সৃজনশীলতা নিয়ে মীরাক্কেল চ্যাম্পিয়ন রনির বক্তব্য
মেহেদী || রাইজিংবিডি.কম
আবু হেনা রনি। কোটি মানুষের পরিচিত মুখ। শুধু বাংলাদেশে নয়, ওপার বাংলায়ও তার জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। বাংলাদেশি এই স্ট্যান্ড-আপ কমেডিয়ান, অভিনেতা, উপস্থাপক ও মডেলের জন্ম নাটোরে। জি-বাংলায় মিরাক্কেল আক্কেল চ্যালেঞ্জার নামক কমেডি শো-তে নিজেকে একক ও অদ্বিতীয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে জাত চিনিয়েছেন তিনি। হয়েছেন মিরাক্কেল-৬ এর চ্যাম্পিয়ন। রনির বেড়ে ওঠার বড় একটি সময় কেটেছে উত্তরবঙ্গের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি)।
২০০৫-২০০৬ শিক্ষাবর্ষে রাবির নাট্যকলা বিভাগে সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি হন আবু হেনা রনি। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন শেষ এখন ঢাকায় স্থায়ী হয়েছেন। সুযোগ পেলেই ছুটে আসেন মতিহারের প্রিয় এই সবুজ চত্বরে। জমে তোলেন আড্ডা।
জনপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল রাইজিংবিডির সঙ্গে সম্প্রতি একান্ত আড্ডায় মিলিত হন দুই বাংলার এই জনপ্রিয় কৌতুকাভিনেতা। এ সময় সৃজনশীলতার বিকাশে প্রচলিত একাডেমিক সিলেবাস পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তার কথার বলেন এই কমেডি কিং। আলাপচারিতায় উঠে আসে তার জীবনের নানা মজার অভিজ্ঞতা, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাসহ অজানা অনেক বিষয়। তার সঙ্গে কথা বলেছেন রাইজিংবিডির রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) প্রতিনিধি মেহেদী হাসান।
‘চার ভাইয়ের মধ্যে আমি দুই নম্বর। রেজাল্টও দুই নম্বর (দ্বিতীয় শ্রেণি)। বড় ভাই চাকরি করে, সেজ ভাই রংবাজ, ছোটভাই দিনে দুপুরে মানুষের দাঁত উপড়ে দেয় (দাঁতের ডাক্তার)। মিরাক্কেলের স্টেজে শো-এর মাধ্যমে ভাইদের প্রোমোশন করিয়েছি। তাদের কাছ থেকে এখন একটা অংশ পাই।’ কথোপকথনের শুরুতেই এমন কিছু অযাচিত বাক্য শুনিয়ে সবাইকে হাসিয়ে বললেন, কী জানতে চান?
রাইজিংবিডি : আপনার বাসায় কে কে...? (মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিমায় বলতে শুরু করলেন রনি)
রনি : চার ভাই এক বউ (শুধু বড় ভাই বিবাহিত)। মা গৃহিনী, বাবা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। স্ট্রোক করার পর প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হন। বাধ্য হয়েই অবসর গ্রহণ। এখনো সুস্থ্য হননি।
রাইজিংবিডি : বর্তমানে কী করছেন?
রনি : টিভি প্রোগ্রামগুলোতে উপস্থাপনায় বেশ ব্যস্ত। বাংলাভিশনে বাচ্চাদের নিয়ে কমেডি প্রোগ্রাম, জিটিভিতে ‘আজকের অনন্যা’, এটিএন বাংলায় সিনে মিউজিক ও বিটিভির ‘হাসতে মোদের মানা’ অনুষ্ঠানে মজে আছি। এ ছাড়া গত ঈদে মুক্তি পাওয়া ‘পদ্ম পাতার জল’ সিনেমায় নায়কের বন্ধু চরিত্রে কমেডিয়ান হিসেবে অভিনয় করেছি।’
রাইজিংবিডি : দেশে স্টান্ড-আপ কমেডির অবস্থান কেমন?
