ঢাকা     সোমবার   ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ৩০ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস আজ

মাতৃত্বের পথে অনিরাপদ বাস্তবতা

আসাদ আল মাহমুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৪৬, ২৮ মে ২০২৫  
মাতৃত্বের পথে অনিরাপদ বাস্তবতা

প্রতিটি নতুন প্রাণের আগমন যেমন আনন্দের, তেমনি প্রতিটি মায়ের সুস্থভাবে সন্তানের জন্ম দেওয়া যেন এক যুদ্ধ জয়ের নামান্তর। অথচ সেই যুদ্ধে এখনো প্রতিদিন বাংলাদেশে অনাকাঙ্ক্ষিত পরাজয় ঘটে। হারিয়ে যায় একেকটি সম্ভাবনাময় জীবন।

আজ বুধবার (২৮ মে) নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস। অথচ এই দিনে যখন মাতৃত্বের মর্যাদা আর সুরক্ষা নিয়ে কথা বলার কথা, তখন পরিসংখ্যান বলছে—দেশের অর্ধেকের বেশি মা এখনো নিরাপদ প্রসবের সেবা থেকে বঞ্চিত।

আরো পড়ুন:

বাংলাদেশে এখনো প্রতি লাখ জীবিত শিশুর জন্মে মারা যান ১৩৬ জন মা। অথচ ২০৩০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা ৭০-এ নামিয়ে আনার অঙ্গীকার রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতার সঙ্গে সেই অঙ্গীকারের ব্যবধান এখনও চোখে পড়ার মতো।

গর্ভধারণ হওয়ার আগে চিকিৎসকের শরণ নেওয়া বা নিজ দেহ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরির চর্চা এখনও অনেক নারীর জীবন থেকে অনুপস্থিত। অনেকেই উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, থাইরয়েড বা অতিরিক্ত ওজনের মতো শারীরিক সমস্যাসহ গর্ভধারণ করেন। ফলস্বরূপ, ঝুঁকি বহুগুণে বেড়ে যায়।

বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রেজাউল করিম কাজল বলেন, “আমাদের দেশের নারীরা গর্ভধারণের আগে নিজের স্বাস্থ্যের কোনো মূল্যায়ন করেন না। তারা জানেন না গর্ভে থাকা সন্তান ঝুঁকিতে আছে কি না। এভাবেই প্রতিটি গর্ভধারণ ঝুঁকির দিকে এগোয়।”

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মান অনুযায়ী, একটি সুস্থ গর্ভাবস্থার জন্য অন্তত চারবার প্রসব-পূর্ব সেবা নেওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২৩ সালের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, মাত্র ৩৯ শতাংশ নারী এই সেবা পাচ্ছেন। অর্থাৎ ৬১ শতাংশ নারী এখনও সেই ন্যূনতম সেবাটুকুও পান না। গ্রামাঞ্চলে এই অবস্থা আরো শোচনীয়, সেখানে ৬৪ শতাংশ নারী গর্ভকালীন সেবা থেকে বঞ্চিত। শহরেও অবস্থা খুব একটা ভালো নয়, ৪৩ শতাংশ নারী পাচ্ছেন না এই সেবা। এমনকি ২ শতাংশ নারী একবারও চিকিৎসকের মুখ দেখেননি গর্ভাবস্থায়।

বাসাবাড়িতে প্রসব এবং অদক্ষ ধাত্রীর হাতে জীবন

গবেষণা বলছে, এখনো ৩৬ শতাংশ নারী বাসাবাড়িতেই সন্তান প্রসব করছেন। আর এর অধিকাংশই অদক্ষ ধাত্রীর হাতে। শহরের তুলনায় গ্রামে এই হার ১৪ শতাংশ বেশি। অথচ বাসাবাড়িতে প্রসব মানেই জীবনহানির সম্ভাবনা কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়া। এ প্রসঙ্গে ডা. কাজল বলেন, “বাড়িতে প্রসূতি মৃত্যুটা এক ধরনের অপমৃত্যু। এমন মৃত্যু হলে তদন্ত হওয়া জরুরি। নইলে যত কমিউনিটি ক্লিনিকই খোলা হোক, তাতে লাভ হবে না।”

স্বাস্থ্যব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা ও বৈষম্য

অঞ্চলভেদে স্বাস্থ্যসেবার যে বৈষম্য, সেটি মাতৃত্বকে আরো ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। শহরে যেখানে সরকারি হাসপাতালে সন্তান প্রসবের হার ৩৪ শতাংশ, গ্রামে সেটি ২৪ শতাংশ। মোটের ওপর সরকারি হাসপাতালে সন্তান প্রসব হচ্ছে মাত্র ২৬ শতাংশ মায়ের, যা বাসাবাড়িতে প্রসবের চেয়ে কম। অনেক সময় জেলা পর্যায়ের হাসপাতালে রোগী রেফার করা হলেও, আগের চিকিৎসা কেন্দ্র আর দায়িত্ব নেয় না। ফলে ঝুঁকিতে পড়েন প্রসূতি ও তার পরিবার।

নিরাপদ মাতৃত্বের পথে বড় বাধা

আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো- বাল্যবিবাহ। ১৫ বছরের কম বয়সে বিয়ের হার এখন ৮ দশমিক ২ শতাংশ, যা আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে। ১৮ বছরের আগেই বিয়ে হয় ৪২ শতাংশ নারীর। এই বয়সে সন্তান ধারণের ফলে শরীর ও মনের উপর যে ভয়াবহ চাপ পড়ে, তা মাতৃত্বকে আরো অনিরাপদ করে তোলে।

এবারের নিরাপদ মাতৃত্ব দিবসের প্রতিপাদ্য ‘মাতৃস্বাস্থ্যের সমতা, বাদ যাবে না কোনো মা’। চমৎকার এক স্লোগান। কিন্তু বাস্তবে বাদ পড়ছেন শত শত মা। বাদ পড়ছে সেবার সুযোগ থেকে, সচেতনতার আলো থেকে, আর সবচেয়ে করুণভাবে জীবনের অধিকার থেকে।

গর্ভধারণের আগে ও পরে নিয়মিত চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি ইউনিয়নে দক্ষ ধাত্রী ও চিকিৎসক নিয়োগ জরুরি। প্রসব-পূর্ব সেবাকে বাধ্যতামূলক করতে সচেতনতা এবং প্রণোদনার ব্যবস্থা দরকার। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কঠোর ও কার্যকর আইনি প্রয়োগ। গর্ভকালীন পুষ্টি ও সচেতনতা বৃদ্ধি পদক্ষেপ জরুরি। বাড়িতে মাতৃমৃত্যুর ঘটনায় তদন্ত ও দায় নিরূপণ বাধ্যতামূলক করা দরকার। রেফারেল ব্যবস্থাকে জবাবদিহির আওতায় আনা দরকার।

বাংলাদেশ সচিবালয়ের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা সাবিহা জাহান বলেন, “মাতৃত্ব শুধুই একটি নারীর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নয়, এটি একটি রাষ্ট্রীয় দায়। প্রতিটি সুস্থ মা মানে একটি সুস্থ প্রজন্ম। নিরাপদ মাতৃত্ব দিবসে সেই দায়বদ্ধতার কথা রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারকে আবারো মনে করিয়ে দেয়ার সময় এখন। নয়তো প্রতিটি বছর দিবস পালিত হবে, আর শত শত মা হারিয়ে যাবেন নীরবে একটি অনিরাপদ সমাজের মূর্ছনাপূর্ণ করুণ ইতিহাসে।”

ঢাকা/এএএম/ফিরোজ

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়