ঢাকা     শুক্রবার   ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ২০ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

‘উপন্যাসটির বিষয়বস্তু বিহারিদের ক্যাম্পজীবনের মধ্যে আবদ্ধ থাকেনি’

স্বরলিপি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:০৬, ২৮ জানুয়ারি ২০২৫   আপডেট: ১০:৫১, ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
‘উপন্যাসটির বিষয়বস্তু বিহারিদের ক্যাম্পজীবনের মধ্যে আবদ্ধ থাকেনি’

সাদিয়া সুলতানা

সাদিয়া সুলতানা গল্পকার ও ঔপন্যাসিক। সাধারণের অসাধারণ জীবনচিত্র তুলে ধরতে পারদর্শী এই কথাশিল্পী। বাংলা একাডেমি থেকে রাবেয়া খাতুন কথাসাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত সাদিয়া সুলতানার সপ্তম উপন্যাস ‘উঠল্লু’ প্রকাশ হবে ২০২৫ বইমেলায়। উপন্যাসটি প্রকাশ করছে ঐতিহ্য। উপন্যাস এবং লেখালেখির নানা বিষয়ে তিনি কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন স্বরলিপি। 

রাইজিংবিডি: ‘উঠল্লু’র মূল বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানতে চাই।

আরো পড়ুন:

সাদিয়া সুলতানা: ‘উঠল্লু’র মূল বিষয়বস্তু সম্পর্কে বলার আগে কেন উঠল্লু লিখেছি সেই বিষয়ে একটু বলা প্রয়োজন। আসলে ছোটবেলা থেকেই বিহারি জনগোষ্ঠী বলে পৃথক কিছু মানুষের কথা শুনে আসছি যারা বাংলাদেশে বসবাস করছে অথচ নামেই যেন তারা বাংলাদেশের মানুষ নন। এরপর বড় হতে হতে বিভিন্ন নাটক, বইপত্র, পত্রিকা বা সংবাদমাধ্যম থেকে জেনেছি বিহারিদের একটা অংশ আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে নেতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু এর উল্টোদিকে বা নেপথ্যে কোনো গল্প আছে কি না তা জানার জন্য সবসময় ভেতরে ভেতরে এদের নিয়ে কৌতূহল কাজ করেছে। আড়াই বছর আগে আমি যখন আমার উপন্যাস ‘৭১’ লেখার প্রস্তুতি হিসেবে মুক্তিযুদ্ধকালীন দিনাজপুরে গণহত্যা ও বীরাঙ্গনাদের নিয়ে পড়াশোনা শুরু করি তখন বিহারিদের সম্পর্কে অনেক তথ্য আমার হাতে আসে। এরপর সৈয়দপুরের গোলাহাট বধ্যভূমি নিয়ে লেখার জন্য স্বচক্ষে বধ্যভূমি দেখতে গিয়ে ওখানকার ক্যাম্প সম্পর্কে জানতে পারি। এরপর ‘৭১’ লেখা শেষ করে ‘উঠল্লু’ লিখতে শুরু করি।

বলা যায়, বাংলাদেশে যুগে যুগে একটা জনগোষ্ঠীকে মোহাজের, অবাঙালি, অস্থানীয়, বিহারি, উদ্বাস্তু, রিফুজি, রিফিউজি, মাউরা, উর্দুভাষী বাংলাদেশী ইত্যাদি নামে পরিচিত হতে হয়েছে। তাদের প্রকৃত পরিচয় সন্ধান করতেই ‘উঠল্লু’ উপন্যাসের যাত্রা শুরু হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত উপন্যাসটির বিষয়বস্তু বিহারিদের ক্যাম্পজীবনের মধ্যে আবদ্ধ থাকেনি, এর ভেতরে উঠে এসেছে ধর্ম ঘিরে মানুষের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বসহ আমাদের সামাজিক অবক্ষয়ের বিভিন্ন দিক। 

রাইজিংবিডি: এ ধরনের কাজ ‘ফিল্ড ওয়ার্ক’ দরকার হয়, কীভাবে কাজটি সম্পন্ন করলেন?

