ঈদও একটি ইবাদত
মাওলানা মো. জহিরুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম
ঈদের কোলাকুলি (ছবি : সংগৃহীত)
মাওলানা মো. জহিরুল ইসলাম : আমাদের ভাষায় ঈদ মানে আনন্দ হলেও শাব্দিক ও সার্বিক বিবেচনায় ঈদ অর্থ শুধুই আনন্দ বা উচ্ছ্বাস নয়, বরং ঈদও একটি ইবাদত। ঈদুল আজহা যেমন হজ ও কোরবানির ঈদ, তেমনি ঈদুল ফিতর রোজা রাখা ও ফিতরা দানের ঈদ। উভয়টাই পৃথক এক একটি ইবাদত। তবে এই ইবাদতের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে আনন্দ।
মাসব্যাপী সিয়াম সাধনায় পুরস্কারের আশা অন্তরে পোষণ করাই হলো রোজা রাখার আনন্দ। আল্লাহর রহমত, গুনাহের ক্ষমা, দোজখ থেকে মুক্তি, শবে কদরে হাজার বছরের পুণ্য ও তাকওয়া অর্জনের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ, এ সবই রোজাদারের পুরস্কার।
রোজাদার রোজা শেষে প্রত্যক্ষভাবে পুরস্কারগুলো না পেলেও তিনি বুঝতে পারেন, এগুলো তিনি পাবেন। তবে রোজা কবুল হওয়া-না হওয়া নিয়ে একটা সংশয় অবশ্যই থাকে।
একবার আবু বকর (রা.) ঈদের দিন সকালে ঘরের দরজা বন্ধ করে কাঁদছিলেন। কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার রোজা আল্লাহর দরবারে কবুল হয়েছে কিনা আমি তো নিশ্চিত নই, তাহলে খুশি হব কিসের ভিত্তিতে?’
পক্ষান্তরে গরিব-দুঃখীর মুখে হাসি ফোটাতে, তাদের ভালো খাওয়াতে ও পরাতে, তাদের সন্তানদের মুখে মিষ্টান্ন, ঈদের দিনে দু’মুঠো খাবার আর গায়ে নতুন জামা তুলে দিতে ধনীদের ফিতরা দান হলো রোজার আরেকটি আনন্দ।
বায়হাকি শরিফের হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘রসুলুল্লাহ (সা.) যখন মদিনায় উপস্থিত হলেন তখন তিনি তাদের দুটি উৎসব পালন করতে দেখেন। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা যে এ দুটি জাতীয় উৎসব পালন কর, এর মৌলিকত্ব ও বিশেষত্ব কী?
তারা বলল, আমরা অন্ধকার যুগে এ দুটি উৎসব পালন করতাম এবং তা আজও করছি। একথা শুনে রাসুল (সা.) বললেন, ‘আল্লাহ তোমাদের এ দুটি উৎসবের পরিবর্তে এরচেয়ে অধিক উত্তম দুটি দিন ঈদুল আজহা ও ঈদুল ফিতর দান করেছেন। সুতরাং আগের উৎসব বন্ধ করে এ দুটি দিনের নির্দিষ্ট অনুষ্ঠানগুলো পালন করা শুরু কর।’
রসুলুল্লাহ (সা.) জাহেলি যুগের বাহারী খেল-তামাশার আনন্দ-উৎসবকে বাতিল ঘোষণা করেছেন, আল্লাহর দেয়া বিধানকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য অনুপ্রাণিত করেছেন।
মুসলমানদের ঈদের আনন্দ হলো, স্বার্থ ত্যাগের মাধ্যমে অভাবী নিরন্নকে সাহায্য করার মাধ্যমেপ্রাপ্ত আনন্দ। ঈদের দিনগুলোতে আমরা সাহাবায়ে কেরামের আদর্শ থেকে শিক্ষা নিতে পারি। তারা দিনে নিজের ভালো, পরিচ্ছন্ন জামা-কাপড় পরিধান করতেন। অনেক বেশি দান করতেন। এমনকি সাধ্যের সবটুকু বিলিয়ে দিতেন। দীর্ঘ সময় মসজিদে কাটাতেন। অন্যান্য ইবাদতও বেশি করতেন। তাতেই অনেক বেশি আনন্দিত হতেন।
হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘ফিতরা, জাকাত রোজাদারকে বেহুদা, অবাঞ্ছনীয় ও নির্লজ্জতামূলক কথাবার্তা বা কাজকর্মের মলিনতা থেকে পবিত্র করার এবং গরিব-মিসকিনদের ব্যবস্থা (দান) করার উদ্দেশ্যে অবশ্যই আদায়যোগ্য। যে ব্যক্তি ঈদের নামাজের আগেই তা আদায় করবে, তা ওয়াজিব ফিতরা হিসেবে আল্লাহর কাছে গৃহীত হবে। আর যে ব্যক্তি ঈদের নামাজের পর তা আদায় করবে, তা সাধারণ দানরূপে গণ্য হবে। (আবু দাউদ ও ইবনে মাজাহ)
প্রিয়নবী (সা.) ঈদের দিন সকালে পরিবার-পরিজন ও পাড়া-পড়শিদের সচেতন করে তুলতেন তাদের করণীয় কর্তব্য সম্পর্কে। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, মহানবী (সা.) প্রত্যেক ঈদেই তার মেয়ে ও স্ত্রীদেরকে ফিতরা, দান-সাদকা আদায়ের নির্দেশ দিতেন। (মুসনাদে আহমদ)
সদকায়ে ফিতর আদায়ের ফলে একজন দীন-দরিদ্র লোকও ঈদের আনন্দে সামান্য হলেও শরিক হতে পারে। কিন্তু আমাদের সমাজে আজ যেভাবে ঈদ উৎসব পালন করা হয় তা কি প্রকৃত ঈদের আনন্দের আবেদনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ? রোজার সংযম, আত্মশুদ্ধি, ত্যাগ এবং ঈদের উদ্দেশ্য ও স্বরূপ থেকে আমরা আজ বহুদূরে অবস্থান নিয়েছি।
প্রকৃতপক্ষে ঈদের আনন্দ-উৎসব হচ্ছে, পঙ্কিলতার সংস্পর্শ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ও পবিত্র। রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহপাক খুশি হন তখন, যখন তার দেয়া নেয়ামতের শোকর আদায়ের গুণ বান্দার মাঝে প্রকাশ পায়।’
আল্লাহ রাববুল আলামিন আমাদের সকলকে ঈদের গুরুত্ব অনুধাবন করে ঈদ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : প্রভাষক, আরবি বিভাগ, মেহেরপুর আলীয়া মাদ্রাসা, মেহেরপুর
[email protected]
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ জুলাই ২০১৪/শাহ মতিন টিপু
রাইজিংবিডি.কম