ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

ভাসমান জনগণের শীতের রাত 

সাইফুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:২০, ২৩ ডিসেম্বর ২০২০   আপডেট: ১৫:৩৯, ২৩ ডিসেম্বর ২০২০
ভাসমান জনগণের শীতের রাত 

চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন চাঁদপুর থেকে আসা মুন্না। এখন বয়স ৩৫। একমাত্র ছেলে আর বউকে নিয়ে সংসার ভালোই চলছিল। হঠাৎ একটা দুর্ঘটনা। এরপর থেকে আর কাজ করতে পারেন না মুন্না। স্ত্রীও তাকে ছেড়ে চলে যান। ভেঙে যায় সংসার। পথে বসেন মুন্না। হাত পাতেন। যে যা দেন তাই দিয়ে পেটের ভাত যোগান। নেই কোনো জায়গা-জমি। নেই কোনো স্বজন। তাই রাস্তায় খান, রাস্তায় ঘুমান।

ঢাকার মিরপুর শাহ আলী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় মার্কেটের ফুটপাত থেকে কথা হয় মুন্নার সঙ্গে।

মুন্না বলেন, ‘গরিব মানুষ। শীতে কষ্ট বেড়েছে। তবে বড় বড় মানুষ কম্বল ও খাবার দিয়ে যায়। কিন্তু একদল মানুষ এসে আবার কম্বলগুলো নিয়েও যায়।’ 

মুন্নার মতো প্রায় ৫০-৬০ জন অসহায় মানুষ রাত কাটান এখানে। মুন্নার পাশের বিছানায় ৮০ বছরের এক বৃদ্ধ শুয়ে আছেন। নাম আতাউর। সিরাজগঞ্জ থেকে এখানে এসে ভিক্ষা করেন।

আতাউর বলেন, ‘আমার স্ত্রী মারা গেছে। এক মেয়ে আছে। বিয়ে হয়ে গেছে। এখন আমি পথের মানুষ। পথেই থাকি। কেউ দিলে খাই না দিলে উপোস থাকি। রাতে ফুটপাতে ঘুমাই।’ 

এই শীতের রাতে কষ্ট হয় না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘গরিবের আবার কষ্ট। দিন শেষে ভিক্ষা করে ১০০ থেকে ১৫০ টাকার মতো হয়। তা দিয়ে নিজের পেট কোনো রকম চলে। পেটের খুদায় শীত পালায়।’

কাপড় বিক্রেতা হাবিবুর রহমান। বাড়ি নারায়ণগঞ্জের বন্দরের একরামপুরে। শারীরিক প্রতিবন্ধী হাবিবুর সারা দিন শহরের বিভিন্ন জায়গায় কাপড় বিক্রি করেন। কাপড় বিক্রি করে রাতে বাড়ি ফেরা কষ্ট। রাস্তায় থাকে যানজট। তাছাড়া খরচও অনেক। তাই রাত কাটান শাহ আলী মাজার মার্কেটের সামনে। মার্কেটের নৈশ প্রহরীদের জনপ্রতি ৫০ টাকা দিয়ে পাওয়া যায় রাত কাটানোর প্রয়োজনীয় বিছানাপত্র। হাবিবুর রহমানের মতো যাদের রাত কাটানোর মতো নির্দিষ্ট কোনো ঠিকানা নেই, তাদের অনেকেই এখানে টাকা দিয়ে রাত কাটান। 

এছাড়া নামের সঙ্গেই ‘পথ’ শব্দটি যাদের সঙ্গে যুক্ত এমন পথশিশুদের বেশিরভাগেরই ঠিকানা ফুটপাথ। গাবতলী বাস টার্মিনালে রাত কাটায় ১১ বছরের পথশিশু বাপ্পি। বাড়ি বরিশালে। বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। তাই বাড়িতে ঠাঁই হয়নি তার। মা থাকেন বিদেশে। কিন্তু কোন দেশে থাকে তা জানে না বাপ্পি। বাপ্পির সঙ্গে একই চাটাইতে রাত কাটায় শাহাদাৎ, মামুন ও জীবন। এসব পথশিশুদের অনেকেই জানে না কোথায় তাদের বাড়ি। কোথায় তাদের পরিবার।

সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল, সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল, গাবতলী বাস টার্মিনাল, কমলাপুর রেল স্টেশন, গুলিস্তান, ফার্মগেট, পল্টন, বায়তুল মোকাররম মসজিদ, কাকরাইল মসজিদ, হাইকোর্ট মাজারের সামনে বেশি দেখা যায় ছিন্নমূল মানুষদের। 
ঢাকায় ভাসমান মানুষ বাড়ার কারণ সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সাইন্স বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মো. মাইনুল ইসলাম রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘গ্রাম অঞ্চলে কাজ কম থাকায় অনেকে কাজের সন্ধানে ঢাকায় আসে। তাছাড়া, ভাসমান মানুষের মধ্যে বিভিন্ন দুর্যোগের কারণে নিঃস্ব হওয়া মানুষ যেমন, নদী ভাঙান, কাজের সন্ধান, নারীদের বিবাহ বিচ্ছেদ, কুলি ও রিকশাচালকদের সংখ‌্যা বেশি।’ 

ঢাকাতে ভাসমান মানুষের সংখা ১৬ হাজার ২২১ জন। এর তিনের দুইভাগ পুরুষ ও এক ভাগ নারী বলে তিনি জানান।
তীব্র শীতে ভাসমান জনগণের ফুটপাতে ঘুমানোর বিষয়ে মাইনুল ইসলাম বলেন, ‘তারা ভাসমান মানুষ, কিন্তু তাদেরও মৌলিক অধিকার রয়েছে। সেক্ষেত্র ফুটপাতে ঘুমানো মানুষগুলোর পাশে স্থানীয় সরকার বা সিটি করপারেশনের দাঁড়ানো উচিত। সরকারের পাশাপাশি নগরবাসীকেও দায়িত্ব নেওয়া উচিৎ।’

ভবিষ্যতে এসব মানুষের সংখ্যা কমিয়ে আনতে এবং তাদের স্বাভাবিক জীবন-যাপন নিশ্চিতে সরকারের দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা নেওয়া উচিৎ বলে তিনি মনে করেন। এক্ষেত্রে বিভিন্ন ফান্ড তৈরি করে উপজেলা পর্যায়ে পুনর্বাসন ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

ঢাকা/ইভা 

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়