সাদিয়া সুলতানা: আমার মনে হয় লেখক তো আর ঈশ্বর কিংবা তার প্রেরিত কোনো মহামানব না যে সে দিব্যদৃষ্টিতে সব দেখতে পাবে। লিখতে হলে লেখককে যেমন পড়তে হবে, তেমন মাঠে নামতে হবে, ধুলামাটি মাখতে হবে পায়ে। চার দেয়ালের ভেতরে বসে এসির হাওয়া খেতে খেতে সব লেখা তৈরি করা সম্ভব না। যেই জীবন বা সময় আমরা দেখিনি সেসব নিয়ে লিখতে বসলে প্রচুর পড়ালেখা করে বা কল্পনা করে অনেক লেখা নির্মাণ করা যায় বটে কিন্তু তাতে যেন প্রাণটা ঠিকঠাক থাকে না। তাই যখন ক্যাম্পজীবন নিয়ে লিখবো ঠিক করলাম— তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম ক্যাম্পে যেতে হবে।

এ ক্ষেত্রে শুরুতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছিল। শুভাকাঙ্ক্ষীরা আঁতকে উঠে বারবার আমাকে সতর্ক করেছে, ক্যাম্পের পরিবেশ ভালো না, প্রচুর অপরাধী আত্মগোপন করে থাকে ওখানে আর এরা বাঙালিদের সন্দেহের চোখে দেখে। একজন নারী বা সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে ক্যাম্পের ভেতরে আমার ঢোকা ঠিক হবে না ইত্যাদি, ইত্যাদি। এসব শুনে প্রথমে ঘাবড়ে গেলেও দমে যাইনি। এদিকে আমার ঘরের মানুষটি একটি নেতিবাচক শব্দও উচ্চারণ করেনি। বরং ওর পরামর্শে নীলফামারিতে কর্মরত আমার সহকর্মী আরিফা ইয়াসমিন মুক্তার সঙ্গে আমি যোগাযোগ করি। মুক্তা আমার জন্য এমন একজন মানুষ খুঁজে বের করে যিনি বিহারিদের ভাষা জানেন এবং ক্যাম্পগুলোতে যাতায়াত আছে। ভদ্রলোকের নাম আব্দুল মান্নান।

আব্দুল মান্নানের সহযোগিতায় আমার কাজটা সহজ হয়ে যায়। এরপর যেদিনই আমি ক্যাম্পে গিয়েছি সেদিনই ভদ্রলোক আমার সঙ্গে ছিলেন। এমন কি আমার ঘরের মানুষটিও আমার সঙ্গে গেছেন। আমি দিনাজপুর থেকে সৈয়দপুরে চলে যেতাম, যতক্ষণ ক্যাম্পে থাকতাম ততক্ষণ সে আমার সঙ্গে থাকতো। প্রথমে ক্যাম্পবাসীদের কেউ কেউ সন্দেহের দৃষ্টিতে জানতে চাচ্ছিল আমি ভোট চাইতে এসেছি কি না বা সাংবাদিক কি না। পরে তারা আমাকে এত আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেছে যা আমি কখনোই ভুলবো না। কোনো কোনো ঘরে রীতিমতো টানাটানি করে বসিয়ে নাস্তা দিয়ে আপ্যায়ন করেছে। পথে পথে ভিক্ষা করে বেড়ায় এমন একজন নারী বারবার জড়িয়ে ধরে আদর করছিল, এত খুশি হয়েছিল সে, আমি তাদের জীবন দেখতে এসেছি জানতে পেরে। বাচ্চারা তো ঘিরে ছিল সারাক্ষণ, ওরা আমাকে অনেক ছড়া শুনিয়েছে, ওরা নানারকম শারীরিক কসরৎ দেখিয়েছে। আমি ছবি তুলেছি, ভিডিও করেছি। খুঁটে খুঁটে দেখেছি ওদের জীবন, জীবিকা। এভাবে দেখার সুযোগ না পেলে আমি উঠল্লুর একটা শব্দও হয়তো লিখতে পারতাম না।