রনি : আমেরিকাতে ব্যাপক প্রচলন আছে। সেখানে কমেডিয়ানদের বেশ সম্মান দেওয়া হয়। ভাবলাম, আমাদের দেশে কেন কমেডি চর্চা হবে না? এজন্য আমরা দেশে স্টান্ড আপ কমেডির ক্ষেত্র গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। বাংলাদেশ কমেডি ক্লাবের আদলে দেশের প্রতিটি বিভাগে এর বিস্তৃতি লাভ করেছে। এতে তরুণদের ব্যাপক সাড়া মিলছে। কারণ কমেডি অনুষ্ঠানের দর্শকও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
রাইজিংবিডি : মিরাক্কেলে যাওয়ার উৎসাহ কীভাবে পেয়েছিলেন?
রনি : স্কুলজীবন থেকেই স্টেজে কৌতুকাভিনয় করতাম। ক্যাম্পাসে এসে বন্ধুদের সঙ্গে চায়ের দোকানে বসতাম, সবাইকে হাসাতাম। এটা বন্ধুরা মেনে নিয়েছে, উৎসাহ দিয়েছে। আমার কথা, তাদের হাসি কৌতুক তৈরি করতে এবং কাজ করতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। সুতারাং সব অবদান আমি তাদেরকেই দেব।
রাইজিংবিডি : মিরাক্কেলে কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন?
রনি : আগে পথে-ঘাটে, বাসায়, বন্ধুদের মাঝে কমেডি করতাম। কিন্তু সফলতার জন্য স্টেজ প্রয়োজন ছিল। সব সফলতা মিরাক্কেল নামক স্টেজের মাধ্যমে পাওয়া। শুধু তাই নয়, মিরাক্কেল গ্রুমিং করে আমাকে স্টান্ড আপ লেভেলে নিয়ে এসেছে।
রাইজিংবিডি : প্রতিটি শব্দে শব্দে কৌতুক করার কৌশল রপ্ত করলেন কীভাবে?
রনি : দেখবেন, অনেকে কথায় কথায় কবিতা বলে, কেউ ছন্দে ছন্দে বা গানে গানে কথা বলে। আমারও সেরকম একটা জায়গা থেকেই হয়ে যায়। তবে হ্যাঁ প্রতিটি বিষয়ের মধ্যেই জোকস আছে। একটু চিন্তুা করলেই বের করা সম্ভব।
রাইজিংবিডি : ছোটবেলার স্মরণীয় কোনো ঘটনা বলুন।
রনি : শীতের দিনে খালি গায়ে কালি বা রং প্রভৃতি মেখে স্টেজের পেছনে ডাক পাওয়ার আসায় বসে থাকতাম। স্যার আসলেই বলতাম, আমি কখন? বলতেন, তোমারটা মূল আকর্ষণ তো, আর একটু পর...। আবার জানতে চাইতাম স্যার আমারটা কখন? বলতেন, ‘বুঝছ না- তোমারটা মূল আকর্ষণ। এজন্য সব শেষে দিতে হবে।’ একসময় দেখতাম সবাই চলে যাচ্ছে এবং ঘোষণা করা হচ্ছে, ‘আজকের অনুষ্ঠান এখানেই শেষ!’ পরে কষ্ট নিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে টিউবয়েলে গিয়ে কালি তুলতাম। তা করতে গিয়ে অনেক সময় মুখের চামড়া উঠে যেত। তখন নির্জনে বসে কাঁদতাম..।
রাইজিংবিডি : এ পর্যন্ত কয়টি পেশার সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন?
