্কিন আমদানির উপর ১০ শতাংশ থেকে ৪১ শতাংশ পর্যন্ত "পারস্পরিক শুল্ক" পুনর্বহালের একটি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেছেন। তার ডিয়ার ফ্রেন্ড মোদির দেশ ভারতের ওপর ২৫ শতাংশ বাণিজ্য শুল্ক এবং রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কেনার অপরাধে আরো ২৫ শতাংশ অর্থাৎ মোট ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেন তিনি।
অক্টোবরে ট্রাম্পের উপস্থিতিতে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া। এই মাসেই ট্রাম্প দাবি করেন, তিনি ক্ষমতায় আসার পর থেকে আটটি যুদ্ধের অবসান ঘটিয়েছেন। নোবেল তারই প্রাপ্য। ২৯ অক্টোবর ট্রাম্প নতুন করে মার্কিন পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষার ঘোষণা দেন।
নভেম্বরের সবচেয়ে বড় ঘটনা ছিল দুটি। প্রথমটি হচ্ছে, ট্রাম্প তার প্রভাব ব্যবহার করে সাংবাদিক জামাল খোশোগি হত্যায় সম্পৃক্ততার অভিযোগ থেকে মুক্তি দেন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা জানায়, এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে সৌদি যুবরাজ নাকি কিছুই জানতেন না। দ্বিতীয় ঘটনা হচ্ছে, ট্রাম্প যেই ব্যক্তিটিকে নিয়ে অসংখ্যবার অবমাননাকর বক্তব্য রেখেছেন সেই জোহরান মামদানি সব জল্পনার অবসান ঘটিয়ে নিউইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন।
চাটুকারিতা গ্রহণের মাধ্যমে বছরের শেষ মাসটি শুরু হয়েছিল ট্রাম্পের। নোবেল শান্তি পুরস্কার না পেলেও ওয়াশিংটন ডিসিতে বিশ্বকাপ ড্র অনুষ্ঠানে ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফ্যান্টিনোর কাছ থেকে নব্য উদ্ভাবিত ‘ফিফা শান্তি পুরস্কার’ গ্রহণ করেছেন ট্রাম্প। ৯ ডিসেম্বর তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রের দুয়ার বন্ধ ঘোষণা করেন ট্রাম্প। ডিসেম্বরেই ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার শাসক নিকোলাস মাদুরোকে হটানোর জন্য নানা উদ্যোগ শুরু করেন। বছরের শুরুতে গ্রিনল্যান্ডকে যুক্তরাষ্ট্রের দখলে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। বছরের শেষ প্রান্তে আবারও সেই গ্রিনল্যান্ড দখলের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
ঢাকা/শাহেদ