রাইজিংবিডি: লেখকের প্রচারণা কৌশল কেমন হওয়া উচিত বলে মনে করেন?
সাদিয়া সুলতানা: আমরা মেধা, সময়, আয়ু খরচ করে যেই সৃজনশীল কাজ করছি তার প্রচার প্রচারণা হওয়া আবশ্যক বৈকি। প্রচার না করলে মানুষের কাছে নিজের কাজটা পৌঁছাবে কী করে? তবে কৌশল শব্দটা নেতিবাচক অনেকক্ষেত্রে। আমি ইতিবাচক প্রচারণায় বিশ্বাসী। আর পাঠকের কাছে লেখা পৌঁছে যাওয়ার জন্য প্রচারণা অবশ্যই প্রয়োজন। আমার মনে হয়, একজন লেখক বছর জুড়ে বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে লিখছেন, এটাই তার লেখার মূল প্রচারণা। আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে তো নিজের লেখার প্রচার করার অবারিত সুযোগ এখন। যদিও এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে গিয়ে কেউ কেউ অন্যদের উত্যক্ত করেন বলেও শোনা যায়, এটা অশোভন, এমন আচরণ কাম্য নয়। 

রাইজিংবিডি: মুদ্রিত বইয়ের পাশাপাশি অডিও, পিডিএফ হওয়ার ট্রেন্ডকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
সাদিয়া সুলতানা: মুদ্রিত বইয়ের পাশাপাশি অডিও, পিডিএফ বই হওয়াকে আমি ইতিবাচকভাবে দেখি। আমি নিজে চোখের সমস্যার কারণে স্বাচ্ছন্দ্যে পিডিএফ বই পড়তে না পারলেও হাঁটতে বের হলে বা সংসারের কাজ করার সময় অডিও বুক শুনি। আমার একঘেয়ে কাজকর্ম তখন আর একঘেয়ে থাকে না। মূলত নতুন প্রজন্মের আগ্রহ আর সময়ের প্রয়োজনেই আমাদের এই ট্রেন্ডকে স্বাগত জানাতে হবে।

রাইজিংবিডি: ঐতিহ্য থেকে বইটি প্রকাশ হচ্ছে। সেক্ষেত্রে আপনি পাণ্ডুলিপি জমা দিয়েছেন নাকি তারা চেয়ে নিয়েছে?—প্রক্রিয়াটা কীভাবে সম্পাদন করেছেন। চুক্তিপত্র অনুযায়ী লেখককে যে রয়ালিটি দেওয়া হয়, এতে কি সন্তুষ্ট?
সাদিয়া সুলতানা: ২০২২ সালে ঐতিহ্য প্রকাশনী পাণ্ডুলিপি আহ্বান করেছিল, তখন আমার গল্প সংকলন ‘উজানজল’ নির্বাচিত হয় ও ঐতিহ্য থেকে বইটি প্রকাশিত হয়। এরপর ঐতিহ্য থেকে কয়েকবার আমার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় আমি আইন বিষয়ক বা অন্য কোনো বিশেষ লেখা লিখছি কি না। তখন আমার হাতে যেসব কাজ ছিল তা নিয়ে অন্য প্রকাশনীর সঙ্গে কথা ঠিক হয়ে যায় তাই আমি ঐ সময়ে কোনো পাণ্ডুলিপি দিইনি। এরপর উঠল্লুর কাজ শেষ করার পর সিদ্ধান্ত নিই, এটা ঐতিহ্যকে দিবো। আমি পাণ্ডুলিপি মেইল করলে ওরা জানায় পাণ্ডুলিপিটা ভালো, বইটা ওরা প্রকাশ করবে।

আমার সব প্রকাশক আমার সঙ্গে সমান আচরণ করেননি। কেউ কেউ তো বারবার চুক্তিপত্র পাঠাবেন বলেও পাঠাননি। যারা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছেন। তাদের সঙ্গে পরে আমি কাজ করার উৎসাহ হারিয়েছি, জানিয়েছি তাদের সঙ্গে আর কাজ করবো না। কেউ কেউ আবার চুক্তিপত্র অনুযায়ী পূর্ণাঙ্গ বা আংশিক রয়্যালিটি ঠিকঠাক বুঝিয়ে দিয়েছেন। কেউ কেউ জানিয়েছেন, বইয়ের মুদ্রণ শেষ হয়নি, শেষ হওয়ামাত্র রয়্যালিটি বুঝে পাবো। সব মিলিয়ে এই জায়গাতে সন্তুষ্টি কাজ করার কোনো কারণ নেই।

ঢাকা/লিপি

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়