রনি : ১২/১৩ টি। পান-বিড়ি-সিগারেটওয়ালা, লজেন্সওয়ালা, দুই টাকার বিনিময়ে সিলেটে সুরমা নদীর ওপর রিকশা ঠেলা, আমড়া-বাদামওয়ালা, রিকশাওয়ালা, ট্রাকের হেলপার, খেলনা-মুখোশওয়ালা প্রভৃতি। এছাড়াও রাস্তায় রাস্তায় গান গেয়েও টাকা আয় করেছি।
রাইজিংবিডি : আপনি পাগল সেজেও রাস্তায় ঘুরেছেন? অভিজ্ঞতা বলুন..
রনি : শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধীরা কেমন জীবনযাপন করে, বিষয়টি দেখা প্রয়োজন। পাগল সেজে বের হচ্ছি শুনে মায়ের কান্নাকাটি আর বাবার কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি হলো। পরে বড় ভাইয়ের বাসায় গিয়ে পাগলের বেশ ধরলাম। বললাম, ‘কোনোমতে বাড়ি থেকে বের করে দিতে।’ আমাকে আটকিয়ে লাভ হবে না ভেবে, ভাই ছেড়ে দিল। কীভাবে যে ক’টা দিন পার করলাম তা বলতে পারব না। তবে সেবার আমার যেটা মনে হয়েছিল, ‘রাস্তার সব পাগলই পাগল না। আমি যেমন ছদ্মবেশী ছিলাম, অন্যদের কেউ কেউও হয়তো আমার মতো করে..!
রাইজিংবিডি : ক্যাম্পাস জীবনকে মিস করেন কতটুকু..?
রনি : ক্যাম্পাসকে খুব মিস করি। অনেক স্মৃতি আছে। বেশকিছু পরিচিত জায়গা আছে যেখানে বন্ধুরা মিলে একসঙ্গে আড্ডা দিয়েছি, গান করেছি। যা কখনই ভুলতে পারব না..!
রাইজিংবিডি : আপনি নাকি লেখাপড়ায় চরম অমনোযোগী ছিলেন..!
রনি : একটু অন্যরকম ছিলাম। একাডেমিক লেখাপড়ার মধ্যে কোনোদিনই সীমাবন্ধ ছিলাম না। নাট্যকলা বিভাগের ছাত্র হওয়ায় আবহসঙ্গীত, মাইম, লাঠি, বউয়ের ভাষা শাড়ি, ছন্দ ইত্যাদির সঙ্গে ব্যাবহারিক ক্লাসে অংশগ্রহণ করতে হতো। তবে হ্যাঁ, ক্লাসে এগুলো হয়তো করিনি, তবে রাস্তা-ঘাটে কোনো-না-কোনোভাবে ওগুলো রপ্ত করেছি।
রাইজিংবিডি : একাডেমিক সিলেবাসকে যথার্থ মনে করেন কি?
রনি : একাডেমি একাডেমির জায়গায়ই আছে। সৃজনশীলতার বিকাশে একাডেমিক সিলেবাস পরিবর্তন আনা প্রয়োজন বলে মনে করি। বিশেষ করে ব্যবহারিক কোর্স। ব্যবহারিক বৃদ্ধি করা উচিত তাত্ত্বিকের পাশাপাশি নয়; একটু বেশিই।
রাইজিংবিডি : অনেকেই আপনাকে অনুসরণ করে কমেডির ক্ষেত্রে। তাদের জন্য কী বলবেন?
রনি : যারা কমেডিয়ান হয়ে উঠতে চান তাদের বলব, পঞ্চইন্দ্রিয় খোলা রাখার পাশাপাশি দৃষ্টিভঙ্গি তীক্ষè করতে হবে। নতুন নতুন জোকস বানাতে হবে। বন্ধুদের মাঝে জোকস বলে মনোযোগ আকর্ষণ করতে হবে। তাহলেই একদিন দেখবেন- কেল্লা ফতে।’
রাইজিংবিডি : মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
রনি : আপনাকেও ধন্যবাদ। ধন্যবাদ রাইজিংবিডি পরিবারকেও।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ আগস্ট ২০১৫/মেহেদী/নিয়াজ/রফিক
রাইজিংবিডি.কম