জুলাই সনদ: একমত গণভোটে, অনিশ্চয়তা বাস্তবায়নে
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের জন্য জনগণের সম্মতি নিতে গণভোট করার বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। তবে গণভোট নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমতে পৌঁছালেও সনদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব নিয়ে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বা দ্বিমতের বিষয়টি একটি জটিলতা সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর অবস্থান পরস্পরবিরোধী হওয়ায় সনদের বাস্তবায়ন নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
কমিশনের সর্বশেষ সংলাপে অংশ নিয়ে বিএনপি সাফ জানিয়ে দিয়েছে, যে সংস্কার প্রস্তাবগুলোতে কোনো রাজনৈতিক দলের ‘নোট অব ডিসেন্ট’ থাকবে, তা তাদের পক্ষে বাধ্যতামূলক হবে না— যদি গণভোটে জনগণ সনদের পক্ষে রায় দেয়। অপরদিকে, জামায়াতে ইসলামীর মতে, পুরো সনদ একটি প্যাকেজ হিসেবে বিবেচিত হবে এবং গণভোটে তা অনুমোদন পেলে সংশ্লিষ্ট সব প্রস্তাবই পরবর্তী সরকার ও সংসদের জন্য বাধ্যতামূলক হবে।
এই দুই ভিন্ন অবস্থান এখন পুরো প্রক্রিয়াকে এক ধরনের অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন বলছে, তারা এই জটিলতা নিরসনে আবারো সংলাপে বসছে এবং বুধবার (৮ অক্টোবর) অনুষ্ঠিতব্য সংলাপ হবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তাদের শেষ বৈঠক।
কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’–এর অন্তর্ভুক্ত ৮৪টি প্রস্তাবের মধ্যে ৭৩টিতে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে। তবে বাকী ১১টি প্রস্তাবে রয়েছে বড় ধরনের মতবিরোধ। এরমধ্যে ১৯টি সংবিধান সংশোধন সম্পর্কিত বিষয়ে রয়েছে ১০টি ভিন্নমত বা ‘নোট অব ডিসেন্ট’। এসব ‘ডিসেন্ট’ মূলত বিএনপি ও অন্যান্য কয়েকটি দলের পক্ষ থেকে এসেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বাস্তবায়নে বাধ্যবাধকতা না থাকলে, জনগণের রায় সত্ত্বেও সংবিধান সংস্কারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ঝুলে থাকবে। এতে জনগণের আস্থা এবং গণভোটের কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে।
বিএনপি ও জামায়াতের বিপরীত অবস্থান
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “নোট অব ডিসেন্ট এখন সনদেরই অংশ। কোন দল কোন প্রস্তাবে দ্বিমত জানিয়েছে, সেটি জনগণ জানবে এবং সেই দল যদি নির্বাচনে জয়লাভ করে, তাহলে তারা সেই প্রস্তাব বাস্তবায়ন না করার অধিকার রাখবে। এটাই আমাদের প্রস্তাব।”
অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, “গণভোটে জনগণ যদি হ্যাঁ বলে, তাহলে পুরো সনদ বাস্তবায়ন করতে হবে। এখানে কে কী আপত্তি দিয়েছে, তা গণরায়ের বিপরীতে যেতে পারে না।”
এই দুই দল সরকারের বাইরের প্রধান দুটি রাজনৈতিক শক্তি হলেও, এই দুই বিপরীত অবস্থানই মূল সংকটের উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে।
‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’-এর বিতর্কিত প্রস্তাবগুলো বাংলাদেশের সংবিধান, সংসদীয় কাঠামো ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কাঠামোতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে প্রস্তাবিত।
বিতর্কিত ১৯টি প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, সংসদীয় কমিটির সভাপতিত্বে বিরোধীদলের অংশগ্রহণ, নির্বাচনি এলাকার সীমানা পুনর্নির্ধারণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদানের বিধান, বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণ, জরুরি অবস্থা ঘোষণা সংক্রান্ত আইন, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ পদ্ধতি, প্রধানমন্ত্রী একাধিক পদে থাকতে পারবেন কি না নির্বাচন কমিশন, সরকারি কর্ম কমিশন, দুদক, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও ন্যায়পালের নিয়োগ, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল নির্ধারণ, সংসদে নারী প্রতিনিধিত্বের নতুন কাঠামো, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ (উচ্চকক্ষসহ), উচ্চকক্ষের সদস্য নির্বাচনের পদ্ধতি, উচ্চকক্ষের ক্ষমতা ও এখতিয়ার, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পদ্ধতি, রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব ও ক্ষমতা, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা, মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, রাষ্ট্রের মূলনীতি সংশোধন।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, “বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিয়েছেন যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সম্মত প্রস্তাবগুলো এক প্যাকেজে রাখা যেতে পারে এবং ‘নোট অব ডিসেন্ট’ প্রস্তাবগুলো আরেক প্যাকেজে। এতে করে গণভোটে দুটি প্রশ্ন রাখা সম্ভব হবে এবং জনগণের সিদ্ধান্ত স্পষ্ট হবে।”
এই কৌশলে গণভোটে দুটি আলাদা ভোট নিতে পারে সরকার। একটিতে থাকবে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলসমর্থিত প্রস্তাব, অন্যটিতে থাকবে বিতর্কিত বিষয়।
সময়সীমা ও চূড়ান্ত পর্যায়
কমিশনের কার্যক্রম শুরু হয় ২০২৫ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। মূলত, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত এই সাত সদস্যবিশিষ্ট কমিশনের মেয়াদ ছিল ছয় মাস। পরে তা দু’দফায় বাড়িয়ে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে।
সংলাপ শেষে চূড়ান্ত খসড়া সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হবে ১০ অক্টোবরের মধ্যে। এরপর সরকার একটি নির্দিষ্ট তারিখে রাজনৈতিক দলগুলোর স্বাক্ষরের মাধ্যমে সনদটি অনুমোদন করাবে। এর পরেই নির্বাচন কমিশন গণভোট আয়োজনের প্রস্তুতি নেবে।
গণভোটের ভবিষ্যৎ প্রভাব ও নাগরিক উদ্বেগ
জনগণের অংশগ্রহণ ও গণরায় নির্ভর করবে মূলত দুইটি বিষয়ের ওপর। এক, গণভোট কীভাবে আয়োজন করা হবে এবং দুই, ভোটের রায় কতটা বাস্তবায়নযোগ্য হবে।
যদি গণভোটে জনগণ সনদের পক্ষে রায় দেয়, কিন্তু নির্বাচনে জয়ী দলগুলো ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেখিয়ে প্রস্তাব বাস্তবায়ন না করে, তবে তা জনগণের আস্থার মারাত্মক সংকট তৈরি করবে মন্তব্য করেন সংশ্লিষ্টরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র আনোয়ার হোসেন নিরব এ প্রসঙ্গে বলেন, “এত মতভেদ, আপত্তি ও জটিলতার মাঝেও একটি বড় অগ্রগতি হলো সব রাজনৈতিক দলই গণভোটের প্রয়োজনীয়তা ও বৈধতা স্বীকার করেছে। এখন দরকার ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে বাস্তবায়নযোগ্য একটি পন্থা নির্ধারণ করা, যেখানে গণরায়, রাজনৈতিক দল এবং সংবিধান সব কিছুর ভারসাম্য রক্ষা পায়। আজকের সংলাপে যদি একটি বাস্তবসম্মত ফর্মুলা আসে, তাহলে তা হতে পারে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কারের এক নতুন যুগের সূচনা।”
ঢাকা/এএএম/ইভা